অনেক শিশুই স্কুলে যেতে কিছুটা ভয় পায় কিংবা স্কুলে যাওয়ার প্রতি থাকে অনীহা। স্কুলের নাম বললেই হাজারো অজুহাতের বুলি শুনতে মা-বাবাকে। তবে ব্যাপারটির মধ্যে সাধারণত অস্বাভাবিকতার কোনো ছাপ দেখা যায় না। হঠাৎ করে মা-বাবা এবং পরিবার থেকে আলাদা হয়ে কয়েক ঘণ্টা অপরিচিতদের ভিড়ে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য মা-বাবাও এই বিষয়কে বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেন না। সময়ের সাথে প্রাকৃতিকভাবেই এই সমস্যার সমাধান ঘটে যাবে, এমনটাই প্রত্যাশা তাদের। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকমই হয়।
তবে কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রে এই ক্ষণস্থায়ী ব্যাপারটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যে ভয়টা সময়ের সাথে আপনাআপনি কমে যাওয়ার কথা, তা দিন দিন বাড়তেই থাকে। দিন দিন এর প্রভাব একটি শিশুর শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ ভাষায় একে ‘স্কুল অ্যাভয়ডেন্স’, ‘স্কুল রিফিউজাল’ বা ‘স্কুল ফোবিয়া' বলে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটি ডিডাসক্যালেইনোফোবিয়া নামে পরিচিত। দুর্লভ এই ফেবিয়ায় আক্রান্ত বিশ্বের ২ থেকে ৫ শতাংশ শিশু। শব্দটি গ্রিক ‘ডিডাস্কো’ এবং ‘ফোবোস’ থেকে এসেছে। ‘ডিডাস্কো’ অর্থ শেখানো এবং ‘ফোবোস’ বলতে ভয় বা ঘৃণাকে বোঝানো হয়। এই ফোবিয়াকে বোঝানোর জন্য ‘স্কোলিওনোফোবিয়া’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়, যার উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘স্কিয়াস’ থেকে। এর অর্থ ‘জানা’। যেসকল বাচ্চা এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত, তাদের মধ্যে স্কুল পলায়নের প্রবণতা বা এ নিয়ে টালবাহানার অভ্যাস দেখা যায়। সাধারণত অনেক শিশুই স্কুলের নাম শুনলে বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তবে ডিডাসক্যালেইনফোবিয়ায় আক্রান্ত কোনো শিশুর ক্ষেত্রে অবস্থাটি হয় বেশ বেগতিক। স্কুলের নাম শুনলেই তাদের প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে। মনোবিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ফোবিয়া চার থেকে ছয় বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে মূলত দেখা যায়, যারা সাধারণত প্রি-স্কুলের শিক্ষার্থী। এই ফোবিয়া শনাক্ত করা কিছুটা কষ্টসাধ্য। কারণ এত ছোট বাচ্চারা নিজেদের অনুভূতি ভালোমতো প্রকাশ করতে পারে না। আর প্রকাশ করলেও ভয়টি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক, তা বোঝাও কষ্টকর।
কারণগুলো কী?
এর চিকিৎসা করার পূর্বে অবশ্যই একটি শিশুর জীবন, বিশেষ করে তার স্কুল জীবন সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে, একদম ছোটখাট বিষয়গুলোও। যেমন- বাচ্চাটি স্কুলে বা স্কুল বাসে কোনো হেনস্তার শিকার হচ্ছে কি না, স্কুলে যাওয়ার পথে সে কোনো প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যার সম্মুখীন হয় কি না, তার শিক্ষক এবং সহপাঠীদের ব্যবহার সম্পর্কেও জানতে হবে। সব বিষয় জানার পরই কেবলমাত্র একটি শিশুর ক্ষেত্রে তার এই ফোবিয়ার আসল কারণ জানা সম্ভব। অবশ্যই সবার ক্ষেত্রে এর কারণ এক হয় না।
৪-৬ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয় অনেকসময় কাজ করে। তাদের মনে হয় স্কুলে চলে গেলে পরে হয়তো আর মা-বাবার সাথে দেখাই হবে না। কোনো নেতিবাচক বা কষ্টদায়ক ঘটনা, যেমন- মা-বাবার মধ্যে মনোমালিন্য বা বিবাহবিচ্ছেদ, কোনো আপনজনের মৃত্যু ইত্যাদি এই ফোবিয়ার প্রভাব আরও বাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটলে তা মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যা পরবর্তীতে ফোবিয়ার আকার ধারণ করে।
মাঝে মাঝে ১৩-১৫ বছর বয়সী মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ডিডাসক্যালেইনোফোবিয়া দেখা যায়। হঠাৎ করে স্কুলে পড়ার চাপ বাড়লে বা কঠিন কোনো বিষয়, যেমন- গণিত, বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে বুঝতে সমস্যা হলে তা মানসিক চাপের সৃষ্টি করে।
এই বয়সী কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটে। হরমোনজনিত পরিবর্তনের কারণে এমনিতেই তাদের বেশ ভুগতে হয়। এর মাঝে বাড়তি মানসিক চাপ আরো বেশি ক্ষতি করে।
তাছাড়া আরো কিছু ব্যাপার আছে। স্কুলের পরিবেশ নিরাপদ বা শিশুবান্ধব না হলে, যেমন- বুলিং, পড়া না পারলে কঠোর শাস্তি, স্কুলের সাথে জড়িত কোনো ব্যক্তির বিপজ্জনক আচরণ বা এরকম কোনো ঘটনা শিশুর মধ্যে ডিডাসক্যালেইনোফোবিয়ার জন্ম দিতে পারে। আবার ঘন ঘন স্কুল পরিবর্তন করলে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ভালো না মন্দ তা, নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে তাদের মনে। যে সন্দেহ কখন যে ভয়, আর ভয় থেকে পরবর্তীতে এই ফোবিয়ার জন্ম দেয়, তা সেই শিশু নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। কোনো ভীতিই আসলে একদিনে ফোবিয়ার আকার ধারণ করে না। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর এই সময়ের মধ্যে ভয়ের মূল বিষয়ের সাথে জড়িত ঘটনা ঘটলে তা দিন দিন আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
লক্ষণসমূহ
ডিডাসক্যালেইনোফোবিয়ায় আক্রান্ত একটি শিশুর ক্ষেত্রে কিছু শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন-
১. স্কুলে যাওয়ার কথা বললেই অস্বাভাবিকভাবে কান্নাকাটি করা, কারো কারো ক্ষেত্রে প্যানিক অ্যাটাকও দেখা যেতে পারে। অনেক সময় একজন ফোবিক কিশোর-কিশোরী বা শিশু স্কুলে যাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সবসময় অসুস্থতার ভান করে কিংবা নিজেকে নিজেই ছোটখাট আঘাত করে, যার জের ধরে সে স্কুলে যাওয়া থেকে বাঁচতে পারবে বলে মনে করে। আবার অনেকে রাতভর ইচ্ছা করে কান্নাকাটি করে, যাতে করে তাদের মা-বাবা বিরক্ত কিংবা ক্লান্ত হয়ে যায় এবং স্কুলে যাওয়া না লাগে। শুধু তা-ই নয়, এসব ফোবিক শিশু সবসময়ই নিজেদের মা-বাবাকে অনেক বেশি জ্বালায়। এর পেছনে তাদের সরল যুক্তি হলো, এতে করে তাদের অভিভাবকেরা স্কুলে যেতে জোর করবেন না। তবে ফলাফল যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর উল্টো হয়, তা-ও আর নতুন করে কিছু বলার নেই!
২. ফোবিক শিশুরা বেশিরভাগ সময়েই নেতিবাচক চিন্তা করে, বিশেষ করে মৃত্যু সম্পর্কিত। আপনজন এবং মা-বাবার খারাপ কিছু হতে পারে, এরকম চিন্তা মন ও মস্তিষ্ককে অবশ করে দেয়। ফলে তারা এক লহমার জন্যও তাদের ছেড়ে যেতে চায় না। আর এই কম বয়সে মা-বাবা তাদের বাচ্চাদের স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও এত বেশি সময়ের জন্য একা রাখে না। ফলস্বরূপ, ফোবিক শিশুর মনে স্কুলের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং ক্ষোভ জন্মানোর বিষয়টা খুব অস্বাভাবিক নয়। অবশ্য এই অবস্থায় শুধু স্কুলের প্রতি ভয় নয়, বরং বাসায় একা থাকার বা অন্ধকারে থাকার মতো ভয়, কিংবা ভূতের ভয়ও তার মধ্যে কাজ করে।
৩. কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে অবশ্য সবসময় একরকম ব্যবহার দেখা যায় না। তারাও শিশুদের মতো নিজেদের ফোবিয়ার কথা কাউকে বলে না। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো তাদের কাছে বুঝিয়ে বলার ভাষা নেই আর কিশোর-কিশোরীদের সমস্যা হলো, তাদের বলার কোনো ইচ্ছা নেই। সেজন্য তারা সবকিছু এড়িয়ে চলা শুরু করে। স্কুলে যাওয়া নিয়ে টালবাহানা এক্ষেত্রে আরো তীব্র হয়। চেহারায় বিষণ্নতার ছাপও স্কুল ফোবিয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করে।
৪. মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড় করা, শুকনো মুখ, ঘন ঘন ঘামা, ঊর্ধ্বশ্বাস, বমি বমি ভাব এবং প্যানিক অ্যাটাকের মতো লক্ষণগুলো ডিডাসক্যালেইনোফোবিয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু শারীরিক পরিবর্তন।
প্রতিকার
কোনো ফোবিয়ারই আসলে স্থায়ী কোনো চিকিৎসা বা ঔষধ নেই। তবে যতটা সম্ভব একে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
যদি আপনি কোনো ফোবিক শিশুর অভিভাবক হন, তাহলে অবশ্যই আপনাকে আপনার বাচ্চার প্রতি নমনীয় হতে হবে এবং খুব সতর্কতার সাথে ব্যাপারটা বুঝতে হবে।
একটি ইতিবাচক দিক হলো, বড়দের তুলনায় শিশু বা কমবয়সীদের মধ্যে নতুন কোনো চিন্তাধারা বা অভ্যাস গড়ে তোলা সহজতর। প্রাপ্তবয়স্ক হতে হতে তারা তাদের ফোবিয়া ভুলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সুযোগও পেতে পারে। সেজন্য মা-বাবা এবং আপনজনদের অবশ্যই সাহায্য করতে হবে। শিশুরা যেন মন খুলে তাদের সমস্যা বলতে পারে সেরকম বন্ধুসুলভ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঔষধ গ্রহণেরও প্রয়োজন হয়। তবে অবশ্যই তা ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞদের কথা মতো সেবন করতে হবে। অবশ্য বিশেষজ্ঞের মতে, ঔষধ সেবনের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন এরকম ঔষধ খাওয়া ইতিবাচক নয়। মা-বাবা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং আশেপাশের লোকজন সচেতন হলে একটি শিশুকে এই ফোবিয়ার হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।
This article is in Bangla language. It's about 'Didaskaleinophobia', fear of going school. Sources have been hyperlinked in this article.
Featured image: psychologytoday.com