ইলেক্ট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেটকে প্রায়ই প্রচলিত তামাক তথা নিকোটিনে ভরপুর সিগারেটের একটি নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি একটি ব্যাটারিচালিত ডিভাইস যা সিগারেটের চাহিদা পূরণ করে থাকে। কয়েক বছর আগে যখন বাজারে এই ই-সিগারেটের প্রচলন শুরু হয় তখন একে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারীদের ধূমপানের অভ্যাস দূর করার জন্য একটি কার্যকরী প্রযুক্তি হিসেবেই ধরা হয়।
তবে যেরকম ভাবা হয়েছিল সেরকম আসলে ঘটল না। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিগারেট বাজারের তিন-চতুর্থাংশ দখল করে নেয় নবাগত ই-সিগারেট। গতানুগতিক সিগারেটের চেয়ে এই নতুন ধরনের সিগারেটের চাহিদাই জনগণের কাছে বাড়তে থাকে। পরিকল্পনানুসারে এর মূল ক্রেতা প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারীদের হওয়ার কথা থাকলেও তা হলো না। উল্টো অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর -কিশোরীরা, যারা কখনো ধূমপানই করেনি, তারা এই সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। আসলে ই-সিগারেট বিভিন্ন আকার এবং স্বাদ ও গন্ধের পাওয়া যাওয়ায় তা সকলের নিকট অধিক সমাদৃত হয়। তবে এর কুফল যে সাধারণ সিগারেটের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয় সেই ব্যাপারটা অনেকেই অগ্রাহ্য করে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এই ই-সিগারেটের ফলে ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে এবং ১,০০০ জনেরও বেশি মানুষ ফুসফুসের মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়।
ইতোমধ্যে ২০টিরও বেশি দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ই-সিগারেটের বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিছু কিছু দেশে তো এই ধরনের সিগারেট কারো মালিকানায় রাখার উপরও দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। যেসব দেশে এই ইলেকট্রনিক সিগারেট নিষিদ্ধ হয়েছে সেসব দেশের মধ্যে থাইল্যান্ড খুব কঠোরভাবে এটি তত্ত্বাবধান করছে। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং নরওয়ে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের উপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ই-সিগারেটের উপর হোয়াইট হাউজ সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করার কিছুদিন পরই ভারত জরুরি ভিত্তিতে ই-সিগারেটের উৎপাদন, আমদানি এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আমাদের দেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
ই-সিগারেট কী?
ই-সিগারেট হলো ব্যাটারি দ্বারা চালিত ডিভাইস যা দেখতে অনেকটা সিগারেটের মতোই। যদিও এতে তামাক থাকে না তবে যথেষ্ট পরিমাণ নিকোটিন জাতীয় উপাদান থাকে। অবশ্য আধুনিক যুগে ই-সিগারেটের মধ্যে ভ্যাপ মডস, জুলস, ভ্যাপ পেনস অন্তর্ভুক্ত। অনেকেই মনে করে যে, এই ধরনের সিগারেটে প্রচলিত সিগারেটের মতো এত বেশি নিকোটিন থাকে না।
সিগারেটের প্রতি আসক্তি কমাতে চাইলে এই ব্যাটারিচালিত সিগারেট ভূমিকা রাখে বলে অনেকে ধারণা করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। গবেষণায় দেখা গেছে যে ই-সিগারেটে যে পরিমাণ নেশা সৃষ্টিকারী পদার্থ নিকোটিন থাকে তা এর প্রতি আসক্তি সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। আর যদি কেউ ই-সিগারেটের মাধ্যমেই ধূমপান শুরু করে তাহলে ঐ ব্যক্তির ভবিষ্যতে ধূমপানের প্রতি আরো বেশি আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর কারণ একটু পরে আরো বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আসলে ই-সিগারেটের মতো ইলেক্ট্রনিক প্রোডাক্ট নিকোটিন গ্রহণে সহায়তা করে। এটি নিকোটিন, সুগন্ধি এবং অন্যান্য উপাদানে ভরা তরল কার্তুজকে তাপ দিয়ে ধূমপান করতে সহায়তা করে। যেহেতু এই ই-সিগারেটে তামাকের বদলে তরল পদার্থ থাকে সেহেতু এই ধরণের সিগারেটে কোনো ধোঁয়া সৃষ্টি হয় না বলেই ধরা হয়।
কেন ই-সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্ম?
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে ২০১৫’-এর অনুসারে ২০১১ থেকে ২০১৫ সালে ই-সিগারেট ব্যবহারকারী কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ৫% থেকে ১৯%-এ এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ চার গুণেরও বেশি। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রায় তিন মিলিয়ন শিক্ষার্থী এর ব্যবহার শুরু করে বলেও জানা যায়। স্কুলে যাওয়া প্রতি ৫ জন শিক্ষার্থীর একজন বলেছে যে, ই-সিগারেটের আগে কখনও সাধারণ সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপান করেনি। কমবয়সীদের মধ্যে এর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার পরিণতি হয় ভয়াবহ। কিশোর-কিশোরীরা ই-সিগারেট ব্যবহার করলে সাবালক হতে হতে ধূমপানে অতিরিক্ত অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। প্রতি ১০ জনে ৯ জনের মধ্যেই এরকম দেখা যায়। তাছাড়া এগুলো ব্যবহারে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
আসলে ই-সিগারেট এমন মানুষদেরও ধূমপানে উদ্বুদ্ধ করছে যারা হয়তো কখনও ধূমপান করা সম্পর্কে ভাবতোও না। এর একটি কারণ হলো সাধারণ বা প্রচলিত সিগারেটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানির প্রোডাক্ট হলেও ঘুরে ফিরে তামাকে মুড়ে দেওয়া সিগারেটই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই সিগারেটে যেমন আকারের ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিকল্প, তেমন ফ্লেভার বা স্বাদের ক্ষেত্রেও কিছুটা স্বাধীনতা পাবে ধূমপায়ীরা। আর একবার এই সিগারেটে পারদর্শী হয়ে গেলে প্রচলিত সিগারেট ব্যবহার করে দেখার ইচ্ছা জাগা স্বাভাবিক বিষয়ই বলা যায়। ইলেকট্রনিক সিগারেট বিভিন্ন ফলের স্বাদযুক্ত পাওয়া যায়।
গবেষকদের মতে, নিকোটিনের সাথে চিনি বা মিষ্টি জাতীয় উপাদানের সংযোগ এই ধরণের সিগারেটের প্রতি আসক্তিকে বেশি দৃঢ় করে। এটা এই প্রোডাক্টের আসক্তি-সৃষ্টিকারী একটি বিশেষ গুণ। টিউবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার নীলস ক্রোমার এরকম তথ্য দেন। হঠাৎ করে ই-সিগারেটের চাহিদা বাড়ার পেছনে বিভিন্ন ফ্লেভার বা স্বাদের হওয়া যেমন একটি বড় কারণ, তেমন মিষ্টির সংযোগে আরো বেশি নেশা-সৃষ্টিকারী দ্রব্য তৈরি করা সুদূর ভবিষ্যতে এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী।
ফ্লেভারের কারণে ই-সিগারেটের প্রতি আসক্ত হওয়ার কথা উঠলে জুল কোম্পানির কথা না বললেই নয়। প্রায় ৭,০০০-এরও বেশি ফ্লেভারের ই-সিগারেট বিক্রি করছে এই তামাক কোম্পানি। গবেষণায় দেখা যায় যে, অপ্রাপ্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারীরা নিকোটিনযুক্ত সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ফ্লেভার বা স্বাদযুক্ত ইলেক্ট্রনিক সিগারেটই বেশি পছন্দ করে। আবার ই-সিগারেট ফ্লেভার ছাড়া হলে তা ধূমপানকারীরা ব্যবহার করতে চায় না। আর দুঃখের বিষয় হলো এই ফ্লেভারই ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লেভারযুক্ত সিগারেট নিষিদ্ধ করা হলেও এর প্রভাব ই-সিগারেটে পড়ে নেই, কারণ তামাকবিহীন এই প্রোডাক্ট সিগারেটের পর্যায়ে পড়ে না। জুলের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয় যে, কোম্পানিটি ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-এর সাথে একত্রিত হয়ে তরুণ সমাজের সিগারেটের প্রতি আসক্তি কমানোর কাজ করছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা।
ই-সিগারেটের কুফল
ই-সিগারেটে থাকা কেমিক্যাল, তেল, ফ্লেভার এবং নিকোটিন তাপের সংস্পর্শে আসলে অ্যারোসল সৃষ্টি করে। এ থেকে সৃষ্ট সূক্ষ্ম কণাগুলো আকারে তামাক কণার মতোই, যা ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এসব সিগারেটের বেশিরভাগ কেমিক্যালই কোষের জন্য বিষাক্ত। অবশ্য এর প্রভাব কতটুক ক্ষতিকর তা বোঝা কষ্টকর। কারণ প্রত্যেকটি সিগারেটের কেমিক্যালের মিশ্রণ এবং গঠন আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। সুগন্ধি বা ফ্লেভারযুক্ত সিগারেট ধূমপানে ব্যবহার করা তামাক জাতীয় সিগারেটের চেয়ে কম নিকোটিনযুক্ত হতে পারে। কিন্তু এসব সুগন্ধির জন্য ব্যবহৃত কেমিক্যাল শ্বাসের সাথে নেওয়াটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ ই-সিগারেট ব্যবহার করলে তা বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও থাকে।
ই-সিগারেটে ব্যবহৃত তরল পদার্থটি শিশু ও বয়স্কদের চামড়ায় বা চোখে গেলে তা বিষের ন্যায় কাজ করতে পারে যার ফল মৃত্যু পর্যন্ত গড়াতে পারে। প্রচলিত সিগারেটের মতোই এসব ই-সিগারেটও ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। গর্ভকালীন সময়ে ই-সিগারেট ব্যবহারে উঠতি ফিটাসের ক্ষতি হয়। এমনকি গর্ভপাতও ঘটতে পারে। আবার কিছু কিছু ই-সিগারেটে ফরমালডিহাইড থাকে। এর ফলে ব্যবহারকারীর বমি বমি ভাব কিংবা বমি হয়, মাথা ঘুরায়। নাক ও মুখেও বিভিন্ন ক্ষত ও সমস্যার সৃষ্টি করে।
এফডিএ এখনো ধূমপান কমানোর জন্য ই-সিগারেট ব্যবহারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাছাড়া ই-সিগারেট কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সাধারণ সিগারেটের মতোই ক্ষতিকর। কোনটা বেশি ক্ষতিকর কিংবা ই-সিগারেট ব্যবহার করা কতটুকু নিরাপদ তা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তাই আপাতত ই-সিগারেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকাই ভালো।
মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১) মাদক পাচার ও মাদকাসক্তি: বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ
২) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মাদক ও তামাক
This article is in Bangla language. It's about e-cigarette. Sources have been hyperlinked in this article.
Featured image: Safety Signs