হাসান সাহেব বছরখানিক হলো চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও তার একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বেশিরভাগ সময়ই তার ওপর নাখোশ হয়ে থাকেন। তিনি যতটাই চেষ্টা করুন না কেন, তার কাজ বা কোনো সিদ্ধান্তই সিনিয়র সেই মানুষটির পছন্দ হয় না। বেশিরভাগ দিনই বিনা কারণে নেতিবাচক কথা শুনে, হাসিঠাট্টার পাত্র হয়ে হাসান মানসিকভাবে হতাশায় ভুগছেন। দিন দিন তার কাজের প্রতি অনীহা যেমন বাড়ছে, তেমনি নিজের উপরে থাকা আত্মবিশ্বাসের পাল্লাটাও হালকা হয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, কিছুদিন হলো তার শরীর সারাক্ষণ খারাপ থাকে। ক্লান্তি, ঠান্ডা, হাত এবং কাঁধ প্রচণ্ড ব্যথা করা, শরীরের নানা অংশে ফুসকুড়ি জন্ম নেওয়া- এমন সব শারীরিক সমস্যাতেও ভুগছেন তিনি।
মজার ব্যাপার হলো, চিকিৎসকদের মতে- কর্মক্ষেত্রে এমন 'বুলি' বা নেতিবাচক আচরণ একজন ব্যক্তিকে মানসিকভাবে যেমন অসুস্থ করে তোলে, তেমনি শারীরিকভাবেও নানাবিধ প্রভাব রাখে।
কর্মস্থলে বুলিং বা অপ্রীতিকর আচরণের শিকার হওয়া: সংজ্ঞাটা কী?
বিশ্ববিদ্যালয়ে বা খেলার মাঠে 'বুলি' হওয়ার ঘটনা খুব অহরহ। তাই সেখানে এর সংজ্ঞাটাও সবার জানা। কিন্তু কর্মস্থলে 'বুলিং'এর সংজ্ঞা কী? কর্মস্থলে যেমন খানিকটা লজ্জায় পড়ার ঘটনা ঘটতে পারে, তেমনি প্রচুর কাজ চাপিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপারও দেখা দেয়। তাহলে বুলিং, সেটা কী? মূলত, কর্মস্থলে তৈরি হওয়া এমন একটি অবস্থাকে বুলিং বলে যেখানে একজন কর্মী বারবার, একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য এক বা একাধিক সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতনের দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন হন এবং আক্রান্ত ব্যক্তির এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার মানসিক বা শারীরিক ক্ষমতা থাকে না।
খুব সহজ কথায়, কর্মস্থলের বুলিংয়ের সাথে দীর্ঘকালীন লজ্জাজনক পরিস্থিতি এবং মানসিক সংঘর্ষের সম্পর্ক রয়েছে। একইসাথে কোনো একটি জালে আটকা পড়ে যাওয়া এবং এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার কোনো উপায়ও থাকে না।
বিপদের পরিমাণ কতটা বেশি?
২০১৮ সালে কর্মস্থলে বুলি হওয়ার এমন নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানতে সুইডেন এবং ডেনমার্কের প্রায় ৮০ হাজার মানুষের উপরে একটি গবেষণা চালায় ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেন। তিয়ানওয়ে জু'র নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণার সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করেন একদল বিশেষজ্ঞ গবেষক। এক্ষেত্রে তারা মাথায় রাখেন, এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা গত বছর নিজেদের কর্মস্থলে বুলির শিকার হয়েছিলেন, নাকি হননি। একইসাথে তারা এই তথ্যও সংগ্রহ করেন যে, পরবর্তী চার বছরে এই মানুষগুলো হৃদপিণ্ডজনিত কোনো অসুখে ভুগেছেন বা এমন কোনো অসুস্থতার মুখোমুখি হয়েছেন কি না।
নারী এবং পুরুষ- গবেষণায় অংশ নেওয়া দুই দলের ভেতরেই ভীতিকর প্রভাব দেখা যায়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৮-১৩% মানুষ জানান, তারা নিজেদের কর্মস্থলে নেতিবাচক মানসিকতা বা বুলির শিকার হয়েছিলেন। আর এই ব্যক্তিদের ভেতরে অন্যদের তুলনায় কার্ডিয়াক সমস্যা, স্ট্রোক এবং হৃদপিণ্ডের অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনাও ১.৫৯ শতাংশ বেশি থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে, কর্মস্থলে বুলিংয়ে শিকার হয়েছেন যারা, তাদের হৃদপিণ্ড সংক্রান্ত সমস্যার পরিমাণ ৫৯% বেশি থাকে।
এমনটা মনে হতেই পারে যে, কর্মস্থল বাদেও অন্যান্য প্রভাবের কারণে এমনটা হতে পারে। গবেষকেরা এই ব্যাপারটিও নিজেদের গবেষণার আওতায় এনেছেন। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির হৃদপিণ্ডের অবস্থাকে পরিবর্তিত করতে পারে এমন প্রভাবক, এই যেমন- শরীরের ভর এবং ধূমপান করার অভ্যাস ইত্যাদিকেও বিবেচনা করেন। কিন্তু এত কিছু বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কর্মস্থলে হেয় হওয়ার যে প্রভাব সেটিই এক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখে।
ফলে এমনটা বলাই যায়, যদি কর্মস্থলের এই নেতিবাচক ব্যাপারগুলোকে দূর করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে হৃদপিণ্ডজনিত সমস্যার শতকরা ৫% কমিয়ে আনা সম্ভব। চিন্তার কথাটি হচ্ছে, শুধু হৃদপিণ্ড নয়, কর্মস্থলে বুলির শিকার হলে এর ফলে একজন ব্যক্তির টাইপ টু ডায়াবেটিসের পরিমাণও ১.৪৬ শতাংশ বেড়ে যায়। তবে কর্মস্থলকেই এক্ষেত্রে পুরোপুরি দায়ী করা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগে থেকেই মানসিকভাবে দুর্বল থাকার কারণে পরবর্তীতে 'বুলিং' আরো জোরদারভাবে বাজে ছাপ রেখে যায় একজন মানুষের ভেতরে। ইতিমধ্যেই নিজের উপরে যে মানুষটির আত্মবিশ্বাস অনেকটা কম, কর্মস্থলের নেতিবাচক আচরণ এই মানসিকতাকে আরো বেশি কমিয়ে দিতে পারে।
নিজেদের কথাগুলোকে শুধু অনুমান হিসেবে রাখেননি গবেষকেরা। তাদের প্রত্যেকটি কথার পেছনে যথাযথ কিছু কারণ রয়েছে। কীভাবে বুলিং একজন মানুষকে সরাসরি শারীরিক অসুস্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে সেটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তারা। মূলত, কর্মস্থলে নেতিবাচক কোনো আচরণ একজন মানুষের শরীরের স্ট্রেস হরমোনকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে আক্রান্ত মানুষটি অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন শুরু করেন। যার ফলাফল মানুষটির স্বাস্থ্যের উপরেও পড়ে। তবে এ নিয়ে গবেষকেরা ভবিষ্যতেও আরো কাজ করার কথা ভাবছেন।
কর্মস্থলে অনেকেই থাকেন, যারা নিজেরা কোনো বুলির শিকার না হলেও পাশের মানুষটিকে সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে দেখেন এবং চুপ থাকেন। আপনি যদি এমন কেউ হন, তাহলে আপনিও কিন্তু এই ব্যাপারটির বাইরে নন। পাশের কর্মীকে হেয় প্রতিপন্ন হতে দেখলে আপনার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কর্মস্থলে কাউকে মানসিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে দেখলে, তাতে করে পাশের কর্মীটি যদি আগে থেকেই কিছুটা মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হন সবার কাছ থেকে বা কিছুটা হতাশাচ্ছন্ন হন, তাহলে এর ফলে তিনি মানসিকভাবে অনেক বেশি ভেঙে পড়েন এবং ক্ষতির সম্মুখীন হন।
ইতিপূর্বে, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি এবং সিঙ্গাপুরেও এই ব্যাপারে গবেষণা চালানো হয়। এতে দেখানো হয়, বুলির এই ব্যাপারটি শুধু কর্মীর জন্যই নয়, কাজ যিনি দিচ্ছেন তার জন্যও ক্ষতিকর। কারণ, কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়লে বা মানসিকভাবে কর্মবিমুখ হয়ে পড়লে, এর প্রভাব কিন্তু পড়বে প্রতিষ্ঠানের উপরেই।
তাই গবেষকদের মতে, শুধু নিজে আক্রান্ত হলে নয়, অন্য কেউ যদি আপনার পাশে কর্মস্থলে মানসিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন, তাহলে সাথে সাথে এ ব্যাপারে সচেতন হোন, প্রতিবাদ করুন এবং সবাইকে জানান। কারণ, এই আচরণের ফলাফল শুধু আপনি নন, বাকিরাও ভোগ করবে।
অন্যথায়, কর্মস্থলে বুলি করার জন্য সহায়ক একটি পরিবেশ তৈরি হবে। যার ফলাফল যেমন পরবর্তীতে আপনি ভোগ করবেন, তেমনি আপনার পর একই অবস্থানে যারাই আসবে তারাই ভোগ করবে। যেটি মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।
একুশে বইমেলা '২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো - নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে
This article is about bullying in office and its negative effect on our mental and physical health.
Image Source: peoplematters.in