Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হিমোফোবিয়া: রক্ত যখন ভয়ের কারণ

নিজের স্ত্রীকে জন্মবার্ষিকীর সারপ্রাইজ দিয়ে গিয়ে নিজেই যে চমকে যাবে, সেটা ভুলেও ভাবেনি সৈকত (ছদ্মনাম)। কে চিন্তা করতে পেরেছিলো, বেলুনের মধ্যে ঢোকানো লাল রংয়ের তরল দেখে শ্বেতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলবার মতো কান্ড ঘটাবে?

মাত্র কিছু দিন হলো বিয়ে হয়েছে তাদের দুজনের। বিয়ের পরে শ্বেতার এটাই প্রথম জন্মবার্ষিকী। তাই সৈকত ভেবেছিলো শ্বেতাকে না জানিয়েই একটা জমকালো আয়োজন করে চমকে দেবে। সেই মোতাবেক ব্যবস্থাও নিয়েছিলো সে। পুরো ঘর সাজিয়েছিলো বিচিত্র সব বেলুন, কাগজ আর ফিতায়। বেলুনগুলো ভর্তি করা হয়েছিলো নানা রঙের তরল দিয়ে। দিনশেষে ওগুলোই হয়ে দাঁড়ালো বিপত্তির কারণ।

জন্মদিনের কেক কাটা শেষ হওয়া মাত্রই দেয়ালে টাঙানো বেলুনগুলো ফাটাতে শুরু করে ক্ষুদে অতিথিরা। সেগুলোরই একটার ভেতরে ছিলো লাল রং গোলানো পানি। বেলুনটা ফাটতেই ভেতরের তরলগুলো ছিটিয়ে পড়ে চারদিকে। এ দৃশ্য থেকেই চিৎকার করে জ্ঞান হারায় অনুষ্ঠানের মধ্যমণি শ্বেতা।

সাথে সাথে এগিয়ে আসেন অনুষ্ঠানের অতিথি শ্বেতার মামা। জ্ঞান ফেরাতে মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে তিনি সৈকতকে জানান, লাল রঙকে রক্ত ভেবে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটি। সেদিনই সৈকত জানতে পারে, শ্বেতার রয়েছে এক বিচিত্র অসুখ, যার নাম হিমোফোবিয়া বা রক্তভীতি।    

হিমোফোবিয়া কী?

হিমোফোবিয়া শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দাংশ ‘haima’ এবং ‘phobos’ থেকে, যাদের অর্থ যথাক্রমে রক্ত এবং ভয়। অর্থাৎ হিমোফোবিয়ার সহজ সরল অর্থ হলো রক্তকে ভয় পাওয়া। সেই রক্ত হতে পারে নিজের, কিংবা অন্য কোনো মানুষ অথবা পশুপাখির।

যারা এ ফোবিয়ায় আক্রান্ত তারা যে শুধু রক্তকেই ভয় পান তা নয়, রক্ত সম্পর্কিত যেকোনোকিছু দেখলেই তারা আঁতকে ওঠেন। এটি হতে পারে দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট ক্ষতচিহ্ন, ঘাঁ, কাটাছেঁড়া; কিংবা বিভিন্ন বস্তু যেগুলোর সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে, যেমন- সিরিঞ্জ, ইনজেকশন, এবং ছুরিকাঁচি।

শুধু রক্ত নয়, ছুরি-কাঁচি, এমনকি ইনজেকশন দেখলেও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন হিমোফোবিকরা; Image source: wikihow.com

এই অমূলক ভীতির কারণে এসব মানুষের জীবনযাপন দূর্বিষহ হয়ে ওঠে। হাত কেটে যাবে এই ভয়ে গৃহিণীরা ঘরের কাটাকুটিতে ছুরি-বটিতে হাত লাগাতে চান না। ছোট বাচ্চাকাচ্চা, এমনকি অনেক প্রাপ্তবয়স্কের কাছে ইনজেকশন হয়ে দাঁড়ায় এক ভীতির বিষয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের চিকিৎসায়। এই ফোবিয়া প্রভাব ফেলে পেশা নির্বাচনেও। অনেকে তো শুধু রক্ত দেখতে হবে বলে চিকিৎসক হওয়ার আশা ছেড়ে দেন।   

হিমোফোবিয়া ও ইতিহাস

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, রক্তের প্রতি মানুষের ভীতি চিরায়ত। বিভিন্ন সাহিত্যিক কর্মের মধ্যে রক্তকে চিহ্নিত করা হয়েছে ভয়াবহতা, অপরাধ আর ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে।

তাই তো গ্রিক কবি হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যে আমরা দেখতে পাই মহাবীর অ্যাকিলিস বিপক্ষ ট্রোজান সৈন্যদের কচুকাটা করতে করতে এমন অবস্থা করেন যে জলধারা পর্যন্ত লাল হয়ে যায়। আর রক্ত যে অপরাধের চিহ্ন, তা শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকের লেডি ম্যাকবেথের রক্তাক্ত হাত পরিষ্কার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

Image Source: thesun.co.uk

এ কারণে রক্তকে ভয় পাওয়ার বিষয়টি আমাদের মজ্জাগত হয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সমস্যাটা তখনই দেখা দেয়, যখন ক্ষেত্রবিশেষে এই ভয়টা মাত্রাতিরিক্ত ও অমূলক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন কেউ কেউ টমেটো সস দেখেই রক্ত ভেবে আতঁকে ওঠেন।  

কারণ ও রিস্ক ফ্যাক্টর

গবেষকদের মতে, তিন থেকে চার শতাংশ মানুষের রক্ত দেখলে ভয় পেয়ে ওঠার বাতিক রয়েছে। সাধারণত ছেলেরা গড়ে ৯ বছর এবং মেয়েরা সাড়ে ৭ বছর বয়স থেকে রক্তভীতিতে ভুগতে শুরু করে। বেশ কিছু নিয়ামক রয়েছে, যেগুলো হিমোফোবিয়ার জন্য দায়ী। এগুলো হলো:

বংশগতির প্রভাব: অনেকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে রক্তভীতি পেয়ে আসেন।

অনুকরণ: আমরা জানি, সকল ফোবিয়াই কারো না কারো কাছ থেকে শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়। তাই নিজের আশেপাশের মানুষদের রক্তের প্রতি ভয় পেতে দেখলে, নিজের মধ্যেও হিমোফোবিয়া গড়ে ওঠে।

ট্রমাটিক ঘটনা: রক্ত নিয়ে পূর্বে কোনো ট্রমাটিক ঘটনা ঘটে গেলে তা মানুষকে হিমোফোবিয়ার দিকে ধাবিত করে।

উপসর্গ

একজন হিমোফোবিয়াক রক্তের সংস্পর্শে আসলে নিম্নরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকেন।  

শারীরিক উপসর্গ

  • শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া।
  • হৃদকম্পন বেড়ে যাওয়া।
  • মাথা ঘোরানো ও বুকে ব্যথা হওয়া।
  • ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা।
  • বমি বমি ভাবের উদ্রেক ঘটা।
  • শরীর থেকে প্রচুর ঘাম বেয়ে পড়তে থাকা।
রক্ত দেখলে আতঙ্কই হয়ে ওঠে হিমোফোবিকের প্রথম প্রতিক্রিয়া; Image source: betterhelp.com  

মানসিক উপসর্গ

  • প্রচন্ড ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়া।
  • চারপাশ থেকে বিস্মৃত হয়ে পড়া।
  • দেহের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে, এমন অনুভূত হওয়া।
  • এখনই মারা যাবো এমন অনুভূত হওয়া।

যেভাবে দেখা দেয় উপসর্গগুলো

হিমোফোবিকরা রক্ত দেখলে কী প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে সেটি নিয়ে হয়েছে বিস্তর গবেষণা। গবেষকদের মতে, রক্তের প্রতি হিমোফবিকরা মূলত দুই পর্যায়ে সাড়া প্রদান করে থাকে।

একজন হিমোফোবিক যখনই রক্তের সংস্পর্শে আসেন, তখনই রক্তভীতির কারণে তার মধ্যে উচ্চ শারীরিক ও স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে হৃদকম্পন, শ্বাসপ্রশ্বাসের হার ও রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, চোখের মণি বড় হয়ে যাওয়া ও ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলা। মূলত বিভিন্ন উদ্দীপক হরমোনের নিঃসরণ এর জন্য দায়ী।

দ্বিতীয় ধাপে ঘটে উল্টো ঘটনা। যে হরমোনগুলোর কারণে শরীর উদ্দীপ্ত ও উত্তেজিত হয়েছিলো, সেগুলোর নিঃসরণ কমে যেতে শুরু করে। ফলে শরীর ভারী হয়ে আসে, হাতের পেশিগুলোতে বল পাওয়া যায় না, দেহের শারীরবৃত্তীয় ও বিপাকীয় প্রক্রিয়ার গতি কমে যেতে থাকে। রক্ত সরবরাহ কমে যাবার জন্য ব্যক্তি জ্ঞানও হারিয়ে ফেলতে পারেন। দেখা গেছে, হিমোফোবিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশই রক্ত দেখলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

নিরাময় ও প্রতিরোধ

সত্যি বলতে, হিমোফোবিয়া প্রতিরোধে প্রথাগত ওষুধের চাইতে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর মনোবলই বেশি কাজে দেয়। মনে রাখতে হবে, রক্ত কেবল মানবদেহের অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। একে ভয় পাবার কিছুই নেই।

হিমোফোবিয়া নিরাময়ে এক্সপোজার থেরাপি বেশ ফলাফল দিয়ে থাকে। এই থেরাপিতে রোগীকে বারবার রক্তের সংস্পর্শে এনে সেটির সাথে অভ্যস্ত করানো হয়। এতে করে রোগী বুঝতে পারে, রক্ত নিয়ে যে ভয় সে এতদিন পেয়ে আসছিলো, তা নিতান্তই অমূলক। এভাবে তার ভয় ও আতঙ্ক কেটে যায়।

Image Source: NetDoctor

 

কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি এবং রিলাক্সেশন থেরাপি ব্যবহার করে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়াও রক্তভীতি কমিয়ে আনতে অ্যাপ্লাইড টেনশন নামের একটি কসরত কৌশল রয়েছে যেখানে ধাপে ধাপে শরীরের কিছু পেশির সংকোচন ও প্রসারণ করার মাধ্যমে উদ্বেগ কমিয়ে আনা সম্ভব। অ্যাপ্লাইড টেনশন কৌশলটি নিম্নরূপ:

১. বসে পড়ুন। মাথা বনবন করার পরিণতি হতে পারে জ্ঞান হারানো। তাই মাথা বনবন করতে শুরু করলে তাড়াতাড়ি বসে যাওয়া উচিত। না হলে পড়ে গিয়ে আঘাত পেতে পারেন।

২. নিজের হাত দুটোকে পায়ের কাছে নিয়ে আসুন। নিজের মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলুন, যেন কিছু একটা আঁকড়ে ধরে আছেন। এভাবে কমপক্ষে ১০-১৫ সেকেন্ড থাকুন।

৩. দম ফেলুন ধীরে ধীরে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানসিক চাপকে সামলে নিন। হাতের পেশিগুলোকে শিথিল করে ফেলুন।

৪. এরপর পায়ের পাতা দিয়ে ভূমির ওপর চাপ প্রয়োগ করুন। একইসাথে নিজের হাটুকে হাত দিয়ে চেপে ধরুন। একই কথা কনুইজোড়ার জন্যও প্রযোজ্য।

৫. এবার পায়ের পেশিকে শিথিল করে ফেলুন। যেভাবে আছেন, সেভাবেই ১৫-২০ সেকেন্ড যেতে দিন।

৬. নিজের শরীরকে নাড়িয়ে এমন একটি ভঙ্গিমা করুন, যেন আপনি উঠে দাঁড়াতে চলেছেন। এটা অনেকটা দরজায় কলিংবেল বাজলে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানোর মতো।

৭. পুনরায় শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি কমিয়ে আনুন।

৮. এভাবে শরীরের সবগুলো পেশির কসরত সমাপ্ত হলে বুঝে নিন, আপনার সমস্ত শরীর এখন আশঙ্কামুক্ত।

মেন্টাল ডিজঅর্ডার নিয়ে জানতে আজই পড়ুন এই বইটি

১) মেন্টাল ডিসঅর্ডারস

This article is in Bangla language. It discusses about the Hemophobia. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: healthline.com

Related Articles