মানব সভ্যতার প্রাচীন রোগগুলোর একটি ম্যালেরিয়া। ম্যালেরিয়াকে প্রাচীনকালের মানুষেরা ‘দূষিত বায়ু’ বলে ডাকত। ম্যালেরিয়ার নাম এসেছে দুটি ইতালিয় শব্দ থেকে। ইতালিয় ‘mal’ শব্দের অর্থ দূষিত এবং ‘aria’ শব্দের অর্থ বাতাস। ম্যালেরিয়া রোগটি অনেক প্রাচীন হলেও এখনো একটি প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালের পর যদিও এই রোগে মৃত্যুর হার অর্ধেক কমেছে। কিন্তু বর্তমানেও এই হার মোটেও কম নয়।
২০১৫ সালে সারা বিশ্বে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়, যা পুরো পৃথিবীর জনসংখ্যার ৩%। এর মাঝে অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা যায়, যার ৭২% ছিল অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশু। মারা যাওয়াদের ৯০%-ই আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের। যারা মারা যায়নি তাদেরও কষ্টকর জীবন যাপন করতে হয়। উন্নত দেশগুলোতে ম্যালেরিয়া নির্মূল হয়ে গেলেও আফ্রিকা আর দক্ষিণ এশিয়াতে এর বিচরণ এখনো রয়ে গেছে।
ম্যালেরিয়া নির্মূল করার জন্য গবেষকরা কয়েক দশক ধরে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন কোনো উপায় বের করার জন্য। সম্প্রতি তারা আমাদের আশার বাণী শুনিয়েছেন। ম্যালেরিয়া নির্মূল হতে পারে ২০১২ সালে আবিষ্কৃত হওয়া জিন প্রকৌশল প্রযুক্তি CRISPR-Cas9 এর মাধ্যমে। তবে এই প্রযুক্তিতে যেমন রয়েছে সম্ভাবনার দ্বার, তেমনি রয়েছে অনেক শংকাও। এই কারণে এই প্রযুক্তি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে অনেক বিতর্ক।
ম্যালেরিয়া রোগটির সংক্রমণ হয় অ্যানোফিলিস (Anopheles) মশা থেকে। তবে এই মশা সরাসরি ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী নয়। এটি একটি বাহক হিসেবে কাজ করে মাত্র। রোগের মূল উৎস মশার মধ্যে থাকা প্লাজমোডিয়াম (Plasmodium) পরজীবী। তবে এই পরজীবী কেবল স্ত্রী মশার দেহেই থাকে। কারণ স্ত্রী মশাই শুধু মানুষের রক্ত খায়। কারণ তাদের ডিম পাড়ার জন্য প্রোটিনের দরকার হয়, যা রক্ত থেকে পায় তারা। পুরুষ মশারা ফল বা মধু খেয়ে থাকে।
স্ত্রী মশার স্যালাইভারি গ্রন্থিতে থাকে প্লাজমোডিয়ামের স্পোরোজয়েট। মশা যখন কামড় দেয় তখন তার গ্রন্থি থেকে স্পোরোজয়েট মানব দেহে প্রবেশ করে। সেখান থেকে রক্তের মাধ্যমে যকৃত ও লোহিত রক্ত কণিকায় প্রবেশ করে। এতে মানব দেহের লোহিত রক্তকণিকাগুলো ধ্বংস হতে থাকে। মানবদেহে প্লাজমোডিয়ামের অযৌন চক্র ও অ্যানোফিলিসের দেহে যৌন চক্র সম্পন্ন হয়।
তাই ম্যালেরিয়াকে নির্মূল করতে হলে অ্যানোফিলিস মশা ও প্লাজমোডিয়াম পরজীবী দুটিকেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। ম্যালেরিয়া নির্মূল করার জন্য বিজ্ঞানীরা দুটি উপায় বাতলে দিয়েছেন। একটি হচ্ছে অ্যানোফিলিস মশাকে পরজীবী রোধী করে তোলা, অন্যটি হচ্ছে অ্যানোফিলিস মশাকেই বিলুপ্ত করে দেয়া। আর দুটিই করা সম্ভব হবে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে।
জিনগত পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। জীববিজ্ঞানীরা অন্তত ১৮৮৭ সাল থেকেই এর সাথে পরিচিত। প্রাকৃতিকভাবে ‘সেলফিশ জিন’ বা স্বার্থপর জিন এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এই জিনগুলো প্রজনন প্রক্রিয়াকে পরবর্তী প্রজন্মে তাদের বৈশিষ্ট্য রূপান্তরের জন্য ব্যবহার করে। যেসব শুক্রাণু তাদের জিন বহন করে না তাদেরকে সেলফিশ জিনগুলো ধ্বংস করে দেয়, অথবা ডিএনএ-এর প্রতিলিপি তৈরিতে বাধা দেয়। প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেন প্রাকৃতিকভাবে পরিচালিত হওয়া সেলফিশ জিনের বৈশিষ্ট্য মশাবাহিত রোগগুলো নির্মূল করার কাজে লাগাতে।
১৯৬০ সালে জীববিজ্ঞানী জর্জ ক্রেইগ, উইলিয়াম হিকি এবং রবার্ট ভেনডেহি এডিস মশা দিয়ে বাহিত হওয়া রোগগুলো (ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার এবং বর্তমানে জিকা) প্রতিরোধের জন্য সেলফিশ জিনের বৈশিষ্ট্য ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। জীববিজ্ঞানী অস্টিন বার্ট ২০০৩ সালে একে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কাজ শুরু করেন। কিন্তু ২০১২ সালে এসে সব বদলে যায়। দুই নারী গবেষক জেনিফার ডউডনা ও ইমানুয়েল শার্পেন্টার বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেন জিনোম সম্পাদনার নতুন পদ্ধতি ক্রিস্পার-কেস৯ (CRISPR-Cas9)। এটি আগের পদ্ধতিগুলোর চেয়ে তুলনামূক সস্তা এবং দ্রুত কার্যকরী।
মেন্ডেলের সূত্র অনুযায়ী জিন সম্পাদিত মশা আর স্বাভাবিক মশার যৌন মিলনে যে বাচ্চা মশাগুলো জন্ম হবে, তার অর্ধেক হবে মায়ের বৈশিষ্ট্যের এবং বাকি অর্ধেক হবে বাবার বৈশিষ্ট্যের। তবে ক্রিস্পার-কেস৯ প্রযুক্তিতে পরবর্তী প্রজন্মের সকল মশার বৈশিষ্ট্যই হবে পরিবর্তিত জিনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। শুধু মশা নয়, যেকোনো প্রাণীর ক্ষেত্রেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার সম্ভব। তবে মশা, ইঁদুর বা ছোট পোকামাকড় যাদের আয়ু কম তাদের ক্ষেত্রেই এটি দ্রুত কাজ করে। মানুষ বা হাতির মতো প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি কাজ করতে শত বছর লেগে যেতে পারে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা ঘোষণা দেন, তারা গবেষণাগারে Anopheles stephensi মশার দুই প্রজন্মকে ক্রিস্পার প্রযুক্তির মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোধী করতে পেরেছেন। এতে মশার সাদা চোখের জায়গায় লাল চোখের বৈশিষ্ট্যও দেয়া হয়। এতে তৃতীয় প্রজন্মের ৩৮৯৪টি মশার মধ্যে ৩৮৬৯টি মশাতেই থাকে ম্যালেরিয়া রোধী জিন, যা প্রায় ৯৯.৫ শতাংশ! তবে এই পদ্ধতিতে প্লাজমোডিয়াম পরজীবীও নিজেকে অভিযোজিত করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। তাই অনেক বিজ্ঞানীরা চাইছেন অ্যানোফিলিস মশাকেই বিলুপ্ত করে দিতে। আর এতেও ব্যবহৃত হবে ক্রিস্পার প্রযুক্তি।
অ্যানোফিলিস মশা বিলুপ্ত করার জন্য কাজ করছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান টার্গেট ম্যালেরিয়া (Target Malaria), যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। এছাড়া টার্গেট ম্যালেরিয়ার সাথে রয়েছে আফ্রিকার বারকিনা ফ্যাসো, মালি, উগান্ডা ও ঘানার কিছু প্রতিষ্ঠান। টার্গেট ম্যালেরিয়ার তত্বাবধানে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারে চলছে অ্যানোফিলিস মশা বিলুপ্তের গবেষণা। তার মধ্যে একটি লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজ। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের গবেষকরা জানান, তারা গবেষণাগারে ৭-১১ প্রজন্মের মধ্যে সব অ্যানোফিলিস বিলুপ্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
মশা বিলুপ্ত করার জন্য দুই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। একটি হচ্ছে পুরুষ মশার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া, অন্যটি হচ্ছে স্ত্রী মশাকে প্রজননে অক্ষম করে তোলা। দুই পদ্ধতিতেই ফলাফল একই আসবে, অর্থাৎ মশা বিলুপ্ত হবে। ইতালির টার্নিতেও এই গবেষণা চলছে। সেখানের গবেষকরা মশাগুলোর জিন এমনভাবে সম্পাদনা করছেন, যেন পরবর্তী প্রজন্মের স্ত্রী মশাদের বৈশিষ্ট্য অনেকটা পুরুষ মশাদের মতো হয়। তাদের মুখগুলো অনেকটা পুরুষ মশাদের মতো করা হয়। এতে তারা মানুষকে কামড় দেয়ার ক্ষমতা হারাবে এবং প্লাজমোডিয়ামকে মানবদেহে সংক্রমিত করতে পারবে না। এছাড়া তাদের জননাঙ্গতেও পরিবর্তন নিয়ে আসবে যেন তারা ডিম পাড়তে না পারে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে সব মশাই কি বিলুপ্ত করা হবে? মশা বিলুপ্ত হলে পরিবেশ বা বাস্তুসংস্থানের ওপর এর প্রভাব কতটা? বর্তমানে পৃথিবীতে ৩,৫০০ প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকটি প্রজাতি রোগ বহন করে। ম্যালেরিয়া নির্মূল করার জন্য গবেষকরা কেবল তিনটি প্রজাতির মশাকে বিলুপ্ত করতে চাইছেন। এরা হচ্ছে Anopheles gambiae, Anopheles coluzzii এবং Anopheles arabiensis প্রজাতিগুলো।
পরিবেশবাদীরা আশংকা করছেন এতে বাস্তুসংস্থানের ওপর বাজে প্রভাব পড়তে পারে। ইটিসি গ্রুপ এবং ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান জিন সম্পাদনা প্রযুক্তির বিরোধীতা করে আসছে। তবে গবেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা এমন কোনো প্রজাতি খুঁজে পাননি যেটা খাবারের জন্য শুধু অ্যানোফিলিস মশার ওপর নির্ভর করে। তাই এটি বিলুপ্ত হলেও পরিবেশের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না।
তবে বিতর্ক তাতেও থামছে না। টার্গেট ম্যালেরিয়ার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর গবেষণা ও উন্নয়ন অংশ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ডারপা (DARPA)-ও আছে। এটিকে উদ্দেশ্য করে অনেকে এই প্রযুক্তিকে সামরিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার আশংকা করছেন। ক্রিস্পার প্রযুক্তি দিয়ে যেমন কোনো জীবের খারাপ বৈশিষ্ট্য দূর করা সম্ভব, তেমনি ভালো বৈশিষ্ট্যগুলোও দূর করা হতে পারে এটি দিয়ে। সন্ত্রাসীদের হাতে পড়লেও একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সম্ভাবনা প্রবল।
আফ্রিকান সচেতন নাগরিকরাও শংকা প্রকাশ করেছেন। তারা সমালোচনা করছেন, উন্নত দেশগুলো আফ্রিকাকে একটি গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহার করে এর জনগণের বিপদের কথা চিন্তা না করেই। এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নে কারা নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে ধনী দেশের বিজ্ঞানীরা, আর বাস্তবায়ন করা হবে আফ্রিকার গরিব মানুষদের ওপর। গবেষকরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আফ্রিকান জনগণের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন তারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করবে কি না।
জিন প্রযুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি আফ্রিকায়। সেখানের গরিব দেশগুলোতে সরকার ব্যবস্থা খুবই অস্থিতিশীল। এই অবস্থায় তারা কতটা সফলভাবে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারবে তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান।
তবে গবেষকরা প্রযুক্তি ব্যবহারে বছরে প্রায় ৭ লাখ মানুষের জীবন বেঁচে যাওয়াটাই বড় করে দেখছেন। তাই প্রযুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা, সাংবাদিকদের মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে জনগণের মনে আতংক না ছড়ানো এবং যাদের জন্য কাজ করা হবে জিন পরিবর্তন করা মশাগুলো ছাড়ার আগে সেই আফ্রিকান জনগণদের অনুমতি নিয়ে কাজ করাকে আদর্শ পন্থা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি বাস্তবায়ন এখনো অনেক সময়ের ব্যাপার। ম্যালেরিয়া নির্মূল সফল হলে একইভাবে হয়তো ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার, জিকা ভাইরাসও নির্মূল করা সম্ভব হবে।
This is a Bangla article written about malaria disease. It is about how genetically modified mosquitoes can eradicate malaria and save millions of lives.
Featured Image: HUGH STURROCK/WELLCOME IMAGES
References:
1. Vox
2. NPR
3. The Guardian
4. TED Talk