আমাদের মস্তিষ্ক জন্মের আগে থেকেই প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিনের সব রকমের তথ্য এখানে জমা হচ্ছে। বলা হয়, মানবমস্তিষ্কের তথ্য ধারণক্ষমতা ২.৫ পেটাবাইট। অন্য কথায়, ১ মিলিয়ন গিগাবাইট! এই সুবিশাল তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি আমাদের মস্তিষ্ক শরীরের অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনাতেও কাজ করে থাকে। সব কাজ ঠিকভাবে পরিচালনা করতে গিয়ে মস্তিষ্ককে পরিশ্রম কিন্তু কম করতে হয় না। তবে মস্তিষ্কের পরিশ্রম যত বেশি হয়, এর কার্যকারিতাও তত বৃদ্ধি পায়।
পরিশ্রমের কারণে মস্তিষ্কের শান বাড়ে এ কথা যেমন সত্য, সেইসাথে এ কথাও সত্য যে বয়সের সাথে সাথে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমতেও থাকে। আবার প্রতিনিয়ত কাজ করে যাওয়ার ফলে আমাদের মস্তিষ্ক ক্রমশ দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন মস্তিষ্কের দরকার পড়ে একটু বিশ্রামের। মস্তিষ্কের ৬টি অংশ মূলত তথ্য মনে রাখার জন্য দায়ী- ১. ফ্রন্টাল লোব, ২. প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স, ৩. টেম্পোরাল লোব, ৪. মেডিয়াল টেম্পোরাল লোব, ৫. হিপোক্যাম্পাস এবং ৬. ব্যাসাল গ্যাংলিয়া সিস্টেম।
বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার সাথে সাথে মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি এই অংশগুলোও ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একটি নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর এগুলো আবার দুর্বল হতে শুরু করে। সাধারণত ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মানুষের মস্তিষ্ক শক্তিশালী হতে থাকে। এরপর থেকে সময়ের সাথে সাথে মস্তিষ্ক দুর্বল হতে থাকে। দেখা যায় যে, বয়স্ক লোকেরা অনেক তথ্যই মনে রাখতে পারে না, যেটি তরুণরা খুব সহজেই মনে করতে পারে। তবে তরুণদের ক্ষেত্রেও তথ্য ঠিকমতো মনে রাখতে সমস্যা যে হয় না, তা কিন্তু নয়।
মস্তিষ্কের জন্য এমন কিছু ব্যায়াম আছে যেগুলো নিয়মিত চর্চা করলে সহজেই আপনার মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে নিতে পারেন এবং সেইসাথে মস্তিষ্ক যথাসম্ভব কার্যকর করে রাখতে পারবেন। এমনই কিছু ব্যায়াম এবং কৌশলের কথাই আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
পড়ার সময় তা শোনার চেষ্টা করুন
কোনো কিছু পড়ার পাশাপাশি যদি তা শোনার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে পড়াটি বেশি সময় ধরে মনে থাকে। যাদের জোরে পড়ার অভ্যাস রয়েছে তাদের বেশিরভাগেরই পড়া বেশি সময় ধরে মনে থাকে বলে দেখা যায়। ছোটবেলায় অনেকের বাসাতেই জোরে শব্দ করে না পড়লে বাবা-মা কথা শোনাতো। আবার স্কুলে পড়ার সময় জোরে শব্দ করে পড়লে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতে হতো, যাতে শব্দ না করা হয়। সে যা-ই হোক, শব্দ করে পড়লে যেকোনো পড়া যে অধিক সময় ধরে মনে থাকে, তা সর্বজনস্বীকৃত।
ন্যাচারাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ কাউন্সিল অফ কানাডার অর্থায়নে ২০১১ সালে একটি গবেষণা সম্পন্ন হয়। সেখানে দেখা যায়, যারা জোরে শব্দ করে পড়ে কিংবা পড়ার সময় শ্রবণের সাহায্য নেয়, তারা ৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রে সেই পড়া অধিক মনে রাখতে পারে।
স্কুলের শিশুদের ক্লাসে পড়ানোর সময় শিক্ষককে পরামর্শ দেয়া হয় বই থেকে কোনো কিছু পড়ানোর সময় তিনি যাতে সেই পড়া নিজে উচ্চারণ করে শিশুদের শোনান। এতে শিশুরা পড়ার পাশাপাশি কান দিয়েও সেই পড়া শোনার ফলে অধিক সময় ধরে পড়াটি তাদের মস্তিষ্কে স্থায়ী হয়। একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন আপনার দুর্বল হয়ে পড়া মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে।
সবসময় একই রাস্তা ব্যবহার না করে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করুন
আমাদের অনেকেরই বাসা থেকে অফিস কিংবা স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় বা এমন কোনো জায়গা আছে, যেখানে সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই যাতায়াত করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা প্রতিদিন একই রাস্তা ব্যবহার করি। কারণ এতেই আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু সপ্তাহের একদিন কিংবা দুদিন যদি আমরা ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করি গন্তব্যে যাওয়ার জন্য, তাহলে এটি আমাদের মস্তিষ্ককে নতুন করে সঞ্চালন করতে সাহায্য করবে। আমাদের মস্তিষ্ক একই বিষয় নিয়ে বারবার কাজ করতে থাকলে ক্রমশই ক্লান্ত হয় পড়ে। এজন্য মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্য মাঝে মধ্যে একই কাজ একটু ভিন্নভাবে করতে হয়।
শুধু রাস্তা পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যাপারেই না, প্রতিদিনকার সকলে কাজের জন্যই এটি সত্য। একই পদ্ধতি বারবার ব্যবহার করার ফলে আমাদের মস্তিষ্ক নতুন কোনো পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে বেশ আলসেমি বোধ করে। তাই আমরা জোর করে যদি নতুন কোনো পদ্ধতির সাথে আমাদের মস্তিষ্ককে পরিচিত করিয়ে দিই, তাহলে নতুন কোনো তথ্য নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। নতুনভাবে কোনো তথ্য গ্রহণ করার ফলে আমাদের মস্তিষ্ক আগের চেয়ে অধিক সচল হয়ে ওঠে।
নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করুন
নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার মানেই হলো নতুন ধারণা এবং নতুন চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়া। আমরা অনেকেই আমাদের আশেপাশের মানুষজনের বাইরে নতুন কারোর সাথে পরিচিত হতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। কিন্তু নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এটি আমাদের জন্য নতুন রাস্তা খুলে দেয়।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের মতো আমাদের মস্তিষ্কের ভালোর জন্যও নতুন মানুষ তথা নতুন চিন্তা ও ধারণার সাথে পরিচিত হওয়া জরুরি। আমরা যতই নতুন ধারণার সাথে পরিচিত হবো, তত সুযোগ পাবো আমাদের চিন্তার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করার। এটি আমাদের মস্তিষ্ককে প্রতিনিয়ত সচল থাকতে সাহায্য করবে।
প্রতিদিন একটি শখের কাজ করার চেষ্টা করুন
ছোটবেলায় 'আমার শখ' নিয়ে কত রচনাই না লিখতে হয়; কিন্তু, বড় হওয়ার পর অনেকেই দৈনন্দিন কাজের চাপে আর শখের কাজটি করার সুযোগ পান না। কিন্তু একটি শখ রাখা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। শখ হিসেবে বাগান করা, বই পড়া কিংবা কোনো দুষ্প্রাপ্য বস্তু সংগ্রহ করা যেটিই হোক না কেন, আমাদের মানসিক প্রশান্তি এবং মস্তিষ্ককে একধরনের বিশ্রামের মধ্যে রাখতে সাহায্য করবে। শখের কাজ করার বেলায় আমাদের মস্তিষ্ক কাজের মধ্যে থাকলেও সেটি আমাদের মনে একপ্রকার মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে।
নিয়মিত ধাঁধা মেলানোর খেলা খেলুন
আপনার মস্তিষ্ককে যত বেশি নতুন পরিস্থিতি ও সমস্যার সামনে ফেলবেন, আপনার মস্তিষ্ক তত বেশি কার্যকর ও তুখোড় জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে উঠবে। এজন্য প্রতিদিনের পত্রিকা থেকে সুডোকু, শব্দ মেলানোর খেলাগুলো খেলতে পারেন। এছাড়া অন্যান্য বোর্ড এবং কার্ড গেমস আছে, যা আপনার মস্তিষ্কে শান দিতে সাহায্য করবে। অনলাইনে বেশ কিছু ব্রেইন ট্রেনিং গেইম পাওয়া যায়। এগুলো আপনাকে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে আপনার মস্তিষ্কের উন্নতি এবং অবস্থার সম্পর্কে জানান দেবে।
এরকম বেশ কয়েকটি কাজ প্রতিনিয়ত চর্চা করে গেলে আপনার মস্তিষ্কের কার্যকরী দক্ষতা তুলনামূলক বৃদ্ধি পাবে এবং আপনার যেকোনো তথ্য মনে রাখার ক্ষমতাও বেড়ে যাবে।
This is a Bengali article based on how someone can train his/her brain.
Featured image: The Garda Retired Post – Ireland
References: Hyperlinked in the main article.