Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেমন ছিল প্রাচীনকালের দাঁতের চিকিৎসা?

আজকাল দাঁতের যত্নের কত বিচিত্র সব পণ্যের বিজ্ঞাপনই না আমরা দেখতে পাই। কোনোটি দাঁতকে ঝকঝকে সাদা করে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়, কোনোটি দেয় নিঃশ্বাসে সজীবতা, কোনোটি জীবাণু থেকে সুরক্ষা, আবার কোনোটি সুরক্ষিত রাখে দাঁতের মাড়িকে। দাঁতের যত্নে এমন বহুবিধ গুণাগুণসম্পন্ন পণ্য ব্যবহারের পরেও আমাদের দাঁতে সমস্যা কিন্তু দেখা দিতেই থাকে। আর তখনই চিকিৎসা নিতে ছুটতে হয় দন্তচিকিৎসকের কাছে। নিজের দক্ষতার পাশাপাশি অত্যাধুনিক সব উপকরণ ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে আমাদের দাঁত ও মুখকে তারা সুস্থ করে তোলেন।

কিন্তু প্রাচীনকালে, যখন ঔষধশিল্প, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি- কোনোটিরই তেমন বিকাশ ঘটেনি, তখন কি মানুষের দাঁত বা মুখগহ্বরে রোগবালাই দেখা দিতো না? তখন তারা রোগের যন্ত্রণার উপশম করতো কীভাবে? তখনকার সমাজেও কি দন্তচিকিৎসক ছিল? আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া কী করে তাদের পক্ষে মানুষের রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব হতো? এসব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে আজকের এই আয়োজনে।

মানবসভ্যতার আদিকাল থেকেই দন্তচিকিৎসাবিদ্যার চর্চা হয়ে আসছে; Source: Pinterest

পাঠক, জেনে অবাক হবেন যে, যদিও আমাদের পূর্বপুরুষরা দাঁতের যত্নে আধুনিক, নামীদামী ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহারের সুযোগ পাননি, তথাপি তাদের দাঁত ও মুখগহ্বর আমাদের তুলনায় বিস্ময়কর রকমের সুস্থ ও নীরোগ ছিল। সাম্প্রতিককালে ডেন্টাল ক্যারিজ বা দাঁতের ক্ষয়রোগের যে প্রবণতা দেখা যায়, তখনকার সময় তা এত প্রকট ছিল না। এর পেছনে অবশ্য তাদের স্বাস্থ্যকর এবং নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। আধুনিককালের দন্তচিকিৎসকগণ সুস্থ দাঁতের জন্য হরহামেশাই যেমন খাদ্যতালিকা অনুসরণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, ঠিক তেমন খাদ্যতালিকাই প্রচলিত ছিল মধ্যযুগে। বিভিন্ন ধরনের ফল, সবজি, শস্যদানা আর ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ দুগ্ধজাত পণ্য- এগুলোই ছিল তখনকার মূল খাবার। চিনির দাম বেশ চড়া হওয়ায় সে সময় চিনি মোটামুটি বিলাসদ্রব্যের পর্যায়েই পড়তো। জনসাধারণ মিষ্টি খাবার তৈরিতে চিনির পরিবর্তে মধু ও ফলের রস ব্যবহার করতো, তা-ও কদাচিৎ। ফলে তাদের দাঁতে গর্ত বা ক্যাভিটি হতো না বললেই চলে। কালক্রমে চিনির উৎপাদন ও ব্যবহার যেমন বিস্তৃতি লাভ করেছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের দাঁতের রোগ।

চলুন পাঠক, এবার প্রাচীন কিছু সভ্যতার সময়কাল থেকে তাদের দাঁতের রোগ ও তৎকালীন চিকিৎসা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা যাক।

মিশরীয় সভ্যতায় দন্তচিকিৎসা

খননকার্যের মাধ্যমে মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কিত তথ্য উদঘাটনের সময় তৎকালীন মানুষদের মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, জীবদ্দশাতেই তাদের অধিকাংশের দাঁত ভীষণভাবে ক্ষয়ে গিয়েছিল। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে তাদের নিম্নমানের খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী বলে মনে করা হয়। তাদের খাদ্যতালিকায় ভিটামিন ও খনিজের অভাব তো ছিলই, উপরন্তু তারা যে রুটি খেতো, তাতে ভুসি, খড় এমনকি পাথর ও ধূলিকণাও মিশে থাকতো। খাবারের সাথে এ ধরণের ধারালো, শক্ত পদার্থ চিবানোর কারণে তাদের দাঁত খুব দ্রুত ক্ষয়ে যেত। এছাড়া মরুভূমির ধূলিময় পরিবেশেরও এক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

১৫০০ বছরের পুরনো মমিকৃত মিসরীয় অধিবাসীর দাঁতে ক্ষয় এবং গর্ত দেখা যাচ্ছে; Source: Nature

মিসরীয় দন্তচিকিৎসকগণের লিপিবদ্ধ করা তথ্য থেকে জানা যায় যে, তাদেরকে সেসময় দাঁতের গোড়ায় পুঁজ জমা, দাঁতের পাথর, মাড়ির রোগ, পেরিওডন্টাল লিগামেন্টের প্রদাহ, চোয়ালের হাড়ের সমস্যা, নড়ে যাওয়া দাঁত, মুখের ভেতরের ক্ষত ও ঘা, এমনকি দাঁতের সংক্রমণ থেকে ছড়িয়ে পড়া বিষক্রিয়ার চিকিৎসাও করতে হয়েছে।

মিসরীয় সভ্যতায় প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতিসমূহের সংকলন ‘এবার’স প্যাপাইরাস’-এ সে সময়কার দন্তচিকিৎসার এগারোটি পন্থা তুলে ধরে হয়েছে। যার একটিতে নড়বড়ে দাঁতের চিকিৎসায় ‘ফিলিং’ এর ব্যবহার দেখা যায়। এই ‘ফিলিং’ তৈরিতে ব্যবহার করা হতো বার্লি, মধু আর অ্যান্টিসেপটিক। এরপর তা দিয়ে নড়ে যাওয়া দাঁতে ফিলিং দেওয়া হতো অথবা দাঁতটিকে তার সকেটের হাড়ের সঙ্গে আটকে স্থির করে দেওয়ার চেষ্টা করা হতো। শুধু তা-ই নয়, এরপর রোগীকে ব্যথা ও প্রদাহ কমার জন্যে, দাঁত ও মুখ সুস্থ রাখার জন্যে বিভিন্ন সিরাপ এবং মাউথওয়াশও ব্যবহার করতে হতো। এছাড়াও মধু, গিরিমাটি ও গমের চূর্ণের মিশ্রণ, জিরা, ফল ও ভেষজ উপাদানের মিশ্রণ, কিংবা শুধু কাপড়ের টুকরোকেও ফিলিং হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

তৎকালীন চিকিৎসা কেবল ভেষজ ওষুধপথ্য দিয়ে রোগ সারানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, দাঁতে জমা হওয়া পুঁজ ড্রিল করে বের করাসহ মাড়ি এবং চোয়ালের নিখুঁত সব অস্ত্রোপচারও করতেন সে সময়কার দন্তচিকিৎসকগণ। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালেই মুখগহ্বরের অস্ত্রোপচারে ফরসেপ, স্কালপেলসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবহার হতো

আধুনিককালে দাঁত পড়ে গেলে যেমন ব্রিজ করে দাঁত প্রতিস্থাপন করা হয়, প্রাচীন মিশরে প্রায় সে ধরণের চিকিৎসারও তিনটি নিদর্শন পাওয়া গেছে। পড়ে যাওয়া দাঁতকে ফুটো করে, স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত তার দিয়ে সেটিকে পাশের সুস্থ দাঁতের সঙ্গে বেঁধে রাখতে দেখা গেছে এসব নিদর্শনে। এর কোনোটিতে রোগীর নিজের পড়ে যাওয়া দাঁতটিই ব্যবহার করা হয়েছে, আর কোনোটিতে সংগৃহীত দাঁত কাজে লাগানো হয়েছে। তবে এই চিকিৎসা রোগীর জীবদ্দশায়ই করা হয়েছিল, নাকি তার সৎকারের সময় তাকে নিখুঁত করে তোলার জন্যে করা হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।

পড়ে যাওয়া যাওয়া দাঁত বাঁধানোর মিসরীয় নিদর্শন; Source: MINT dentistry Talks

মায়া সভ্যতায় দন্তচিকিৎসা

মায়ানরা দাঁতে ফিলিং করা, পাথর পরিস্কার করা এবং দাঁত তোলার কাজে পারদর্শী ছিল। এই প্রতিটি কাজের জন্যে তাদের বিশেষ যন্ত্রপাতি ছিল এবং প্রতিটি চিকিৎসা ও যন্ত্রের তারা আলাদা আলাদা নামও দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্রত্নতত্ত্ববিদগণ হন্ডুরাসে মায়ান সভ্যতার পুরাতন নিদর্শনের মধ্যে চোয়ালের হাড়ে ঝিনুক ব্যবহার করে দাঁতের ইমপ্ল্যান্ট করার প্রমাণ পেয়েছেন। এবং অবাক করা ব্যাপার এই যে, দাঁতের ইমপ্ল্যান্ট  দৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী হতে হলে চোয়ালের হাড়ের সঙ্গে ইমপ্ল্যান্টের যে বিশেষ বন্ধন (osseointegration) তৈরি হওয়া আবশ্যক, মায়ানদের তৈরি করা ঝিনুক ইমপ্ল্যান্ট ও হাড়ের মধ্যে এই বন্ধন অনেকাংশেই গড়ে উঠেছিল

দাঁতের সুস্থতার পাশাপাশি এর সৌন্দর্যবৃদ্ধিতেও তাদের চেষ্টার কমতি ছিল না। অনেকেই দাঁতকে অলংকরণের উদ্দেশ্যে দাঁতে ছোট গর্ত করে তাতে মূল্যবান পাথর বসাতো। এছাড়াও মায়ান মহিলারা নিজেদের হাসিকে ভিন্নরূপে তুলে ধরার জন্যে তাদের দাঁতকে লাল বা কালো রংয়ে রাঙাতো। কেউ আবার দাঁতকে ঘষে সূঁচালো আকার দিতেও পছন্দ করতো

দাঁতে পাথর বসিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের মায়ান নিদর্শন; Source: Wikimedia Commons

গ্রিক সভ্যতায় দন্তচিকিৎসা

গ্রিকরা নিজেদের শক্তিশালী ও নিখুঁত সুন্দর ভাবমূর্তি বজায় রাখতে বেশ সচেষ্ট ছিল। ব্যথা, বেদনা, অসুস্থতা প্রকাশ করা এবং চিকিৎসা নেওয়া তাদের কাছে ছিল দুর্বলতার লক্ষণ! ফলে তারা অনেকেই দাঁত বা মুখে কোনো রোগ দেখা দিলে তার চিকিৎসা করানোর বদলে রোগযন্ত্রণা ভোগ করে নিজেকে নিখুঁত হিসেবে জাহির করাকেই শ্রেয়তর মনে করতো।

দাঁতের রোগ থেকে মৃত্যু হতে পারে- ব্যাপারটা অস্বাভাবিক শোনালেও, প্রত্নতত্ত্ববিদরা গ্রিক শাসনামলের একটি মমিকৃত মিশরীয় মৃতদেহে ঠিক এমনই লক্ষণ দেখতে পেয়েছেন। ২০ কি ৩০ বছর বয়সী, নাম না জানা, ধনী এই তরুণ তার জীবনের শেষ সময়ে অনেকগুলো দাঁতে গর্ত, পুঁজ ও যন্ত্রণাদায়ক সংক্রমণে ভুগেছিল বলে জানা যায়। সিটি স্ক্যান পরীক্ষায় দেখা যায়, তার ওপরের পাটির দুই দাঁতের মাঝে তৈরি হওয়া গর্তে ডুমুরের রস বা সিডারের তেলে ভেজানো কাপড় দিয়ে দাঁতে খাবার জমা প্রতিরোধ এবং ব্যথা উপশমেরও চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে দুঃখজনকভাবে চিকিৎসার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই দাঁতের সেই সংক্রমণ তার সাইনাসে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং এতেই তার মৃত্যু ঘটে বলে ধারণা করা হয়

দাঁতের মারাত্মক সংক্রমণে ভুগে মৃত্যুবরণ করা তরুণের চোয়ালের হাড় ও রোগাক্রান্ত দাঁত; Source: Huffington Post

খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৩০০ সালের মধ্যে গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটস এবং বিজ্ঞানী ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল- উভয়েই দাঁতের চিকিৎসা বিষয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। দাঁত ওঠার প্রক্রিয়া, দাঁতের গর্তের চিকিৎসা, মাড়ির রোগ, দাঁত তোলা, ভাঙা চোয়াল বা নড়বড়ে দাঁতকে তার দিয়ে বেঁধে পূর্বের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা- এমন অনেক চিকিৎসার কথা উঠে এসেছিল তাদের লেখনীতে। চিকিৎসার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে সময় হিপোক্রেটসের নির্দেশিত নিয়মই অনুসরণ করা হতো।

দ্বিতীয় পর্ব: প্রাচীনকালের দাঁতের চিকিৎসার ইতিবৃত্ত

ফিচার ইমেজ: British Dental Association Museum

Related Articles