Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য

১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মালয়েশিয়ায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রথম সনাক্ত করা হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুরেও রোগটি সনাক্ত করা হয়। নিপাহ ভাইরাস হচ্ছে Paramyxoviridae গোত্রের অন্তর্ভূক্ত গণ Henipavirus এর অন্তর্গত। এটি একটি আরএনএ ভাইরাস। মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ গ্রামে প্রথম সনাক্ত করা হয় বলে ভাইরাসটির নামকরণ করা হয় নিপাহ ভাইরাস। ভাইরাসটি ড. কো বিং চুয়া আবিষ্কার করেন।

নিপাহ ভাইরাসের গঠনশৈলী; Source: id-hub.com

প্রথম যখন সনাক্ত করা হয় তখন নিপাহ ভাইরাস দ্বারা প্রায় ৩০০ জন লোক আক্রান্ত হয়েছিল। যাদের মধ্যে ১০০ জন রোগী মারা গিয়েছিল। রোগের ভয়াবহতা এতটাই মারাত্মক ছিল যে, এই ভাইরাসের প্রদুর্ভাব ঠেকাতে সে সময় ১০ লক্ষ শূকরকে ইউথ্যানেশিয়া বা ব্যথামুক্ত মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিল। সে সময় মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ গ্রামে এভাবেই একজন খামারী শূকর মেরে ফেলছেন (ইউথ্যানেশিয়া নয়) © Reuters/ibtimes.com

বাংলাদেশে ২০০১ সালে নিপাহ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল কুষ্টিয়া জেলায়। এরপর ২০০৩-২০০৫ সালেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৩ সালে প্রকাশিত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের ১৩টি জেলায় এই রোগ সনাক্ত করা হয়েছিল। জেলাগুলো হচ্ছে গাইবান্ধা, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নওগা, নাটোর, নীলফামারী, পাবনা, রাজবাড়ী, রাজশাহী। এসব জেলার ৮ মাস থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। তবে এসব জেলা ছাড়াও এই রোগ আরও কয়েকটি জেলায় ছড়ানোরও কথা জানা যায়।

পূর্বে বাংলাদেশ ও ভারতে নিপাহ ভাইরাসের হানাদারি; Source: anandabazar.com

বাংলাদেশের ন্যায় ভারতেও নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী প্রথম সনাক্ত করা হয়েছিল ২০০১ সালে। তখন শিলিগুড়ি শহরে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে মোট আক্রান্ত হয়েছিল ৬৫ জন। যার মধ্যে ৪৫ জন মৃত্যুবরণ করেছিল। এই ঘটনার ৬ বছর পর ২০০৭ সালে আবারও নদীয়ায় ৫ জন রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। আক্রান্তদের সকলেই মারা যায়।

মৃত্যুর পূর্বে স্বামীর কাছে লেখা লিনি পুথুসারির শেষ কথা; Source: storypick.com

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কথা কমবেশি শোনা যায়। তবে এ বছর নিপাহ ভাইরাস অনেকটাই আলোচনার বাইরে ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরালায় নতুন করে এই রোগ দেখা দেওয়ায় আবারও ভারতের প্রায় সর্বত্রই সতর্কতা জারী করা হয়েছে। ফলে নতুন করে এই রোগ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের।

কোঝিকোড় জেলার পেরাম্বারায় একটি বাড়ি থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে কেরালার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ধারণা করছে। ইতিমধ্যে এ বছর ভারতে ১২ জনের মৃত্যুর কথা জানা গেলেও নিশ্চিতভাবে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। এ সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশংঙ্কা করা হচ্ছে। মৃতদের মাঝে সর্বাধিক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন ৩১ বছর বয়সী সেবিকা লিনি পুথুসারি। ‍যিনি কোঝিকোড়ের ‘পেরাম্বারা তালুক’ নামের একটি হাসপাতালে নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সেবা করছিলেন।

নিপাহ ভাইরাস ছড়ানোর উপায়; Source: anandabazar.com

নিপাহ ভাইরাস এক ধরনের জুনোটিক ভাইরাস। জুনোটিক ভাইরাস হচ্ছে সেই সকল ভাইরাস যারা প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে রোগ ছড়াতে পারে। নিপাহ ভাইরাসের প্রাথমিক বাহক হচ্ছে বাদুড়। আর ইন্টারমিডিয়েট বা মধ্যবর্তী বাহক হচ্ছে শূকর। শূকর ছাড়াও কুকুর, বিড়াল, ছাগল, ঘোড়া এবং ভেড়াও মধ্যবর্তী বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে বলে জানা যায়। এ সময় মধ্যবর্তী বাহকগুলোতে রোগের উপসর্গ দেখা যেতে পারে। আক্রান্ত প্রাণী থেকে নানাভাবে মানুষের মাঝে ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করে থাকে। আবার অসুস্থ মানুষ থেকে মানুষেও এই ভাইরাস ছড়ায়।

মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রথম যখন এই ভাইরাস আক্রান্ত রোগী হিসেবে যাদের সনাক্ত করা হয় তারা সকলেই শূকরের খামারে কাজ করছিলেন। সেসময় অসুস্থ শূকর থেকে সুস্থ মানুষগুলো রোগাক্রান্ত হয়েছিল। বাংলাদেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়েছিল কাঁচা খেজুরের রস পান করার মাধ্যমে। আর ভারতে এ বছর রোগটি ছড়িয়েছে আংশিক বাদুড়ে খাওয়া আম থেকে।

পাত্র ঢেকে রস সংগ্রহ না করলে খেজুর রসে বাদুড় মুখ দিতে পারে; Source: npr.org

সাধারণত বাদুড়ের লালা, মলমূত্র, শ্বাস-প্রশ্বাস ও সংস্পর্ষের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে থাকে। বাদুড় যখন খেজুর গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস পান করে তখন ভাইরাস কাঁচা খেজুর রসে বংশবৃদ্ধি করে। পরবর্তীতে এই রস পান করার মাধ্যমে মানুষ নিপাহ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। আবার আক্রান্ত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষেও ভাইরাসটি রোগের সৃষ্টি করতে পারে।

নিপাহ ভাইরাস বাদুড়ে থাকার সময় বাদুড়ে কোনো প্রকার রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায় না। কিন্তু ভাইরাস মানবদেহ ও শূকরসহ অন্যান্য মধ্যবর্তী বাহকে প্রবেশ করলে ৭-১৪ দিনের মধ্যে নানারকম রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। নিপাহ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে সাধারণত মানুষের মাঝে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় তা হচ্ছে –

১. ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সর্দি-জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

২. আক্রান্ত ব্যক্তি জ্বরে ভোগেন।

৩. গলা ব্যথা, মাথা ধরা শুরু হয়।

৪. রোগীর বমি হয় এবং মাংসপেশী ব্যথা করে।

৫. যদি সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকে তবে শ্বাসযন্ত্রে মৃদু থেকে মারাত্মক প্রদাহ হয়। তখন মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয়। এভাবে নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ প্রকাশ পায়।

৬. রোগ সংক্রমণের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেলে মস্তিষ্কের কোষ ও কলায় প্রদাহ হয়। ফলে ঝিমুনি, মাথা ঘোরা, অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং স্নায়ুবিক নানা প্রকার উপসর্গ প্রকাশ পায়।

৭. পরিশেষে এনসেফালাইটিস বা প্রদাহের কারণে রোগী ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে কোমায় গিয়ে মারা যেতে পারে।

সাধারণত যেকোনো রোগ থেকে বাঁচতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা মেনেই চলাই হচ্ছে উত্তম পন্থা। এই রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলো হলো।

ভাইরাস প্রতিরোধে উন্নতমানের মুখোশ ব্যবহার করতে হবে; Source: publicbroadcasting.net

১. আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা। এমনকি মৃতদেহ কবর দেওয়া, গোসল করানো, সৎকার করা ও মৃত ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার সময়ও যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

২. উন্নতমানের মাস্ক বা মুখোশ পরিধান করতে হয়।

৩. সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধৌত করতে হবে।

৪. আংশিক খাওয়া ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫. পাস্তুরিতকরণ ছাড়া ফলের জুস পান না করা।

৬. যথাযথ ব্যবস্থাপনা না নিয়ে প্রাণীদের ঘরের আশপাশে না যাওয়া।

৭. খেজুরের রস পান করার পূর্বে উত্তমরূপে ফুটিয়ে নিতে হবে। রস ফুটিয়ে ও খেজুর রসের গুড় খেতে কোনো সমস্যা নেই।

৮. খেজুর রস সংগ্রহের হাড়ি ও পাইপ খোলা না রেখে ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. ফলমূল খাওয়ার পূর্বে ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

১০. আপনার এবং শিশুদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখুন।

১১. গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যথাযথভাবে ঢেকে রাখতে হবে।

জুনোটিক ভাইরাস ও রোগগুলো প্রাণী থেকে মানুষে রোগ ছড়ায়। তাই এই রোগগুলো প্রতিরোধ ও নির্মূলে উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও প্রাণী চিকিৎসক, প্রাণী বিশেষজ্ঞ, মানব চিকিৎসকদের একত্রে কাজ করতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে জুনোটিক রোগ প্রতিরোধ, মানব স্বাস্থ্য ও প্রাণী স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বাংলাদেশেও ‘ওয়ান হেল্‌থ বাংলাদেশ’ যথাযথভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা মেনে চলার পরও যদি নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ পায় তবে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখনও কোনো প্রকার টিকা ও ভালোমানের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তাই রোগের লক্ষণ দেখে সেই অনুসারে কিছু ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এই ভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুহার শতকরা ৭০ ভাগেরও অধিক। তাছাড়াও যারা বেঁচে থাকেন তাদের নানাবিধ স্নায়ুবিক ও মানসিক সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী হতে পারে। সুতরাং ভারতের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদেরও এখনই সচেতন হওয়া উচিত।

ফিচার ইমেজ – newszii.com

Related Articles