Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

৬০ বছরে ২৪ লক্ষ শিশুর জীবন বাঁচানো এক রক্তদাতার গল্প

“মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য”- ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী গানের এই কথাটির অনন্য উদাহরণ হচ্ছে রক্তদান। রক্তদান জীবন বাঁচায়- এই কথাটি আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এটা কি জানেন, একবার রক্তদান করলে তিনটি জীবন বাঁচে! আর রক্তের উপাদান- প্লাজমা দান করলে বাঁচে ১৮টি জীবন। এমনটিই জানিয়েছেন ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষকরা। এই হিসেব অনুযায়ী, আপনি কতগুলো জীবন বাঁচিয়েছেন, তা নির্ভর করে আপনি কতবার রক্তদান করেছেন তার উপর। কিন্তু সেই অংকটি সর্বোচ্চ কত হতে পারে? ১০বার বা ২০বার? আরেকটু বেশিই যদি ধরি, ৫০ বার?

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার জেমস হ্যারিসন, গত অর্ধশতক জুড়ে রক্ত ও প্লাজমা দান করেছেন ১,১৭৩ বার! অস্ট্রেলিয়ান রেড ক্রস ব্লাড সার্ভিসের হিসেব অনুযায়ী, বিগত ৬০ বছর ধরে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে প্রায় ২৪ লক্ষ শিশুর জীবন বাঁচিয়েছেন হ্যারিসন। ৮১ বছর বয়সী এই প্রবীণ রক্তদাতার রক্তে অতি দুর্লভ একপ্রকার এন্টিবডি রয়েছে, যা গর্ভাবস্থায় নবজাতক শিশুকে রেসাস ডিজিজের হাত থেকে বাঁচায়। তাঁর দান করা প্লাজমা থেকে এন্টিবডি নিয়ে, অসংখ্য অস্ট্রেলিয়ান মা সুস্থ সন্তান প্রসব করেছেন।

এন্টি-ডি এন্টিবডির কারণে সুস্থভাবে জন্মানো শিশুকে কোলে নিয়ে জেমস হ্যারিসন; Source: InfoGlitz

যেভাবে জেমস হ্যারিসনের রক্তদান শুরু

জেমস হ্যারিসন যখন ১৪ বছর বয়সের কিশোর, তখন তাঁর বুকে একটি গুরুতর অপারেশন হয়েছিল। অপারেশনের সময় তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মোট ১৩ লিটার রক্ত দরকার হয়েছিল। অপারেশনের পর হ্যারিসন টানা তিন মাস হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ হন। সুস্থ হবার পর প্রথম যেদিন বুঝতে পারেন অন্য কারো রক্তদানই তাঁর জীবন বাঁচিয়েছে, এরপরই তিনি নিয়মিত রক্তদানের প্রতিজ্ঞা করেন। অবশ্য সুস্থ হবার পর, রক্তদানের জন্য হ্যারিসনকে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কারণ অস্ট্রেলিয়াতে রক্তদানের জন্য ন্যুনতম বয়স ১৮ বছর হতে হয়। এরপর ১৯৫৪ থেকে শুরু করে ২০১৮ সালে সর্বশেষ রক্তদানের দিন পর্যন্ত প্রায় ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা বজায় রেখে গেছেন। নিজের রক্তদানের অঙ্গীকার সম্পর্কে হ্যারিসন বলেন,

“আমার বুকের অপারেশনের সময় অনেক রক্ত লেগেছিল। এটি জানবার পর আমি আজীবন রক্তদানের প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এবং বিগত ৬০ বছরে একবারের জন্য হলেও রক্তদান বন্ধ করার কথা ভাবিনি।”

জেমস হ্যারিসনের প্রথম প্লাজমা/রক্তদানের ডকুমেন্ট; Source: abcnews.go

১৯৬৬ সালে রক্তদানের পর তিনি প্রথম জানতে পারেন, তাঁর রক্তে জীবন রক্ষাকারী দুর্লভ একপ্রকার এন্টিবডি আছে। এই এন্টিবডি শিশুদের রেসাস ডিজিস থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে। এটা জানার পর তিনি অস্ট্রেলিয়ান রেড ক্রস ব্লাড সার্ভিসের এন্টি-ডি প্রোগ্রামে স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা (প্লাজমাদাতা) হিসেবে রক্ত দান করতে থাকেন।

হ্যারিসনের রক্তে এই দুর্লভ এন্টিবডির উপস্থিতি সম্পর্কে ডাক্তাররাও সঠিক কোনো ধারণা দিতে পারে না। তবে তাদের ধারণা অনুযায়ী, ১৪ বছর বয়সে হ্যারিসন যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন তাঁর শরীরে রক্ত প্রদানের সময় সম্ভবত এই দুর্লভ এন্টিবডি তাঁর মধ্যে পরিবাহিত হয়েছে।

প্রতি ব্যাগ রক্তই খুবই মূল্যবান, কিন্তু হ্যারিসনের রক্তটা একটু বেশিই অমূল্য। কারণ তার রক্তে রয়েছে জীবন বাঁচানোর উপাদান। তাঁর রক্ত শুধুমাত্র রক্ত হিসেবে না, জীবন রক্ষাকারী ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। হাজার হাজার গর্ভবতী মা তাদের গর্ভের সন্তান বাঁচানোর জন্য এই প্রতিষেধক গ্রহণ করছেন। অস্ট্রেলিয়াতে এখন পর্যন্ত যত এন্টি-ডি ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে, তার সবগুলোই তৈরি হয়েছে হ্যারিসনের রক্ত থেকে।

রক্তদানের পর হ্যারিসনের এন্টি-ডি এন্টিবডিযুক্ত প্লাজমা ব্লাড ব্যাগে জমা হচ্ছে; Source: abcnews.go

অস্ট্রেলিয়ার শতকার ১৭ জন মহিলা গর্ভকালীন এই ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। ফলে তাদের গর্ভের সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করতে এই এন্টি-ডি ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরী।

রেসাস ডিজিস এবং এন্টি-ডি কী?

হ্যারিসনের রক্ত হলো অনন্য একধরনের রক্ত। রেসাস ডিজিজের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন এন্টিবডি তাঁর রক্তে পাওয়ার পর তা থেকে এন্টি ডি নামক ইনজেকশন তৈরি করা হয়। এই রেসাস ডিজিজ এমন একটি রোগ, যে রোগে একজন গর্ভবতী মায়ের রক্ত তাঁর গর্ভে থাকা সন্তানের (ভ্রূণের) লোহিত রক্তকণিকাকে আক্রমণ করে এবং নষ্ট করে ফেলতে থাকে। আর এর ফলস্বরূপ গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি সন্তান মারাও যেতে পারে।

মাতৃদেহে রেসাস ফ্যাক্টর তৈরি প্রক্রিয়া। Source: Medmovies

কেন এমন হয়?

যখন কোনো আরএইচ নেগেটিভ রক্তের নারীর সাথে আরএইচ পজিটিভ রক্তের পুরুষের সাথে বিয়ে হয় এবং তারা সন্তান লাভ করতে চায়, তখন এই রেসাস ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে ২য় সন্তান গ্রহণের বেলায়। আরএইচ পজিটিভ, আরএইচ নেগেটিভের চাইতে প্রকট হবার ফলে প্রথম সন্তান আরএইচ পজিটিভ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই সন্তান গর্ভে থাকার সময় মায়ের রক্তে আরএইচ নেগেটিভ এন্টিবডি তৈরি হয় (যা আগে মায়ের রক্তে ছিল না)। কিন্তু প্রথমবার গর্ভধারণের সময় রক্তে এই এন্টিবডি যথেষ্ট পরিমাণ থাকে না। তাই প্রথম সন্তানের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না।

দ্বিতীয়বার গর্ভবতী মায়ের রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ আরএইচ নেগেটিভ এন্টিবডি থাকে। এবার গর্ভের সন্তানের রক্ত যদি আরএইচ পজিটিভ হয় (বাবা থেকে প্রাপ্ত), তখন মায়ের রক্তের এই নেগেটিভ এন্টিবডি গর্ভের সন্তানের রেসাস পজিটিভ এন্টিবডিকে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে সেটিকে দমন করতে চায়। এই আরএইচ নেগেটিভ এন্টিবডি অমরার মাধ্যমে ভ্রূণের মাধ্যমে ঢুকে ভ্রূণের লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলস্বরূপ গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং গর্ভাবস্থায় বা বাচ্চা প্রসবের পর বাচ্চা মারাও যেতে পারে। বাচ্চা প্রসবের পরও যেসব বাচ্চা জীবিত থাকে তাদের প্রকট জন্ডিস এবং রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।

অ্যান্টি-ডি ইনজেকশনের মাধ্যমে রেসাস ফ্যাক্টর প্রতিরোধ প্রক্রিয়া; Source: Medmovies

ঈশ্বরের আশীর্বাদ জেমস হ্যারিসন

হ্যারিসনের রক্তে পাওয়া এন্টিবডি, এন্টি-ডি, রেসাস (আরএইচ) নেগেটিভ মায়ের রক্তে রেসাস নেগেটিভ এন্টিবডি তৈরি করতে বাঁধা দেয়। ১৯৬৭ সালে হ্যারিসনের রক্তে দুর্লভ এন্টি-ডি পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ লক্ষ অস্ট্রেলিয়ান মাকে এই অ্যান্টি-ডি ডোজ দেয়া হয়। এমনকি হ্যারিসন নিজের মেয়েকেও এই এন্টি ডি ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছিল। হ্যারিসন বলেন,

আমার এই এন্টিবডি আমার দ্বিতীয় নাতীকে সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করেছে। এছাড়াও আরো অনেক শিশু এই এন্টি ডি ভ্যাকসিনের জন্য সুস্থভাবে জন্ম নিচ্ছে। এটি আসলেই অসাধারণ একটি অনুভূতি।

হ্যারিসনের রক্তে এই দুর্লভ এন্টিবডির উপস্থিতি এবং হ্যারিসনের রক্তদানকে অস্ট্রেলিয়ান কর্তাব্যক্তিরা অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। অস্ট্রেলিয়াতে তাঁকে বলা হয় স্বর্ণ বাহুর মানুষ, যার বাহুর শিরা থেকে অ্যান্টি-ডি নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছে লক্ষ লক্ষ শিশু।

১৯৬৭ এর আগপর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াতে, হেমোলাইটিক ডিজিজ অফ দ্য নিউবর্ন (রেসাস ডিজিজ) এ আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার শিশু মারা গিয়েছিল। কিন্তু প্রযুক্তি এবং যথেষ্ট গবেষণার সুযোগ না থাকায় ডাক্তাররা এই মৃত্যুর কারণ কিছুতেই নির্ণয় করতে পারছিলেন না। তখনকার সময়ে গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাতের হার আশংকাজনকভাবে বেড়ে গিয়ে ছিল। আর যে কয়টা শিশু এই রোগ নিয়ে জন্মাতো, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল।

জেমস হ্যারিসনের ক্যারিকেচার; Source: John Shakespeare Tweet

অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় বীর হ্যারিসন

অস্ট্রেলিয়ান ব্লাড ডোনেশন সার্ভিসের মতে, এখন পর্যন্ত জেমস হ্যারিসনের রক্তের এন্টিবডি ব্যবহার করে প্রায় চব্বিশ লক্ষ শিশুর প্রাণ বেঁচেছে। তাঁর এই মহান কীর্তি অস্ট্রেলিয়াতে তাকে রীতিমত জাতীয় বীর বা জাতীয় নায়কে পরিণত করেছে। তাঁর এই মহানুভবতার প্রতিদানস্বরূপ তাকে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সম্মান এবং পুরষ্কার- মেডেল অফ দ্য অর্ডার অস্ট্রেলিয়া প্রদান করা হয়েছে। সর্বাধিকবার রক্তদান করে জীবন বাঁচানোর সম্মানস্বরূপ ২০০৩ সালে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জেমস হ্যারিসনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।

ব্যক্তিগতভাবে জেমস হ্যারিসন অত্যন্ত বিনয়ী এবং উদার একজন মানুষ। তার উদারতার ছাপ তাঁর কণ্ঠে স্পষ্ট। তিনি বলেন,

“যখন কেউ আমাকে বলে, আপনি তো অনেক মহৎ কাজ করছেন, তখন আমার সামান্য খারাপই লাগে। আসলে আমার মনে হয় কী, আমি এই একটি কাজই করতে পারি, আর তা হলো রক্তদান। এই রক্তদানই আমার একমাত্র প্রতিভা বলে মনে করি।”

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান নেবার পর জেমস হ্যারিসন। Source: NPR

শেষবারের মতো রক্তদান

হ্যারিসন রক্তদান করে চলেছেন প্রায় ৬০ বছর হয়েছে। বয়সও বেড়েছে হ্যারিসনের। অস্ট্রেলিয়াতে কারো বয়স ৮১ বছর অতিক্রম করলে তাঁর রক্তদান করার নিয়ম নেই। হ্যারিসন ৮১ ছুঁয়েছেন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। তাই জীবনের শেষবারের মতো রক্তদান করে ফেলেছেন হ্যারিসন। ২০১৮ সালের ১১ মে  ১,১৭৩ তম রক্তদানই ছিল তাঁর শেষ রক্তদান। তাঁর রক্তের এন্টিবডি গ্রহণ করে সুস্থ সন্তান জন্ম দেয়া মায়েরা সন্তানসহ অস্ট্রেলিয়ান রেড ক্রস ব্লাড সার্ভিস সেন্টারে এসে দিনটিকে হ্যারিসনের জীবনে স্মরণীয় করে রাখেন।

জীবনের শেষ রক্তদানের সময় এন্টি-ডি গ্রাহক মা ও শিশুদের সাথে জেমস হ্যারিসন। Source: abcnews.go.com

হ্যারিসনের রক্তদান আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, অস্ট্রেলিয়ান নারীদের গর্ভকালীন রেসাস ফ্যাক্টর প্রতিরোধে এখন কার রক্তের এন্টিবডি ব্যবহার হবে? এই প্রসঙ্গে রেড ক্রস সার্ভিসের ফাকেনমায়ার বলেন, এক্ষেত্রে আমরা কেবল আশা করতে পারি যে জেমস হ্যারিসনের মতো যাদের রক্তে এন্টি-ডি এর উপাদান এন্টিবডি রয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ হয়ত যথেষ্ট উদার মানসিকতা নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে রক্তদানে এগিয়ে আসবে, যেমনটা জেমস হ্যারিসন করেছেন। এখন পর্যন্ত ২০০ জন রক্তদাতা এন্টি-ডি প্রোগ্রামে রক্তদান করতে সক্ষম। তাদের দিকে আশাবাদ ব্যক্ত করে জেমস হ্যারিসন বলেন,

“আমি চাই, আমার ১,১৭৩ বার রক্তদানের এই রেকর্ডটি কেউ ভাঙ্গুক। কারণ এতেই প্রমাণিত হবে মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য নিবেদিত প্রাণ।”

ফিচার ইমেজ: jenpromuze.cz

Related Articles