সময়টা তখন ১৮৯৫ সালের ৮ নভেম্বর।
সূর্য পাটে বসেছে।জার্মানির ওয়ার্যবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের (Wurzburg university) পরিক্ষাগারে তখন একাগ্রচিত্তে গবেষণায় মগ্ন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক পদার্থবিদ। গবেষণার বিষয় ক্যাথোড রে বা ঋণাত্মক রশ্মি (cathode rays)। এটি মূলত বায়ুশুন্য পরিবেশে ইলেক্ট্রনের নিঃসরণ। কোন কাচের টিউব বায়ুশুন্য (vacuum ) করে এর দুই প্রান্তে দুটি ভিন্ন চার্জের ইলেক্ট্রোড স্থাপন করে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে ক্যাথোড রশ্মির প্রভাবে ঋণাত্মক চার্জ বা ক্যাথোডের দিকে কাচে উজ্জ্বলতা দেখা দেয়।ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে অনেকেই আগে পরীক্ষা নিরিক্ষা করেছেন। জার্মান এই বৈজ্ঞানিক তাদের ফলাফল যাচাই বাছাই করছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল এর মধ্য দিয়েই হয়ত নতুন কোন কিছু বেরিয়ে আসবে।ক্যাথোড রশ্মি সৃষ্টিতে তিনি বেছে নিয়েছিলে সেজন্য বিশেষভাবে তৈরি টিউব যা ক্রুকস টিউব (Hittorf-Crookes tube) নামে পরিচিত।
ব্রিটিশ রসায়ন ও পদার্থবিদ স্যার উইলিয়াম ক্রুকস (১৮৩২-১৯১৯) ক্রুকস টিউব উদ্ভাবন করেছিলেন। এটি মূলত বায়ুশুন্য কাচের টিউবের দুদিকে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ বসিয়ে তৈরি। বিভিন্ন খনিজ পদার্থের ঔজ্জল্য বা ফ্লুরোসেন্স (fluorescence) দেখতে এই টিউবের ব্যবহার ছিল।
৮ নভেম্বরের সেই দিনে জার্মান বিজ্ঞানি উইলহেলম রন্টজেন ক্রুকস টিউবের চারিদিক কালো কাগজে ঢেকে দিয়েছিলেন। এর সামনে টেবিলের উপর রাখা ছিল রাসায়নিক মিশ্রিত একরকম কাগজ।রন্টজেন ক্যাথোড রশ্মি দেখতে চাইছিলেন। কিন্তু তার চোখে আরেকটি কৌতূহলোদ্দিপক বিষয় ধরা পড়ল। তিনি যখন টিউবের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চালিত করছিলেন তখন টেবিলে রাখা কাগজের উপর আকাবাকা একটি কালো রেখা তৈরি হয়। অথচ তিনি টিউব এমনভাবে ঢেকে রেখেছেন যা ভেদ করে ক্যাথোড রশ্মির যেতে পারারই কথা নয়। তাহলে কিসের প্রভাবে কাগজে এই রেখার সৃষ্টি হচ্ছে? নতুন কোন রশ্মি?
উইলহেলম রন্টজেন
উইলহেলম কনরাড রন্টজেনের (Wilhelm Conrad Roentgen) জন্ম ১৮৪৫ সালের ২৭ মার্চ, তৎকালীন খণ্ডবিখণ্ড জার্মানির সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রুশিয়ার উত্তর রাইন-ওয়েস্টফ্যালেয়া প্রদেশের লেনেপে (Lennep)। তার বাবার ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ছেলের জন্মের তিন বছরের মাথায় তিনি জার্মানি ছেড়ে পাড়ি জমালেন নেদারল্যান্ডস। সেখানেই বাসা বাঁধলেন গেল্ডারল্যান্ড প্রদেশের শহর অ্যাপেলডর্নে (Appeldoorn)। সেখানকার স্কুল থেকেই রন্টজেনের পড়ালেখা শুরু। ছাত্র হিসেবে আহামরি না হলেও তিনি পরিশ্রমী ছিলেন। তার চোখে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন। তখনকার দিনে প্রধানত মেধাবি ছাত্রদের জন্যেই উচ্চশিক্ষার দরজা খোলা ছিল। এজন্য তাদের কঠিন পরিক্ষাও দিতে হত।
ছাত্রাবস্থায় রন্টজেনের এক সহপাঠী তাদের একজন শিক্ষকের কার্টুন এঁকেছিলেন। রন্টজেন যখন সেই কাগজ দেখছেন তখন পড়বি তো পর বাঘের ঘাড়ের মত শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হলেন সেই শিক্ষক। রন্টজেনের হাতে তার ব্যঙ্গাত্মক চিত্র স্বভাবতই শিক্ষকের পছন্দ হয়নি। তিনি রন্টজেনকেই কালপ্রিট ধরে নিলেন। বালক রন্টজেন জোর দিয়ে নিজের নির্দোষিতা ঘোষণা করলেন। কিন্তু শত বকাবকির মুখেও যে সহপাঠী এই কাজ করেছে তার নাম প্রকাশ করলেন না। ফলাফল, তাকে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হল।
স্কুলের পড়াশোনা সমাপ্ত না করলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনই করা যেতনা। আমাদের এইচ এস সি’র মত স্কুল একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি দিত, যা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অন্যতম একটি যোগ্যতা। ফলে রন্টজেনের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বিশাল এক ধাক্কা খেল। তবে হাল ছাড়লেন না তিনি। পরিবারের দিক থেকে স্বচ্ছল হওয়ায় গৃহশিক্ষক রেখে তিনি অ্যাবসুলুটেনাম (absolutanum) নামে এক পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। এই পরীক্ষা ছিল সেইসব ছাত্রদের জন্য, যারা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেনি। এর সার্টিফিকেট স্কুল সমাপ্তির ডিপ্লোমার সমমানের বলে ধরা হত।তবে এবারেও রন্টজেন বাধা পেলেন। পূর্ববর্তী স্কুলের যে শিক্ষক তার বহিস্কারে জড়িত ছিলেন সেই তিনিই পরিক্ষক হিসেবে অন্যান্যদের সাথে বসেছিলেন। ফলে ভাগ আবার তাকে নিরাশ করল। কিছুটা হতাশ হয়েই নেদারল্যান্ডসের উট্রেখট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টাফের কাজ নিলেন তিনি।বিভিন্ন ক্লাসে উপস্থিত থেকে শিক্ষা পদ্ধতির মান যাচাইয়ের কাজ করতেন রন্টজেন।
তৎকালীন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে পলিটেকনিক স্কুল ছিল উচ্চশিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান। সেখান ভর্তি হতে স্কুল সমাপ্তির প্রয়োজনীয়তা ছিলনা। তবে কিছু অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট লাগত এবং শক্ত ভর্তি পরীক্ষা পার হতে হত। রন্টজেনের এক বন্ধু তার উচ্চশিক্ষার স্বপ্নের কথা জানতেন। তিনি পরামর্শ দিলেন পলিটেকনিক স্কুলে চেষ্টা করবার।এতদিন পর বিধাতা মুখ তুলে চাইলেন। রন্টজেন সুযোগ পেয়ে গেলেন জুরিখে পড়াশোনার। ১৮৬৮ সালে এখান থেকেই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করে অগাস্ট কুন্ড (Kundt) নামে এক ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসেন। অগাস্ট কুন্ড ছিলেন ইউরোপের অন্যতম সেরা একজন পদার্থবিজ্ঞানি। তার কাছ থেকে রন্টজেন অনেক কিছু শিখলেন। পরের বছরেই তিনি পি এইচ ডি নিয়ে নেন। পরের প্রায় এক দশক রন্টজেন ছায়ার মত অনুসরণ করে গিয়েছিলেন তার শিক্ষক কুন্ডকে।
পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক রন্টজেন
রন্টজেনের স্কুল সমাপ্ত না করার দুর্ভাগ্য কর্মক্ষেত্রেও তার পিছু নিয়েছিল।সেকালে ইউরোপিয়ান, বিশেষ করে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকদের প্রিভাডোজেন্ট (privatdozent) নামে একটি পদ দেয়া হত। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষকতার লাইসেন্স পেতেন তারা এবং পরবর্তীতে পদোন্নতির সুযোগ থাকত। প্রিভাডোজেন্ট হতে গেলে যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার দরকার তার মাঝে নিবন্ধিত কোন স্কুল থেকে পাঠ্যক্রম শেষ করার সার্টিফিকেট থাকাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কাজেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও গোড়ার গলদের কারণের রন্টজেনেকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রিভাডোজেন্ট করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ধাপ বেয়ে উপরে ওঠার যে আশা রন্টজেন করছিলেন তা প্রথমেই বাধাপ্রাপ্ত হল।এহেন অবস্থাতেই বাভারিয়ার ওয়ার্যবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রন্টজেন দুই বছর কাজ করেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন না দেখে তিনি নবপরিণীতা স্ত্রী অ্যানা বার্থা লুডউইগকে নিয়ে চলে গেলেন ফ্রান্সের স্ট্র্যাসবুর্গে। সেখানকার নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মানির মত এতটা কড়াকড়ি ছিলনা। ফলে রন্টজেন তার যোগ্যতার ভিত্তিতে বেশ ভাল একটি অ্যাকাডেমিক পদ লাভে সক্ষম হলেন।এখানে তার গুরু কুন্ডও ছিলেন।
স্ট্র্যাসবুর্গে রন্টজেন পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ফলশ্রুতিতে জার্মানির ভুর্তেমবার্গের হনহেইম শহরের কৃষি অ্যাকাডেমি তাকে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পদ অলঙ্কৃত করার আহ্বান জানায়। তবে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে রন্টজেন দ্রুতই আবার স্ট্র্যাসবুর্গ ফিরে এলেন। কুন্ডের সাথে জোট বেঁধে গবেষণা চালাতে থাকেন পুরোদমে। এইসময় তিনি সহযোগী অধ্যাপকের পদপ্রাপ্ত হন। কয়েক বছর পর তাকে জার্মানির গিজেন বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করে। এখানে আট বছর ধরে রন্টজেনের পদার্থবিজ্ঞানি সত্ত্বার পরিপূর্ণ বিচ্ছুরন দেখা গেল।তার প্রকাশিত নিবন্ধগুলি ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানীদের নজর কাড়তে শুরু করে।তিনি প্রথম সারির একজন বিজ্ঞানি বলে সমাদৃত হতে থাকলেন।
বাভারিয়াতে রন্টজেন
যে ওয়ার্যবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় রন্টজেনের যোগ্যতার ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে ছিল, ভাগ্যের ফেরে তারাই রন্টজেনকে পেতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। তাকে তারা নব প্রতিষ্ঠিত ফিজিক্যাল ইন্সটিটিউটের প্রধানের পদ গ্রহণের অনুরোধ জানায়।উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার প্রস্তাব তখন যেকোন বৈজ্ঞানিকের কাছেই আরাধ্য ছিল। ফলে রন্টজেন না করলেন না। বিজয়ীর বেশে তিনি বাভারিয়াতে প্রত্যাবর্তন করলেন। এখানেই ১৮৯৪ সালে ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে কাজ করার ঝোঁক চাপল তার মাথায়।
একজন পুরোদস্তুর প্রথাগত বৈজ্ঞানিক ছিলেন রন্টজেন। ফলে নতুন কিছু করার আগে পূর্ববর্তী বৈজ্ঞানিকদের প্রকাশিত ফলাফলগুলি যাচাই করতে তিনি মনোযোগী হন। এজন্য তিনি ইংল্যান্ডের উইলিয়াম ক্রুকস আর জার্মানির ফিলিপ লেনার্ডকে বেছে নেন। মূলত লেনার্ডের পরীক্ষা নিরিক্ষাই গবেষণাগারে নতুন করে করতে রন্টজনে আগ্রহী ছিলেন।তবে সেই সময় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের পদ দেয়ায় প্রশাসনিক কাজে রন্টজেন প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফলে কিছু সময়ের জন্য ক্যাথোড রশ্মির বিষয়ে তার কাজ স্থগিত রাখতে বাধ্য হন।১৮৯৫ সালের পয়লা অক্টোবর থেকে রন্টজনে আবারো গবেষণা চালু করলেন।
এক্স-রে
কাচের টিউবে সৃষ্ট ক্যাথোড রশ্মি কাচ ভেদ করতে পারত না। লেনার্ড দেখিয়েছিলেন টিউবের মধ্যে অ্যালুমিনিয়ামের পাত বসিয়ে ক্যাথোড রশ্মিকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।এই অ্যালুমিনিয়ামের পাতের কয়েক সেন্টিমিটারের মধ্যে ক্যাথোড রশ্মি ঔজ্জল্য বা ফ্লুরোসেন্স তৈরি করে। রন্টজেন চাইছিলেন এমন কিছু করতে যেখানে টিউবের বাইরে ক্যাথোড রশ্মি দ্বারা ফ্লুরোসেন্স সৃষ্টি সম্ভব হবে। একাজে তিনি এতটাই মনপ্রান ঢেলে দিলেন যে এমনকি তার সহিষ্ণু স্ত্রীও বিরক্ত হয়ে ওঠেন।
শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ১৮৯৫।
গবেষণাগারে কাজ করছেন উইলহেলম রন্টজেন। যে কাচের টিউবে তিনি ক্যাথোড রশ্মি উৎপাদন করবেন তা ঢেকে দিলেন কালো কার্ডবোর্ডের আচ্ছাদনে। এর সামনেই বেঞ্চে বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড আবৃত একটি কাগজের পর্দা রেখে দিলেন তিনি। বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড কাগজের উপর ফ্লুরোসেন্স তৈরির ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিল।এরপর রন্টজেন ঘর অন্ধকার করে টিউবের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করেন, তৈরি হল ক্যাথোড রশ্মি।
সবকিছু ঠিকঠাকমতই চলছিল। হঠাৎ বেঞ্চে আঁকাবাঁকা দুর্বল এক আলোকরেখা রন্টজেনের দৃষ্টি কেড়ে নেয়।কয়েকবার পরীক্ষা করে একই রেখা দেখতে পেলেন তিনি। আলো জ্বালিয়ে আবিষ্কার করলেন এর বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড পর্দাতেই ফ্লুরোসেন্সের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে এই রেখা। রন্টজেন ক্রমাগত এই পর্দা দূরে সরাতে থাকলেও প্রতিবারেই এর উপর ফ্লুরোসেন্স দেখা যেতে লাগল, যা ক্যাথোড রশ্মির ধর্মের সাথে খাপ খায় না। ফলে রন্টজেন বুঝতে পারলেন নতুন কোন এক রশ্মি এই ঘটনার কারণ। অজানা বলে এই রশ্মির নামকরণ তিনি করলেন এক্স-রে।
পরের ছয় সপ্তাহ ধরে রন্টজেন এক্স-রে নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা চালালেন। স্ত্রীর বিরক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়ে গবেষণাগারেই তিনি খাওয়া আর ঘুমের ব্যবস্থা করেন। এমনকি ক্যাম্পাসেও তার দেখা মিলতে থাকে কদাচিৎ। এক্স-রে’র বিষয়ে নিশ্চিত হবার আগে কাউকে রন্টজেন কাউকে জানতেও দেননি কি নিয়ে তিনি এতো ব্যস্ত। স্ত্রীকে শান্ত করতে অবশেষে তাকে তিনি গবেষণাগারে নিয়ে এলেন। ফটোগ্রাফিক কাগজের সামনে স্ত্রীর হাত রেখে এক্স-রে প্রবাহিত করলেন তিনি, সৃষ্টি হল ইতিহাসের প্রথম রেডিওগ্রাফের। অ্যানা বার্থা লুডউইগের হাতের কঙ্কালের ছবি রন্টজনেকে রোমাঞ্চিত করলেও স্ত্রীকে করে তুলল প্রচণ্ড ভীত। তিনি ধরেই নিলেন কোন কারণে তার শরীর কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে এবং অতি দ্রুতই তার মৃত্যু ঘটবে। মুহূর্তেই গবেষণাগার ত্যাগ করেন অ্যানা।
ইউরোপে শোরগোল
রন্টজেন তার আবিষ্কার নিয়ে নিবন্ধ পেশ করেন ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বরে। নাম দেন নতুন এক রশ্মির বিবরণ (Ueber elne Neue Art von Strahlen/ On a New Kind of Ray )। বছরান্তে ওয়ার্যবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্যাল-মেডিক্যাল সোসাইটির সম্মেলনে নিবন্ধটি প্রকাশিত্ হয়। ১৮৯৬ সালের শুরুতেই ইউরোপের নামজাদা অনেক পদার্থবিজ্ঞানির কাছে নিবন্ধের কপি পাঠান রন্টজেন। এদের একজন ছিলেন জুরিখের আর্নস্ট লেখার (Ernst Lecher)। তার বাবা ছিলেন ভিয়েনা প্রেস সংবাদপত্রের একজন সম্পাদক।
৫ জানুয়ারি, ১৮৯৬ সালে ভিয়েনা প্রেস ফলাও করে সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় রন্টজেনের আবিষ্কার ছবিসহ প্রচার করল। দ্রুতই ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের পত্রপত্রিকা এই খবর পুনর্মুদ্রণ করে। এক সপ্তাহের ভেতর রন্টজেন এক্স-রে নিয়ে প্রায় ১০০০ চিঠি পেলেন। তার আবিষ্কার নিয়ে বহু লেখা নানাজন প্রকাশ করা আরম্ভ করল। এর মধ্যেই ডাক এল জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের দরবার থেকে। ১৩ জানুয়ারি তার সামনে রন্টজেন এক্স-রে প্রদর্শন করেন।
২৩ জানুয়ারি ওয়ার্যবার্গ ফিজিক্যাল-মেডিক্যাল সোসাইটির সামনে রন্টজেন এক্স-রে নিয়ে তার প্রথম এবং একমাত্র আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদান করেন। ১৮৯৬ এবং ১৮৯৭ সালের মার্চে এক্স-রে নিয়ে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর পর রন্টজন এক্স-রে নিয়ে আর কোন নিবন্ধ প্রকাশ করেননি।পদার্থবিজ্ঞানে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০১ সালে তাকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।
চিকিৎসাক্ষেত্রে এক্স-রে
এক্স-রে মানব শরীরে অভ্যন্তরের ছবি তুলতে পারে বলে চিকিৎসকদের কাছে এর কদর খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। তখন অবধি এক্স-রে’র ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানা না থাকায় অনেকটা নির্বিচারেই এর ব্যবহার হচ্ছিল। এক্স-রে দিয়ে মানুষের মগজের ছবি তোলার চেষ্টাও করা হয়। যদিও এডিসন, নিকোলা টেসলা, উইলিয়াম মর্টনসহ কয়েকজন বৈজ্ঞানিক এক্স-রে’র ক্ষতিকর প্রভাবের ব্যাপারে তাদের সন্দেহের কথা ব্যক্ত করেছিলেন, কেউ তেমনভাবে তাতে কান দেয়নি।
আবিষ্কারের এক বছরের মধ্যেই গ্লাসগো হাসপাতাল এক্স-রে’র জন্য প্রথম একটি ডিপার্টমেন্ট খুলে বসে। এখানে কিডনির পাথর আর এক বাচ্চা ছেলের গিলে ফেলা পয়সা এক্স-রে দিয়ে সনাক্ত করা হল। বার্মিংহ্যামের এক চিকিৎসক জন ফ্রান্সিস হল এডওয়ার্ডস এক্স-রে ব্যবহার করে এক রোগীর হাতে বিঁধে থাকা সেলাইয়ের ছোট্ট সুই সনাক্ত করেন। এর ভিত্তিতে শল্যচিকিৎসক অপারেশন করতে সক্ষম হন।তার এই কাজ ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালসহ স্থানীয় সংবাদপত্রগুলি বেশ ফলাও করে প্রচার করে।
আমেরিকাতে এক্স-রে’র আবির্ভাব ১৮৯৬ তেই। ১৯ জানুয়ারি এডি ম্যাককার্থি নামে এক কিশোর জমে থাকা কানেক্টিকাট নদীর উপর স্কেটিং করতে গিয়ে আছাড় খেয়ে কব্জি ভেঙ্গে ফেলে। ডার্টমাউথের মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক গিলম্যান ডি ফ্রস্ট তেসরা ফেব্রুয়ারি আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম এক্স-রে ছবি তোলেন, যা ছিল এডি ম্যাককার্থির কব্জি।
ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সন্ধান
আজ আমরা জানি তেজস্ক্রিয় হওয়ায় উপযুক্ত প্রতিরোধক ব্যবস্থা ছাড়া এক্স-রে’র ব্যবহার ঠিক নয়।তবে আবিষ্কারের পর প্রথমদিকে এক্স-রে’র উপকারিতা নিয়ে আগ্রহ তুঙ্গে থাকায় এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিষয়টি অনেকটা আড়ালে চলে যায়। রন্টজেন নিজেও এই নিয়ে আর কাজ করেননি। তবে অন্যান্য বিজ্ঞানিরা ধীরে ধীরে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন।
আমেরিকার ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ড্যানিয়েল আধা ইঞ্চি দূর থেকে তার এক সহকর্মীর মাথা বরাবর এক্স-রে প্রয়োগ করেন। উদ্দেশ্য খুলির ছবি নেয়া। প্রায় এক ঘণ্টা যাবত এক্স-রে প্রয়োগ করা হয়েছিল। তিন সপ্তাহ পর দেখা যায় মাথার যেই স্থানে এক্স-রে পড়েছিল সেখানে সব চুল উঠে গেছে।১৮৯৬ সালের মার্চে এই নিয়ে ড্যানিয়েল একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
একই বছর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক মাইকেল পিউপিনের সহকারী হার্বার্ট হকস নিউ ইয়র্কে এক্স-রে’র কার্যকারিতা প্রদর্শন করছিলেন। চারদিন দুই বেলা ধরে প্রতি বেলা ২-৩ ঘণ্টা এক্স-রে নিয়ে কাজ করার পর হকস শারীরিক সমস্যার কারণে কাজ বন্ধ করে দিয়ে বাধ্য হন। তার চামড়া শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল, হাত ফুলে গিয়ে সেখানে দেখা যাচ্ছিল পোড়া দাগ। দুই সপ্তাহের মাথায় হাতের চামড়াই উঠে আসে। হকসের শরীরে লোম পড়ে যেতে থাকে, আঙ্গুলের নখের বৃদ্ধিও থেমে যায়। এমনকি কাপড় ভেদ করে তার বুকে দেখা দেয় পোড়া ফোস্কা।চিকিৎসকেরা তাকে গরম পানিতে পোড়া রোগীর মত করে চিকিৎসা দেন।
এদিকে আমেরিকাতে বসেই ইতিহাসবিখ্যাত উদ্ভাবক থমাস আল্ভা এডিসন এক্স-রে নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা নিরিক্ষা করছিলেন। এইকাজে তার সঙ্গি ছিলেন ক্ল্যারেন্স ড্যালি। এক্স-রে নিয়ে তিনি এত বেশি মেতে উঠেছিলেন যে তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করে। তার হাতে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং তা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে চিকিৎসকেরা তার ডান হাতই কেটে ফেলতে বাধ্য হন। এক পর্যায়ে চর্মের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ড্যালি। প্রায় আট বছর এক্স-রে নিয়ে পরীক্ষার ফলশ্রুতিতে ১৯০৪ সালে তাকে বরণ করতে হয় মৃত্যু।সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত তেজস্ক্রিয়তার কারণে মারা যাওয়া প্রথম ব্যক্তি এই ক্ল্যারেন্স ড্যালি। এরপর এডিসন এক্স-রে নিয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে রন্টজেন তো ঘণ্টার পর ঘন্টা এক্স-রে নিয়ে কাজ করেছিলেন। তাহলে তার কিছুই হয়নি কেন? এর কারণ ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে পরিক্ষা করতে আলো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল, যেকারনে রন্টজেন নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতেন টিন আর লেড দিয়ে আবৃত ছোট্ট এক ঘরে। এর ভেতর থেকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে ক্যাথোড রশ্মির খেলা প্রত্যক্ষ করতেন তিনি।ফলে নিজের অজ্ঞাতসারেই বেঁচে যান রন্টজেন।
শেষ কথা
রন্টজেন মারা যান মিউনিখে, ১৯২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি।জীবদ্দশাতে নিজের আবিষ্কার থেকে আয়ের প্রচুর সুযোগ থাকলেও মহান এই বৈজ্ঞানিক কখনোই তা গ্রহণ করেননি।এক্স-রে নিয়ে গবেষণাকে উৎসাহিত করতে তিনি এমনকি নিজের আবিষ্কার প্যাটেন্টও করাননি। তার বিশ্বাস ছিল গবেষণালব্ধ ফলাফল জনমানুষের উপকারের জন্য, ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। নোবেল প্রাইজে পাওয়া অর্থও তিনি ওয়ার্যবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগলেও নিজের আবিষ্কার বিক্রি করে অর্থলাভের পথে পা বাড়াননি জনহিতৈষী এই পদার্থবিজ্ঞানি।
রন্টজেনের অনিচ্ছাকৃত এক্স-রে আবিষ্কার আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। আজও সারা পৃথিবীতে রোগ নির্ণয়ের অন্যতম উপায় হিসেবে এক্স-রে বহুল প্রচলিত। এই কৃতিত্বের সিংহভাগ জার্মান সেই বৈজ্ঞানিক, উইলহেলম রন্টজেনের।
This is a Bengali language article about Wilhelm Roentgen and his accidental discovery of X-ray. This article describes the life of Roentgen and how he came about discovering a new ray that has since changed the face of medical diagnosis.
References
- Goodman, P. C. (1995). The New Light: Discovery and Introduction of the X-Ray. AJR 1995;165:1041-1045
- Jean-Jacques Samueli (2009). Röntgen’s discovery of X-rays. Translated by Helen Tomlinson (2015).
- Assmus, A. (1995). Early History of X Rays
- Glasser, Otto (1933). Wilhelm Conrad Röntgen and the Early History of the Roentgen Rays. London: John Bale, Sons and Danielsson, Ltd. p. 305.
- Spiegel PK. The first clinical X-ray made in America--100 years. AJR Am J Roentgenol. 1995 Jan;164(1):241-3
Feature image: dailymail.co.uk