Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা

জরুরী মুহূর্তে সঠিক প্রাথমিক চিকিৎসা মাঝে মাঝে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য গড়ে দেয়। কিন্তু মানব দেহ সংক্রান্ত কিছু কিছু অভিজ্ঞতা এবং উপদেশ সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে বদলে যেতে পারে। অর্থাৎ আমরা যতই মানব দেহ সম্পর্কে জানতে পারছি, ততই বুঝতে পারছি কিছু কিছু ধারণা এখন পুরনো হয়ে গেছে। প্রাচীন সেসব পদ্ধতি থেকেও ভালো এবং সময়োপযোগী কিছু পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। আজ আমরা ঠিক তেমনই কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানবো যেগুলো এখন সেকেলে হয়ে গেছে এবং আমরা আরো জানবো সেগুলোর পরিবর্তে নতুন কী কী পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে।

১. প্রচলিত ধারণা: পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে মাখন লাগানো

এই পদ্ধতি বহুকাল ধরে প্রচলিত। গ্রামীণ এলাকায় এই পদ্ধতি খুবই প্রচলিত, বিশেষ করে সেসমস্ত এলাকায় যেখানে মাখন খুব সহজলভ্য। এমনকি এই পদ্ধতি মিলিটারি সার্জন জেনারেল ফ্রেডরিখ ভন এসমার্খ কর্তৃক সুপারিশকৃত, যিনি প্রাথমিক চিকিৎসার জনক এবং এর প্রসারণে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। খোলা বাতাসে অধিকাংশ পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানই অনেক কষ্টদায়ক। এই ক্ষতস্থানকে শীতল কিছু, যেমন মাখন দ্বারা ঢেকে রাখলে কিছু সময়ের জন্য জ্বালাপোড়া থেকে স্বস্তি পাওয়া যায় বটে, কিন্তু খুব দ্রুতই সেই ব্যথা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এর কারণ সেই ক্ষতস্থানকে সম্পূর্ণ ঠান্ডা করার আগেই শীতল কিছু দ্বারা বদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, যার ফলে সেই ক্ষতস্থানের চামড়া পুড়তেই থাকবে।

পুড়ে যাওয়া স্থানে মাখন লাগানো; Source: World Wide Wounds

সঠিক ধারণা: পুড়ে যাওয়া স্থানে পানি দেওয়া

প্রায় সকল ধরনের পোড়াস্থানে প্রথম করণীয় বিষয় হচ্ছে, পুড়ে যাওয়া জায়গার সাথে লেগে থাকা যেকোনো কিছু না সরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রচুর পরিমাণে ঠান্ডা পানি দেওয়া। পানি দেওয়ার এই সময়কাল অবশ্যই যত বেশি হয় ততই ভালো, অন্তত ২০ মিনিট। দীর্ঘক্ষণ ধরে ঠান্ডা পানি ঢালার উদ্দেশ্য জায়গাটাকে পুরোপুরি ঠান্ডা করা এবং সাথে সাথে অসাড় করে ফেলা। ক্ষতস্থানটি সম্পূর্ণরূপে ঠান্ডা হওয়ার পর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে বা জড়িয়ে রাখা যেতে পারে যেন সেখানে জীবাণুর সংক্রমণ না ঘটে।

পোড়া স্থানে ঠাণ্ডা পানি দিন; Source: WISEgeek

কখন ক্ষতস্থানে মাখন লাগানো যেতে পারে

যদি গরম আলকাতরা বা এ ধরনের ভারি কোনো পদার্থ দ্বারা চামড়া পুড়ে যায় তখন সে স্থানে শীতল মাখন লাগানো ভালো। মাখনের তৈলাক্ততা এসব ভারি পদার্থ অপসারণে সহায়তা করে এবং জ্বালাপোড়া ধীরে ধীরে কমিয়ে আনে।

২. প্রচলিত ধারণা: সবার ক্ষেত্রে চেস্ট কম্প্রেশনের প্রয়োজন নেই

চেস্ট কম্প্রেশন হচ্ছে সেই পদ্ধতি যা দ্বারা খালি হাতে হৃদপিন্ড বরাবর চাপ দিয়ে থেমে যাওয়া হৃদপিন্ডকে সচল করা সম্ভব। এই পদ্ধতিকে সিপিআরও বলা হয়। যদি কারো হৃদপিন্ড থেমে যায় তবে হাসপাতালে নেওয়া বা মেডিকেল সাহায্য আসার আগে এটি হচ্ছে তার বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা। কিন্তু অনেকেই নিশ্চিত না হয়ে এ ধরনের রোগীকে সিপিআর দিতে চান না। অনেকে মনে করেন, রোগীর যদি চেস্ট কম্প্রেশনের প্রয়োজন না হয় তবে তা ভালোর চেয়ে মন্দই হবে।

সিপিআর বা চেস্ট কম্প্রেশন; Source: men’s health

সঠিক ধারণা: যে কারো ক্ষেত্রে চেস্ট কম্প্রেশনে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম

যদি আপনি প্রাথমিক চিকিৎসার কোর্স করতে যান সেখানে আপনি শিখবেন কীভাবে পালস চেক করতে হয়, বুকের কাছে কান নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে হয়। যদি এগুলোর কিছুই না পাওয়া যায় তবে সঙ্গে সঙ্গে ইমারজেন্সি সার্ভিসে খবর দিয়ে সিপিআর দেওয়া শুরু করতে হয়। আপনি যদি নিশ্চিত না হয়ে থাকেন যে, রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক কিনা তবুও আপনি সিপিআর শুরু করতে পারেন।  জাপানের ইয়োকোহামায় এই বিষয় নিয়ে একটি জরিপ চালিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, এ ধরনের সিপিআর রোগীদের আরো বড় ঝুঁকিতে ফেলে দেয় কিনা।

৯১০ জন রোগীর উপর চালানো এই জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ২৬ জন রোগীর জন্য এই অপ্রয়োজনীয় সিপিআর কিছু সমস্যা তৈরি করেছে, যেমন- মাইনর রিব ফ্র্যাকচার, কিন্তু তা মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কাজেই আপনি নিশ্চিত না হলেও যদি মনে করেন, তবে সিপিআর দিতে দেরি করবেন না। বলা যায় না, এভাবেই হয়তো একজন রোগীর জীবন আপনি বাঁচিয়ে দিতে পারেন!

৩. প্রচলিত ধারণা: মুখে মুখ লাগিয়ে প্রশ্বাস দেওয়া এবং চেস্ট কম্প্রেশন করাই হচ্ছে সঠিক সিপিআর

সিপিআর করার নির্দেশনা গত দশকে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। রোগীর বুকে ১৫ বার দ্রুত চাপ দেওয়া, এরপর মুখে ২ বার প্রশ্বাস দেওয়া এবং এই দুই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে আদর্শ সিপিআর এর প্রক্রিয়া। এরপর আবিষ্কৃত হয় ২ বার প্রশ্বাস এবং এরপর ৩০ বার বুকে চাপ দেয়াও আসলে আগের পদ্ধতির মতোই সমান কার্যকরী। আর এই পদ্ধতিটাকেই আদর্শ নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং জরুরি সময়ে এই নির্দেশনাগুলোই দেওয়া হতো।

মুখে মুখ লাগিয়ে বাতাস দিয়ে সিপিআর জরুরি নয়; Source: First Aid for Life

সঠিক ধারণা: মুখে মুখ লাগিয়ে প্রশ্বাস দেওয়া সবসময় জরুরি নয়

উপরের ঘটনাগুলোর পর চিকিৎসকদের পরবর্তী আইডিয়া ছিলো রোগীর মুখে কোনো প্রশ্বাস দেওয়া ছাড়াই সিপিআর করা এবং পর্যবেক্ষণ করা যে, এতে কোনো ক্ষতি হয় কিনা। একটু বিরতি দিয়ে বুকে চাপ দিতে থাকলে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যদিও এতে রক্ত পুরোপুরিভাবে পরিশোধিত হয় না কিন্তু তবুও তা দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে। উপরোক্ত ৩টি পদ্ধতি বিভিন্নভাবে তুলনা করে দেখা যায়, শুধুমাত্র ২টির মাঝে কিছু পার্থক্য পাওয়া যায়। কিন্তু যখন এসব পরিসংখ্যান উপাত্ত থেকে ফলাফলগুলো একত্রিত করা হলো তখন দেখা গেলো, যে সমস্ত ক্ষেত্রে ইমারজেন্সি সার্ভিস থেকে শোনা নির্দেশনায় প্রশ্বাস মুখে না দিয়ে শুধু বুকে চাপ দেওয়া হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে রোগীর সুস্থ হবার সম্ভাবনা প্রায় ২২% বেড়ে গিয়েছে (ফলাফলগুলোতে শিশুদের এবং ডুবে যাওয়া ব্যক্তিদের ঘটনাগুলো বাদ দেয়া হয়েছে, কারণ এসব ক্ষেত্রে রোগীর মুখে প্রশ্বাস দেয়াটা জরুরি)।

সুস্থ হবার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ায় যে বড় সম্ভাবনাটি তৈরি হয়েছে তা হলো এ ধরনের ঘটনা ঘটলে যে কেউই এখন এই সেবাটি প্রদান করতে উৎসাহিত হবে। আর যেহেতু এটা শুধুই বুকে চাপ দেয়া তাই নির্দেশনাও খুব সহজ। যদিও অনেকেই এখনো রোগীর বুকে চাপ দিয়ে সিপিআর করার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। এমন একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, হঠাৎ হৃদপিন্ড সংক্রান্ত জটিলতার প্রায় ২০,০০০ ঘটনার ক্ষেত্রে প্রায় ৪৫% পুরুষ রোগী যে কারো কাছ থেকে সিপিআর পেয়েছেন যেখানে মহিলা রোগীর ক্ষেত্রে হারটা ৩৯%, কারণ অনেকেই মহিলাদের সিপিআর করার সময় ইতস্তত করেন।

৪. প্রচলিত ধারণা: নাক দিয়ে রক্ত পড়া রোধ করতে মাথা পেছনে হেলে রাখতে হয়

এটি খুব সাধারণ একটি ধারণা। অনেক কারণেই নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। আমরা খুব ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি, যে কারণেই হোক নাক দিয়ে রক্ত পড়লে মাথা পিছন দিকে হেলান দিয়ে রাখতে হয় বা মাথা উঁচু করে রাখতে হবে। এতে রক্ত আর বের হতে পারবে না। কিন্তু এটি আসলে ভুল ধারণা

সঠিক ধারণা: নাক দিয়ে রক্ত পড়লে সামনে ঝুঁকে থাকা উচিত

মাথা পেছনে হেলান দিয়ে রাখলে রক্ত নাকের ভেতর দিয়ে গলা হয়ে পাকস্থলিতে প্রবেশ করতে পারে অথবা শ্বাসনালীতে আটকে কাশির উদ্রেক হতে পারে যা আরো ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। তাই নাক দিয়ে রক্ত পড়লে কখনোই মাথা পেছনে হেলান দিয়ে রাখা উচিত নয়। এর বদলে আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে নাকের নরম অংশে চাপ দিয়ে ধরে রাখতে পারি এবং সামনের দিকে ১০ মিনিট ঝুঁকে থাকতে পারি। এতে রক্ত পড়া বন্ধ হতে পারে বা ক্ষতস্থান থাকলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। কিন্তু যদি ৩০ মিনিটের মাঝে রক্ত পড়া বন্ধ না হয় তবে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

৫. প্রচলিত ধারণা: হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে শুয়ে পড়া উচিত

এটাও আমাদের মাঝে প্রচলিত খুব ভ্রান্ত একটি ধারণা। আমরা মনে করি, কোনো রোগে আক্রান্ত হলে মানুষের শুয়ে থাকা উচিত। ঠিক একইভাবে যদি কেউ হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয় আমরা তাকে শুইয়ে দিই। আমরা মনে করি, এতে হৃদরোগী একটু শান্তি পেতে পারে বা ব্যথা একটু কম লাগতে পারে। কিন্তু এটিও একটি ভুল ধারণা।

হৃদরোগে আক্রান্ত হলে শুয়ে পড়া উচিৎ নয়; Source: Reader’s digest

সঠিক ধারণা: হৃদরোগে আক্রান্ত হলে বসে পড়া উচিত

হঠাৎ কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে শুইয়ে দেওয়া উচিত নয়। কারণ এতে তার নিঃশ্বাস নিতে অনেক বেশি কষ্ট হয়। প্রথমত, তখন কিছুটা শ্বাস কষ্ট শুরু হয় এবং দ্বিতীয়ত শোয়া অবস্থায় নিঃশ্বাস নেয়াটা অনেক কঠিন। এর পরিবর্তে তাকে হাঁটু ভাঁজ করে একটি চেয়ারে বসানো উচিত এবং সহজে চেয়ারে ঠেস দেওয়ার জন্য পিঠে একটি বালিশ বা তেমন কিছু দেওয়া উচিত। এতে তার নিঃশ্বাস নেওয়াটা সহজতর হয় এবং রোগী কিছুটা শান্তি পায়। এরপর অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, কারণ এটি অবশ্যই হঠাৎ ঘটে যাওয়া হৃদরোগের প্রতিকার নয়।

প্রাথমিক চিকিৎসা খুব কার্যকরী একটি পদক্ষেপ এবং এর মাধ্যমে অনেকক্ষেত্রেই রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসার পদ্ধতিগুলো সঠিকভাবে সবারই জানা জরুরি। এতে আপনার আশেপাশের মানুষের হঠাৎ মৃত্যু বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। তাই আমাদের সবারই উচিৎ প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং অন্যকে এই শিক্ষা নিতে উৎসাহিত করা।

ফিচার ইমেজ: Northrock Safety

Related Articles