শরীর জুড়ানো ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। আর্দ্রতাহীন চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল দিন। এরকম দিনে আমরা সবাই প্রফুল্ল বোধ করি, কাজে বেশ মনোযোগ দিতে পারি। সবমিলিয়ে দারুণ কমব্যস্ত ও সুখী একটা সময় কাটে। অন্যদিকে, ঝড়বৃষ্টিময় মেঘলা দিনে আমরা সবাই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ি। কাজকর্মে ভাটা পড়ে, মনটা কেমন বিষন্ন আর উদাস হয়ে যায়। তীব্র শীত, তীব্র গরম, অতিরিক্ত আর্দ্রতা কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়।
যদিও শীতপ্রধান দেশের মানুষেরা শীতের সাথে এবং মরুভূমির দেশের লোকের তীব্র গরমে মানিয়ে নিয়ে দৈনন্দিন জীবন বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সীমার পর মেরুর বরফে বা আগ্নেয়গিরির গভীরে গিয়ে মানুষের পক্ষে গরম বা ঠান্ডা সহ্য করা সম্ভব না। সেই চরম গরম বা পরম শীতে মানুষের মৃত্যু হয়ে ওঠে অনিবার্য। শুধু মানুষ কেন, বেশিরভাগ জটিল বহুকোষী প্রাণীরও একই অবস্থা। তাহলে এমন চরম প্রতিকূল পরিবেশে জীবনের অস্তিত্ত্ব কি একেবারেই অসম্ভব? মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক। অর্থাৎ চরম প্রতিকূল পরিবেশেও প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব।
যারা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে তাদের বলা হয় 'এক্সট্রিমোফাইল'। বেশিরভাগ এক্সট্রিমোফাইলই অনুজীব। ১৯৭৪ সালে আর. ডি. ম্যাকেলরয় নামের একজন বিজ্ঞানী একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু এই অনুজীবগুলো শুধু প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। এরা স্বাভাবিক ও অনুকূল পরিবেশে একেবারেই বাঁচতে পারে না। আপনি যেমন চরম অনুকূল পরিবেশে বাস করতে ভালবাসেন, এরাও তেমনি চরম প্রতিকূল পরিবেশে বাস করতে ভীষণ ভালবাসে। এজন্যই এদের নামের শেষে 'phile' যুক্ত হয়েছে, যার অর্থ 'one who loves', অর্থাৎ যে ভালবাসে।
চরম প্রতিকূল পরিবেশ কী?
তাপ, চাপ, পানি, অক্সিজেন এগুলো আমাদের পরিবেশের চিরচেনা উপাদান। এই উপাদানগুলোই মূলত কোনো পরিবেশকে অনুকূল বা প্রতিকূল করতে ভূমিকা রাখে। মানুষের জীবনধারণের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন, পানি, অনুকূল তাপমাত্রা জরুরি। এই উপাদানগুলোর ভারসাম্যই পরিবেশকে মানুষ বাসের উপযোগী করে। কিন্তু পরিবেশে এই উপাদানগুলো যদি খুবই কম বা খুব বেশি হয়ে যায়, তাহলে পরিবেশ আর অনুকূল থাকে না, হয়ে যায় প্রতিকূল। এই প্রতিকূলতারও আবার মাত্রা আছে।
৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পরিবেশকে সামান্য প্রতিকূল বলা যায়। সাধারণ অনুজীব এই পরিবেশে টিকতে পারে। কিন্তু এক্সট্রিমোফাইলরা পারমাণবিক চুল্লি, আগ্নেয়গিরি, আর্কটিকের বরফের তলায়, অক্সিজেনের অভাবযুক্ত এলাকা, সমুদ্রের পানির চেয়ে অনেক বেশি লবণাক্ত পানিতে প্রভৃতি জায়গায়, যেখানে একসময় প্রাণের অস্তিত্ব অকল্পনীয় ছিল, সেখানেও দিব্যি বেঁচে থাকে।
এন্টার্কটিকার হ্রদ আন্টারসি চরম প্রতিকূল পরিবেশের চমৎকার উদাহরণ। এই হ্রদ মিথেন গ্যাস দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ। এর pH ডিজারজেন্টের সমপরিমাণ। ভীষণ ঠান্ডা, প্রচুর মিথেন- সব মিলিয়ে এই হ্রদের পরিবেশ অনেকটা বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপার মতো।
এক্সট্রিমোফাইল কারা?
তিন ডোমেইন শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি অনুসারে আর্কি, ইউব্যাকটেরিয়া, ইউক্যারিয়া তিনটি শ্রেণীর জীবই এক্সট্রিমোফাইল হতে পারে। আর্কিরা বিশেষ ধরনের এককোষী অণুজীব।
এদের গঠন ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে আলাদা। এরা বিশেষত্বপূর্ণ কোষঝিল্লীর কারণে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। আর ইউব্যাকটেরিয়ারা হচ্ছে আমাদের চিরপরিচিত ব্যাকটেরিয়া, যারা আমাদের শরীরে নানারকম রোগ ছড়িয়ে বেড়ায়। ইউক্যারিয়া বা ইউক্যারিওট হচ্ছে জটিল বহুকোষী জীব। বহুকোষীদের মধ্যে এক্সট্রিমোফাইলের সংখ্যা খুব অল্পই। ইস্ট এক্সট্রিমোফাইল জগতের সদস্য।
এক্সট্রিমোফাইলের শ্রেণীবিন্যাস
এসিডোফাইল
মানুষ সাধারণত ৬.৫ থেকে ৭.৫ মাত্রার pH এ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু এসিডোফাইলরা যেখানে pH ০ থেকে ৫, সেখানেও অনায়াসে জীবন চালিয়ে নেয়। আমাদের পাকস্থলীর পরিবেশও ভীষণ অম্লীয়। এখানেও কিছু এক্সট্রিমোফাইল পাওয়া গেছে। ধাতুকে গলিয়ে দেয়ার মতো অম্লীয় পরিবেশে এসিডোফাইলরা টিকে থাকে এদের বিশেষ গঠনের কোষঝিল্লীর কল্যাণে। এদের কেউ কেউ বায়োফিল্ম তৈরি করে, যা তাদের কোষঝিল্লীকে প্রতিরক্ষা দেয়। কিছু কিছু অনুজীব আবার শরীরের অভ্যন্তরীণ pH নিয়ন্ত্রণ করে একে সহনীয় মাত্রায় রাখে।
অ্যালকেলিফাইল
প্রচন্ড ক্ষারীয় পরিবেশে যেসব এক্সট্রিমোফাইল বাস করে তাদেরকে বলা হয় অ্যালকেলিফাইল। এদের উপর বাইরের ক্ষারীয় পরিবেশে কোনো প্রভাব পড়ে না, কারণ শরীরের অভ্যন্তরীণ pH এর মাত্রা কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এদের শরীরে বেশ কিছু এনজাইম আছে, যারা এ কাজে সহায়তা করে।
অ্যালকেলিফাইলের একটা উদাহরণ হচ্ছে Spirochaeta americana। এটি একটি ব্যাকটেরিয়া, যা যুক্তরাষ্ট্রের মনো হ্রদে বাস করে। মনো হ্রদে pH ৮ থেকে ১০।
এর পানিতে কোনো অক্সিজেন থাকে না। এর সালফারযুক্ত কাদামাটিতে কোনোরকম অক্সিজেনের সরবরাহ ছাড়াই এই ব্যাকটেরিয়াগুলো মহানন্দে বেঁচে থাকে।
থার্মোফাইল
থার্মোফাইলরা ৪৫ থেকে ১২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও জীবনধারণ করতে পারে। ১৯৬০ সালে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের গরম ঝর্ণায় তাপরোধী ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কৃত হয়, যার নাম রাখা হয় Thermus aqiticus। এরা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বিকশিত হতে পারে। মহাসমুদ্রের তলদেশে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে যেখানে পানি ৩৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটতে থাকে, সেখানেও জীবন্ত ব্যাকটেরিয়াদের বাস করতে দেখা গেছে।
সাধারণত উচ্চ তাপমাত্রায় শরীরের সব প্রোটিন ভেঙে যায়। কিন্তু এক্সট্রিমোফাইলদের প্রোটিন তাপমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। এদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে সিস্টিন অ্যামিনো এসিড থাকে। আর থাকে ডাইসালফাইড বন্ধন। ডাইসালফাইড বন্ধন প্রোটিন ভেঙে গেলে সেগুলো আবার জোড়া লাগিয়ে ফেলে।
সাইক্রোফাইল
এরা তীব্র ঠান্ডায় বেঁচে থাকে। -১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রচন্ড শীতল সমুদ্রেও এরা বৃদ্ধি পায় ও বিকশিত হয়। প্রচন্ড ঠান্ডা মাটিতে বা মেরুর বরফেও এরা পরমসুখে বাস করতে পারে। এদের অ্যামিনো এসিডগুলো অতিরিক্ত ঠান্ডায় খাপ খাওয়ানোর জন্য অভিযোজিত।
তেজস্ক্রিয় প্রতিরোধক
মানুষ যে তেজস্ক্রিয়তায় মারা যায়, এরা তার চেয়ে পাঁচশগুণ তেজস্ক্রিয়তার মুখে বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে পারে। চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লিতে এরকম অনুজীব পাওয়া গেছে। এছাড়া রয়েছে লবণপ্রমী হ্যালোফাইল, তীব্র শুষ্ক পরিবেশ বেঁচে থাকা জেরোফাইল ইত্যাদি।
মানবসভ্যতায় এক্সট্রিমোফাইলের অবদান
শিল্পক্ষেত্রে ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক্সট্রিমোফাইলরা বেশ ভালই অবদান রেখেছে। অ্যালকেলিফাইলদের শরীর থেকে প্রাপ্ত এনজাইম দিয়ে ডিটারজেন্ট বানানো হয় ও কাপড় পরিষ্কার করা হয়। পেপার ব্লিচিংয়েও এসব এনজাইম ব্যবহৃত হয়। নাসা Deinococcus radiodurans নামের একটি ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছে। এটি একটি তেজস্ক্রিয়তা সহনশীল ব্যাকটেরিয়া।
সাধারণত তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এলে ডিএনএ ভেঙে যায়। কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়ার DNA তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে পুনর্বিন্যস্ত হয় ও স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। নাসা এই গবেষণা থেকে তেজস্ক্রিয়তা নিরোধক স্পেসস্যুট তৈরি করতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়া এক্সট্রিমোফাইলে থাকা ডিএনএ পলিমারেজ (taq DNA polimerase) এনজাইম পিসিআর প্রযুক্তিতে ব্যবহার হয়ে আসছে, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।
এক্সট্রিমোফাইল ও মহাকাশীয় অণুজীব
মহাবিশ্বে জীবনের বিকাশ কীভাবে হলো সেটাই মূলত মহাকাশীয় অণুজীববিদ্যার আলোচ্য বিষয়। পৃথিবীর বাইরে সৌরজগতের বেশির ভাগ গ্রহ-উপগ্রহই তীব্র শীতল। তাই এক্সট্রিমোফাইল গবেষণা পৃথিবীর বাইরে কোথাও প্রাণের বিকাশ হয়েছিল কি না সে সম্পর্কে জানার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। শুধু মহাবিশ্বেই নয়, খোদ পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল সেটি নিয়েও গবেষণা করা যাবে।
This is an article about the organism who survive in extreme environment. In this article, the type, importance of these organism called extremophiles are disscused. All the information sources are hyperlinked inside the article.
Feature Image: news.stanford.edu