Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রজেরিয়া: বৃদ্ধ শরীরে যখন শিশুর আত্মা

মামুনের এখন দিন কাটে বলতে গেলে ঘরের মধ্যেই। বাইরে বেরোতে চায় না একেবারেই। ওর মা-বাবাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আর কী বা করার করার ছিল তাদের, শুধু ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া? হয়তো তারা জীবনে বড় কোনো পাপ করেছেন, তারই শাস্তি নেমে এসেছে তাদের সন্তানের উপর। নইলে এমন হবে কেন? ছেলের মাত্র বয়স ৯ বছর কিন্তু দেখলে মনে হয় যেন ৮৯ বছরের কোনো বৃদ্ধ। মুখের চামড়ায় পড়েছে শত শত বলিরেখা। শীর্ণকায় আর দুর্বল মামুনের মুখের হাসি দেখলে তার মা-বাবা নিজেদের সামলাতে পারেন না। কিন্তু তাদের তো কিছুই করার নেই! ডাক্তার তো কম দেখাননি। বিদেশেও নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু সব জায়গায় একই উত্তর পেয়েছেন- মামুন প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত। তাদের কিছুই করার নেই। কোনো ওষুধ নেই এ রোগের।

দেখতে বয়স্ক মনে হলেও সে একজন শিশু; Source: pinterest

প্রজেরিয়া এমন একটি অসুখ, যার পরিণতি বড়ই নির্মম। মামুন যে প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত সেটি একটি বিরল অটোসোমাল ডমিন্যান্ট জেনেটিক ডিজঅর্ডার, এ রোগের লক্ষণ অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়া। প্রজেরিয়া শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Progeras থেকে, যার অর্থ অল্পবয়সী বৃদ্ধ। প্রজেরিয়া একটি জেনেটিক রোগ হলেও এটি বংশগত রোগ নয়। এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা সন্তান জন্মদানের বয়সে পৌঁছানোর আগেই সাধারণত মৃত্যুবরণ করে। অপরদিকে এটি একটি ডমিন্যান্ট জেনেটিক ডিজঅর্ডার হওয়ায়, কারো শরীরে প্রজেরিয়ার জিন থাকলেই সে এই প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত হবেই। তাহলে এই ভয়ানক রোগটি মানুষের ভেতরে আসে কিভাবে?

আমাদের দেহের ডিএনএ-তে একটি জিন আছে, নাম এলএমএনএ (LMNA) জিন। এটি ল্যামিন এ নামক একটি প্রোটিন তৈরি করে যা কোষের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এলএমএনএ জিনের ১৮২৪ নাম্বার নিউক্লিওটাইড বেস এর সাইটোসিন নামের এমাইনো এসিডটি থাইমিন নামক এমাইনো এসিড দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়, যার ফলশ্রুতিতে জন্ম হয় প্রজেরিন নামক একটি প্রোটিন। এটি কোষের নিউক্লিয়াসকে অস্থিতিশীল করে তোলে, যা মানুষের বুড়িয়ে যাওয়ার হারকে ত্বরান্বিত করে। ফলে জন্ম নেয় ঘাতক প্রজেরিয়া রোগ।

সুস্থ ও আক্রান্ত নিউক্লিয়াস; Source: fredhutch.org

সাধারণত জরায়ুতে ভ্রূণ যখন গঠিত হয়, তখন এই মিউটেশন সম্পন্ন হয়। যদি কারো মাঝে এই ভয়ানক প্রোটিন জন্ম নিয়ে থাকে, তাহলে তার জন্মের কয়েক মাসের ভেতরই প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পায়। ঠিকঠাক যত্ন নেওয়া সত্ত্বেও শিশুর ওজন ঠিকমতো বাড়ে না। সেই সাথে ত্বকেও পরিবর্তন আসে। আস্তে আস্তে তার দেহে অন্যান্য লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় সীমাবদ্ধ শারীরিক বিকাশের হার অত্যন্ত কম থাকে এদের দেহে। চুল পড়ে যায়, এমনকি চোখের পাতা, ভ্রু সহ সারা শরীরের লোম পড়ে যায়।

ছোট মুখমণ্ডল, ডেবে যাওয়া চোয়াল এবং চাপা নাক এগুলো প্রজেরিয়ারই লক্ষণ। বয়স যত বৃদ্ধি পায়, প্রজেরিয়ার লক্ষণ ততই প্রকট হয়। দেহের তুলনায় মাথা অনেক বড় দেখায়। বড় বড় জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে একটি অসহায় শিশু, যার মাথায় চুল পড়ে যাওয়ার কারণে শিরা-উপশিরা যেন ত্বক ভেদ করে বাইরে উঁকি মারে। দাঁতগুলো খুবই ছোট ছোট হয়, কিন্তু কণ্ঠস্বর থাকে তীক্ষ্ণ। শরীরে মাংস ও চর্বি কম থাকার কারণে দেহ শীর্ণকায় হয়ে যায়। আস্তে আস্তে চামড়ায় ভাঁজ পড়ে, কিডনির রোগে দেহ নাকাল হয়ে পড়ে। চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার সাথে সাথে হৃদপিণ্ডে সমস্যা দেখা যায়। প্রজেরিয়ায় দেহের ত্বক শক্ত হয়ে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ।

তবে শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলেও তাদের মানসিক বিকাশে কিন্তু কোনো প্রভাব পড়ে না। তাদের মানসিক বুদ্ধি গড়পড়তা মানুষের মতোই হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের থেকে বেশি- এমনটিও দেখা গিয়েছে। তাদের যৌন বৈশিষ্ট্য স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে। যেহেতু ১৩ বছর তাদের গড় বয়স, তাই তাদের সন্তান জন্মদান করার সুযোগ খুব কমই আসে। তবে এমনটি যে একেবারেই ঘটেনি তা নয়। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত আমেরিকান জার্নাল অব মেডিকেল সায়েন্সের ৬ নাম্বার ভলিউমে প্রজেরিয়া আক্রান্ত একজন মেয়ের সন্তান জন্মদানের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, সন্তানটি সুস্থ সবল হয়েই জন্ম নিয়েছিলো।

জোনাথন হাচিনসন; Source: Look For Diagnosis

এই রোগ সম্পর্কে ১৮৮৬ সালে জোনাথন হাচিনসন সর্বপ্রথম মানুষের সামনে তুলে ধরেন। পরবর্তীতে হাস্টিং গিলফোর্ড এই রোগ সম্পর্কে পুনরায় স্বাধীনভাবে বর্ণনা করেন। তাই এই রোগকে হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রজেরিয়া সিনড্রোমও বলা হয়।

প্রজেরিয়ার রোগ নির্ণয় সাধারণত ক্লিনিক্যাল অর্থাৎ ডাক্তার তার দক্ষতা জায়গায় বসে রোগীর প্রাসঙ্গিক তথ্য থেকেই রোগ নির্ণয় করেন। তবে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হওযার জন্য এলএমএনএ জিনের মিউটেশন আছে কিনা তা দেখা হয়। প্রজেরিয়া রোগ একটি জেনেটিক অসুখ হওয়ার এর কোনো চিকিৎসা নেই। সাধারণত প্রজেরিয়া রোগের চিকিৎসায় উদ্ভুত সমস্যাগুলোর প্রতিকারের চেষ্টা করা হয়। হৃদরোগের ক্ষেত্রে করোনারি ধমনীর বাইপাস সার্জারি করা হয়। প্রয়োজনানুসারে স্বল্প মাত্রার এসপিরিন প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু এগুলো করেও বিশেষ লাভ হয় না।

প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের গড় জীবন সীমা ১৩ বছর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকের শিকার হয়ে মারা যায়। তবে মন্দের ভালো এই যে, প্রজেরিয়া অত্যন্ত বিরল একটি রোগ। নেদারল্যান্ডে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রজেরিয়ায় আক্রান্তের হার প্রতি চল্লিশ লক্ষে একজন। এই মুহূর্তে বিশ্বে ১০০ জনের মতো প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী রয়েছে।

মোটের উপর আজ পর্যন্ত ১৫০টির মতো রোগের বর্ণনা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে। অবশ্য প্রজেরিয়া গবেষণা ফাউন্ডেশনের মতে, গোটা বিশ্বে এই মুহুর্তে আরো একশো পঞ্চাশের মতো প্রজেরিয়া আক্রান্ত রোগী রয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রজেরিয়া আক্রান্ত মানুষদের জীবন যে একেবারে ব্যর্থ তা বলা কিন্তু মোটেও ঠিক হবে না।

১৯৮৬ সালে মিকি হে’স দ্য অরোরা এনকাউন্টার নামের একটি চলচ্চিত্রে এলিয়েনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তার সাথে ছিলেন আরেক বিখ্যাত অভিনেতা জ্যাক এলাম। ১৯৮৭ সালে মিকি হেস এবং জন এলাম একটি ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্রে অভিনয় করেন। নাম আই এম নট ফ্রিক (I am not a Freak)। মিকি হেস ১৯৯২ সালে ২০ বছর বয়সে মারা যান।

দক্ষিণ আফ্রিকান হিপহপ শিল্পী লিয়ন বোথা কজন প্রজেরিয়ার রোগী ছিলেন। তিনি অবশ্য প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত মানুষদের ভেতরে সবথেকে বেশি দিন বেঁচে থাকা মানুষদের একজন। লিয়ন বোথা ২০১১ সালে মারা যান।

ম্যাসাচুসেটসের Foxborough High School এর ছাত্র স্যাম বার্নকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল Life According to Sam নামের একটি ডকুমেন্টারি। স্যাম বার্ন একবার একটি ডকুমেন্টারিতে বলেছিলেন, আমার সম্পর্কে মানুষকে যা আমি জানতে চায়, তা হলো আমার সুখী কিনা। স্যাম ২০১৪ সালে মারা যান।

স্যাম বার্ন; Source: HBO

২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত Renaissance চলচিত্রে প্রজেরিয়া বিষয়টি স্থান পেয়েছিলো। ট্যাড উইলিয়ামের উপন্যাস সিরিজের একটি চরিত্রকে আমরা প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত হিসেবে দেখতে পাই। বলিউডে মুক্তিপ্রাপ্ত অভিষেক বচ্চন এর বিদ্যা বালান অভিনীত ‘পা’ চলচ্চিত্রের কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। সেখানে অমিতাভ বচ্চন প্রজেরিয়া আক্রান্ত একটি শিশুর চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

মুম্বাইয়ের নিহাল বিটলা সামাজিক মাধ্যমে প্রজেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রচার চালাতেন। ২০১৬ সালে তিনি মারা যান। তিনি প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। প্রজেরিয়া আক্রান্তরা দুর্ভাগ্যের শিকার ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃতির অদ্ভুত পরিহাসে তাদের বয়োবৃদ্ধ শরীরের লুকিয়ে আছে একটি কিশোর মন। তাই বলে তাদের জীবন ফেলনা নয়। অন্যান্য সবার মতই মূল্যবান। তারাও হাসি-আনন্দে দিন কাটানোর অধিকার রাখে। অধিকার রাখে জীবনটাকে উপভোগ করার-সুখী থাকার। যেমনটি স্যাম বার্ন বলেছিল, আমার সম্পর্কে মানুষকে যা আমি জানাতে চাই, তা হলো আমার একটি সুখী জীবন অতিবাহিত করেছি।

Feature Image: mb.ntd.tv

Related Articles