Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ট্যারা চোখ: কারণ ও চিকিৎসা

রাস্তাঘাটে চলার পথে বাঙ্গালী দু’ধরনের মানুষের দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকে, যেন তারা মানুষ নয়, আস্ত এলিয়েন। এক হলো পশ্চিমা ড্রেস পরা কোনো নারী আর দুই হলো ট্যারা চোখের মানুষ। একে রোগ না বলে বরং শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বললে আরও বেশী সঠিক হবে। তবে অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধীদের চেয়ে সমাজের এই মানুষগুলো মানসিকভাবেও অনেক বেশী সংপৃষ্ট থাকে। অথচ আমরা যারা দিব্যি সুস্থভাবে সুন্দর জীবনযাপন করছি, জন্মের সময় ক্ষুদ্র কিছু ভুলের জন্য হয়ত আমরাও এমন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আসতে পারতাম পৃথিবীতে।

কীভাবে কাজ করে ট্যারা চোখ?

চিকিৎসাবিজ্ঞানে ট্যারা চোখকে বলা হয় স্কুইন্ট বা স্ট্রাবিসমাস। ট্যারা চোখের দুনিয়া দেখতে কেমন তা অনেকেরই কৌতূহলের বিষয়।আমরা প্রায় সবাই-ই চোখের কার্যপদ্ধতির সাথে পরিচিত। চোখ যেভাবে কাজ করে তার আদলেই ১৮৮৮ সালে তৈরি হয়েছিল ফিল্ম ক্যামেরা, যা আমরা কয়েক বছর আগেও (ডিজিটাল ক্যামেরা আসার পূর্বে) শখের ছবি তুলতে হরহামেশাই ব্যবহার করতাম।

চোখের কার্যক্রমকে অনুসরণ করেই তৈরি হয়েছিল ফিল্ম ক্যামেরা; source: bitlanders.com

ফিল্ম ক্যামেরায় থাকে ফিল্ম রিল, যা ব্যটারির মতো আলাদা করে সংযুক্ত করতে হয়। এই ফিল্ম রিলের ছোট ছোট প্লেটে নেগেটিভ ছবি ধরা পড়ে যখন আমরা ক্লিক করি। এখানে কাজ করে একটি লেন্স আর একটি শাটার। মানুষের চোখে শাটারের কাজটি করে চোখের পাতা, যা চোখের লেন্সের মধ্য দিয়ে আলো প্রবেশ করতে সাহায্য করে এবং আমাদের মহা মূল্যবান রেটিনাই হলো ক্যামেরার ফিল্ম রিল। যখন বাইরের আলো আমাদের চোখের লেন্স এবং কর্নিয়া হয়ে রেটিনায় পড়ে, তখন আমাদের মস্তিষ্কে দর্শনানুভূতি তৈরি হয়।

স্বাভাবিক চোখের ক্ষেত্রে আমরা যখন কোনোদিকে তাকাই, দুটি চোখ একইসাথে একইদিকে ফোকাস করে। কিন্তু স্কুইন্ট আক্রান্ত চোখের ক্ষেত্রে একটি চোখ সামনে কিছুর দিকে ফোকাস করলে অন্য চোখটি সেদিকে না তাকিয়ে বরং ডানে-বামে, উপরে-নিচে অন্য কোনো দিকে ফোকাস করে। যার ফলে আক্রান্ত চোখটির মধ্য দিয়ে আলোকরশ্মি রেটিনার সংবেদনশীল অংশে পৌঁছতে পারে না এবং সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় তার কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। একসময় আক্রান্ত চোখটি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় দুটো চোখই কার্যক্ষম থাকে, তবে ফোকাস একইদিকে না হওয়ায় ব্যক্তি ঝাপসা দেখে। একে বলা হয় এমব্লায়োপিয়া, যার বাংলা অলস চোখ। ১০-১২ বছরের মধ্যে বাঁকা চোখের চিকিৎসা না করালে এমব্লায়োপিয়া হতে পারে।

আর ট্যারা চোখ থাকা সত্ত্বেও যদি আক্রান্ত চোখ নষ্ট না হয়, সেক্ষেত্রে ব্যক্তি দুটো চোখ দিয়েই দেখার চেষ্টা করেন। ফলে তিনি ১টি জিনিসকে ২টি করে দেখতে পান। এর নাম ডিপ্লোপিয়া।

সুস্থ চোখ বন্ধ রেখে আক্রান্ত চোখকে ‘দেখা’ শেখানো হয়; source: priyo.com

লক্ষী ট্যারা কতটা লক্ষ্মী?

ট্যারা চোখ দেখতে অন্যরকম মনে হলেও হালকা বাঁকা চোখের একটা ভিন্ন সৌন্দর্য রয়েছে। সেখান থেকেই ‘লক্ষ্মীট্যারা’ নামের উদ্ভব। মূলত কোনো ট্যারাই লক্ষী নয়। ট্যারা চোখ মানুষের জীবনে শুধু সামাজিক বিপর্যয়ই নামিয়ে আনে না (বিশেষ করে যা লক্ষণীয় হয় মেয়েদের ক্ষেত্রে, বিয়ের পূর্বে), বরং ট্যারা চোখ ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টিশক্তিকে হ্রাস করে দেয়। তাই কোনো ট্যারাকে লক্ষী বলে প্রতিবন্ধকতাকে স্বাভাবিকতার কাতারে নিয়ে আসলে তা ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ট্যারা দেখতে কুৎসিত হোক আর সুন্দরই হোক- দ্রুত এর চিকিৎসা করা উচিত।

লক্ষীট্যারার আদরই একসময় শিশুর ভবিষ্যতে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে; source: alldubai.ae

ট্যারা চোখ কেন হয়?

বিভিন্ন কারণেই হতে পারে ট্যারা চোখ। অনেক সময় কারণ জানাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। জন্মগতভাবেও এই সমস্যা হতে পারে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘কনজেনিটাল স্কুইন্ট’ বলা হয়। এছাড়াও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন-

১। সময়ের অনেক আগেই জন্মানো শিশু বা কম ওজনের শিশুর ক্ষেত্রে ট্যারা চোখ দেখা যেতে পারে।
২। ছোট বেলায় কিছু ভাইরাল ইনফেকশনের কারণে হতে পারে।
৩। অনেক সময় শল্য চিকিৎসায় চোখের আঘাতজনিত কারণে হতে পারে।
৪। মায়োপিয়া বা হাইপারোপিয়া থাকলে হতে পারে।
৫। ডাউন সিন্ড্রোমের মতো জেনেটিক্যাল সমস্যা থাকলে হতে পারে।
৬। মস্তিষ্কে পানি জমলে হতে পারে।
৭। পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে চোখের ক্যান্সারের কারণে হতে পারে।
৮। চোখের মাংসপেশিকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু দুর্বল হয়ে গেলে অনিয়ন্ত্রিত মাংসপেশি চোখের স্বাভাবিক অবস্থাকে ধরে রাখতে পারে না, যার ফলে ট্যারা চোখ হতে পারে।
৯। যে সকল বাচ্চার চোখে রিফ্রাক্টিভ এরর অর্থাৎ পাওয়ার জনিত দৃষ্টিস্বল্পতা থাকে, তাদের স্থায়ী কিংবা সাময়িক সময়ের জন্য চোখ বাঁকা হয়ে যেতে পারে।

কীভাবে নির্ণয় করা হয় এই প্রতিবন্ধকতা?

শিশুদের ক্ষেত্রে ট্যারা চোখের কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এক্ষেত্রে মা-বাবাকে সচেতন থাকতে হবে সবসময়। শিশু যদি খুব কাছে গিয়ে টিভি দেখে, তাহলে বুঝতে হবে তার চোখের দৃষ্টিস্বল্পতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এছাড়াও কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যেমন বাঁকা করে কোনো কিছুর দিকে তাকানো, চোখ চুলকানো, চোখ লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

ট্যারা চোখের চিকিৎসা

জন্মের সাথে সাথেই শিশুর ট্যারা চোখ ধরা পড়ে না। তবে তিন বছরের মধ্যেই বোঝা যায় শিশুর এই অস্বাভাবিকতা। সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে দ্বি-দৃষ্টি সমস্যাটি দেখা যায় না, কারণ বাচ্চার গঠনশীল মস্তিষ্ক নিজেই এই সমস্যাটি প্রতিকার করার চেষ্টা করে আর যদি তা না পারে তবে মস্তিষ্ক আক্রান্ত চোখের ‘দেখা’-র ক্ষমতা বন্ধ করে দেয়। তাই শিশুর ট্যারা চোখ বুঝতে পারার সাথে সাথেই খুব দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী। বয়স বাড়ার আগে চিকিৎসা করালে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়া থেকে চোখকে বাঁচানো যেতে পারে।

ট্যারা চোখের চিকিৎসার পূর্বে এর সঠিক কারণ জানা আবশ্যক। যাদের দৃষ্টিস্বল্পতার কারণে চোখ বাঁকা হয়ে থাকে, চশমার মাধ্যমে দৃষ্টিস্বল্পতার চিকিৎসা করালে তাদের ট্যারা চোখ ভালো হতে পারে। তবে সব ট্যারা চোখের কারণ দৃষ্টিস্বল্পতা নয়। তাই সবার ক্ষেত্রে চশমা ব্যবহারে চোখ ভালো হয় না। সেক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন দেখা দেয়। চোখ নিয়ন্ত্রণকারী মাংসপেশী সুবিধামত কেটে বা অতিরিক্ত জোড়া লাগিয়ে সেলাই করে দেওয়া হয়। এতে চোখের ভারসাম্য ফিরে আসে। তবে এটা সত্য যে, অপারেশনের মাধ্যমেও অনেক সময় ট্যারা চোখ ভালো হয় না। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

এমব্লায়োপিয়ার চিকিৎসা; source: ferdaciftci.com

সাময়িকভাবে ট্যারা চোখ ভালো করতে একধরনের ইনজেকশন দেওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি চিরস্থায়ীভাবে চোখ সোজা করতে পারে। যদি তিন মাসের মধ্যে আবার সমস্যা দেখা দেয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হবে।

ট্যারা চোখ ভালো করার কিছু কার্যকর ব্যায়াম রয়েছে। এমব্লায়োপিয়া রোধ করতে ভালো চোখটিকে ঢেকে রেখে আক্রান্ত চোখ দিয়ে দেখার অভ্যাস করালে অনেক সময় দুই চোখের ফোকাস একদিকে চলে আসে। চোখকে ডানে-বামে, উপরে-নিচে ঘোরানোর মাধ্যমে চোখের স্নায়ু সবল হয়। এতে ট্যারা চোখের ঝুঁকি কমে যায়। ব্যায়ামের ফলে চোখ নিয়ন্ত্রণকারী মাংসপেশী অধিক কার্যক্ষম হয়, যা চোখকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

চোখের অবস্থার ভিত্তিতে প্রিজম নামক একধরনের স্বচ্ছ লেন্স ব্যবহারের মাধ্যমেও চিকিৎসকেরা ট্যারা চোখ ভালো করে থাকেন। এছাড়া ভিশন থেরাপির মাধ্যমেও ট্যারা চোখের চিকিৎসা করা হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে স্বল্প খরচেই ট্যারা চোখের চিকিৎসা সম্ভব। যেকোনো পদ্ধতিতেই হোক না কেন ট্যারা চোখ এখন প্রায় শতভাগ নিরাময়যোগ্য। শুধুমাত্র দরকার শিশুর প্রতি বাবা-মায়ের পূর্ণ সচেতনতা। শিশুর ট্যারা চোখ ধরা পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই খুব দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যত দ্রুত ট্যারা চোখের চিকিৎসা করা যাবে, শিশুর দৃষ্টিশক্তি বাঁচার সম্ভাবনা তত বেশী। তাই শিশুর চোখে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

ফিচার ইমেজ: kalerkantho.com

Related Articles