Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে রোগে শব্দ সুর ধরা দেয় বর্ণিল রূপে: সিনেস্থেশিয়া

ধরুন আপনি একটা হলরুমে বসে গান শুনছেন, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজছে। প্রতিটা সুরের জন্য দেখতে পাচ্ছেন আলাদা আলদা রঙ। হয়ত পিয়ানোর জন্য লাল কিংবা হয়ত গিটারের হলুদ আবার হয়ত বাঁশির সুরে সবুজের ছড়াছড়ি। মঙ্গলবার বললেই আপনার কাছে একটা রঙ এসে ধরা দেয়, চার সংখ্যাটি শুধুই বেগুনী। কেমন হত?

খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে তাই না? এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলোই কিছু কিছু মানুষের জন্য সত্যি। তারা শব্দ সুর শুধু শোনেনই না, দেখতেও পান, কিছু মানুষ পান স্বাদ। বিভিন্ন অনুভূতির সাথে জড়ানো থাকে একটা নির্দিষ্ট রঙ, গন্ধ কিংবা স্বাদ। ডাক্তারি ভাষায় যার নাম সিনেস্থেশিয়া (synesthesia)।

বর্ণিল শব্দ; Source: lemon tama deviant art

সিনেস্থেশিয়া আছে এমন একজন ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, “আমি জানি চার সংখ্যাটা হলুদ। কিন্তু আমার বন্ধু বলে চার হচ্ছে লাল। সে এটাও বলে চারের একটা মমতাময়ী রূপ আছে। অথচ আমার চারের কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। আমার কাছে কোনো সংখ্যারই নেই। কিন্তু আমার প্রতিটি সংখ্যার একটি নির্দিষ্ট রঙ আছে, তেমনই রঙ আছে আমার বর্ণ, দিন কিংবা মাসের।”

ডাক্তারদের মতে সিনেস্থেশিয়া কোনো রোগ নয়। শতকরা প্রায় ৪ জন মানুষ এই অবস্থা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সিনেস্থটিক মানুষ শব্দের জন্য বিশেষ রঙ দেখতে পান, কিংবা একটি বিশেষ স্বাদ পান। কখনো কখনো পান গন্ধ কিংবা ত্বকে বিশেষ অনুভূতি। বর্ণ, সংখ্যা, দিন, মাস ইত্যাদির নামও এমন অনুভূতি সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণা থেকে দেখা যায় শতকরা ৪০ জন সিনেস্থেট মানুষের পরিবারের সদস্য সিনেস্থেটিক। তাই ধারণা করা হয় বংশানুক্রমেই এই জিন বাহিত হয়ে আসছে। বিশেষ কোনো ডিএনএ ভ্যারিয়েশনের কারণেই এর উৎপত্তি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি মানবদেহের কোন জিনের জন্য এর উৎপত্তি। আবার বিজ্ঞানী ড্যাফনে ম্যুরারএর মতে, প্রায় সবাই সিনেস্থেশিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বয়সের সাথে সাথে এই ক্ষমতা লোপ পায়।

সুর ও রঙ; source: IDM magazine

সিনেস্থেশিয়ার বিভিন্ন ধরন আছে। এর মাঝে গ্রাফিম কালার সিনেস্থেশিয়া, ক্রোমোস্থেশিয়া, স্পেশাল সিকোয়েন্স সিনেস্থেশিয়া, অডিটরি ট্যাকটাইল সিনেস্থেশিয়া উল্লেখযোগ্য। গ্রাফিম কালার সিনেস্থেশিয়া বেশিরভাগ সিনেস্থেট মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এর উপসর্গ হল, প্রতিটা বর্ণ, সংখ্যার জন্য আলাদা আলাদা রঙ দেখতে পাওয়া। সাধারণ মানুষ পাঁচ যোগ দুই বললে বোঝেন সাত, গ্রাফিম কালার সিনেস্থেট দেখেন একটি রঙ। এই রঙ সব সময় একই। অন্যদিকে ক্রোমোস্থেটরা শব্দ দেখতে পান। বিভিন্ন শব্দ তাদের জন্য বিভিন্ন রঙ। মানুষের কণ্ঠস্বর এক রঙ তো বাঁশির সুর অন্য। কখনো বা শব্দের প্রাচুর্যে দেখতে পান রঙের বিচ্ছুরণ। কিন্তু এই রঙগুলো আবার সবার জন্য একরকম নয়।

গ্রাফিম কালার সিনেস্থেশিয়া; Source: evelinaweary.com

স্পেশাল (Spatial) সিকোয়েন্স সিনেস্থেশিয়া একটু ভিন্নরকম। এর ফলে মানুষ একেকটি শব্দ বা সংখ্যাকে বিভিন্ন জায়গায় অনুভব করেন। এই যেমন এক সংখ্যাটি হয়ত খুব দূরে, আবার দুই খুব কাছে। এ ধরনের মানুষের স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর হয়। ঘটনাগুলো মস্তিস্কে এমনভাবে সাজানো থাকে, কোনো বিশেষ শব্দ বা সংখ্যা তাকে ঐ স্থানে নিয়ে যায়। অডিটরি ট্যাকটাইল সিনেস্থেশিয়া সম্পন্ন মানুষ শব্দ অনুভব করতে পারেন। বিভিন্ন শব্দ ত্বকে একধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করে। সিনেস্থেশিয়ার এই প্রকারটি খুব কমই দেখা যায়।

আরো দুটি অপ্রতুল কিন্তু অবাক করা ধরন আছে। মিরর টাচ সিনেস্থেশিয়া আর লেক্সিকাল গ্যাস্ট্যাটরি সিনেস্থেশিয়া। মিরর টাচ সিনেস্থেট মানুষ বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে দেখে তার অনুভূতি অনুভব করতে পারেন। যেমন তার সামনের ব্যক্তিকে ঘুষি মারলে তিনিও ঠিক সেই জায়গায় ব্যথা অনুভব করবেন। আর লেক্সিকাল গ্যাস্ট্যাটরির ফলে মানুষ শব্দের স্বাদ পায়। তার কাছে পিয়ানোর শব্দ তেতো কিংবা মিষ্টি। সিনেস্থেটদের মধ্যে এমন মানুষ প্রতি হাজারে দুইজন। 

ক্রোমেস্থেশিয়া; Source: taryfied.deviant.art.com

উপরের তথ্যগুলো খুব অবাক কিংবা আজগুবি লাগলেও সিনেস্থেট বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বিখ্যাত মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান ছিলেন একজন গ্রাফিম কালার সিনেস্থেট। তিনি তার অভিজ্ঞতা বলেছিলেন এভাবে-

যখন আমি কোনো সমীকরণ দেখি আমি বর্ণগুলোকে একেকটা রঙে দেখি। আমি জানি না কেন। যখন আমি কথা বলি আমি বই থেকে বেসেল ফাংশন দেখতে পাই, যার মাঝে j হালকা বাদামি, n কিছুটা নীলচে বেগুনী, আবার x গুলো গাঢ় বাদামি। না জানি ছাত্রদের কাছে সমীকরণগুলো কেমন লাগে।

source: pinterest

অভিনেত্রী, গায়িকা, মডেল মেরিলিন মনরোও ছিলেন সিনেস্থেট। তার জীবনীর বইতে জীবনীকার লিখেন- “তিনি এমন কিছু অনুভব করতে পারতেন যা অনুভব করার জন্য অন্যরা মাদক গ্রহণ করত। তিনি শব্দ শুনলে তার কম্পন অনুভব করতে পারতেন” জগদ্বিখ্যাত সুরকার হ্যানস জিমারও একজন ক্রোমোসিনেস্থেট। তিনি বলেন- 

যখন কথা বলা শুরু করে আমার মনে হয় এটার হিসেব রাখতে হবে। আমি রঙ শুনতে শুরু করি। একজন আঁকিয়ে রঙ দেখে আর আমি রঙ শুনি।

ভিন্ন কণ্ঠ্যস্বরে ভিন্ন রঙ; Source: standard issue magazine

বিখ্যাত চিত্রকর ভিন্সেন্ট ভ্যান গগও ছিলেন একজন ক্রোমোসিনেস্থেট। সে সময়ে মানুষের সিনেস্থেশিয়া নিয়ে ধারণা ছিল না বলে তাকে হতে হয়েছিল বিদ্রুপের শিকার। শৈশবে তিনি যখন পিয়ানো শিখতে গিয়েছিলেন তখন তার শিক্ষক বুঝতে পারেন যে ভ্যান গগ পিয়ানোর নোটগুলোকে একেক রঙে সাজিয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত তার কাছে মনে হয় ভ্যান গগ পাগল হয়ে গিয়েছেন এবং আবোল তাবোল বকছেন। তাই তাকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। বলা হয়ে থাকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও ছিলেন একজন সিনেস্থেট।

সিনেস্থেশিয়া কারো কাছে উপভোগ্য আবার কারো কাছে বিব্রতকর। অনেক সিনেস্থেট হয়ত বুঝতেও পারেন না যে এই অবস্থাটা সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা। যারা গ্রাফিম কালার সিনেস্থেট কিংবা স্পেশাল সিকোয়েন্স সিনেস্থেট তাদের স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর হয়। সহজেই আলাদা করতেন পারেন একটি জিনিস থেকে অন্যটিকে। যেমন এলোমেলো করে সাজানো পাঁচ আর দুই আলাদা করতে একজন সাধারণ মানুষের যে সময় লাগবে একজন সিনেস্থেটের তার চেয়ে অনেক কম সময় লাগে। কিন্তু যারা অডিটরি ট্যাকটিয়াল সিনেস্থেট কিংবা লেক্সিক্যাল গ্যাস্ট্যাটরি সিনেস্থেট তাদের মাঝে মাঝে বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। কারণ সকল শব্দ বা সুরের অনুভূতি সুখকর হয় না। কোনো কোনো শব্দের জন্য অদ্ভুত স্বাদ, ঘ্রাণ কিংবা স্পর্শ অনুভূত হয়। 

ভিন্ন সংখ্যা ভিন্ন রঙ; Source: wikipedia

আপনি হয়ত ভাবছেন শব্দ বা সুর দেখতে কেমন হতে পারে? কিছুটা বুঝতে ছোট এই ভিডিওটি দেখতে পারেন। 

আসলে সিনেস্থেট না হলে পুরো ব্যাপারটা বোঝা বা আত্মস্থ করাটা কঠিন। প্রশ্নোত্তর প্লাটফর্ম Quora-তে এক ব্যক্তি তার নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, তিনি যখন প্রায় ১৫ বছর বয়সী তখন তার খালাকে বলেন কিছু বোতলের পানি খেতে তার ভাল লাগে না, কারণ এগুলোর স্বাদ বাদামি। যেসব বোতলের পানির স্বাদ সবুজ কিংবা হলুদ সেগুলো খেতে সুস্বাদু। তার খালা বেশ ভয় পেয়ে যান। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বোঝার চেষ্টা করেন এই বাদামি লাগার ব্যাপারটা আসলে কী। তার কাছে রঙের এই স্বাদের ব্যাপারটা খুব সাধারণ হলেও তার খালার কাছে ছিল ভয়ংকর। বর্ণনাকারী নিজেও জানতেন না এটা আসলে কী। বড় হওয়ার পর বুঝতে পারেন।

সুরে রঙে; Source: Discover magazine

সঙ্গীতজ্ঞদের মাঝে এর ব্যাপকতা দেখা যায়। অনেকের মতে শব্দকে দেখতে পাওয়ার গুনটি প্রভাব ফেলে সঙ্গীতবিদদের মাঝে।

বর্ণনা দেখে কেমন মনে হচ্ছে রঙ দেখার অনুভূতিগুলো? যদি কখনো সুযোগ দেয়া হয় আপনি কি আপনার জীবনে বেছে নেবেন সিনেস্থেশিয়াকে?

ফিচার ইমেজ: Getty

Related Articles