Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

করোনাভাইরাস বনাম বিজ্ঞানের যুদ্ধ

গতবছরের শেষ দিনটা শুরু হয়েছিল একটা খারাপ খবর দিয়ে। চীনের উহানের এক অচেনা নিউমোনিয়ার কেসের সেই ভাইরাস ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ পেল এক নতুন নাম- কভিড-১৯। এর একমাস পরেই একে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেও জ্যামিতিক হারে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। তবে গবেষকেরাও থেমে নেই, দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া এই সংক্রামক রোগটিকে ঠেকানোর জন্য দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন তারা। প্রতিদিনেই ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে আচ্ছেন আরাধ্য সাফল্যের দিকে। পুরো বিশ্বের ভার তাদের কাঁধে, একথা বললেও খুব বেশি অত্যুক্তি হবে না। তবে এই সূক্ষ্ণ গবেষণার কাজে কিন্তু কোনো শর্টকাট উপায় নেই।

করোনা প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের জন্য মলিকিউলার ক্ল্যাম্প টেকনোলজি বেশ বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। এটি ব্যবহারের কথা সবার আগে অস্ট্রেলিয়ার গবেষক ডক্টর কিথ চ্যাপেলের মাথায় এসেছিল। ভাইরাসের নিজস্ব ভয়ানক বৈশিষ্ট্যগুলোকে এর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করার এক অনন্য পন্থা এটি। জানুয়ারি মাস থেকেই তিনি তার তিন সহকর্মী ডক্টর পল ইয়ং, ডক্টর ট্রেন্ট মানরো এবং ডক্টর ড্যানিয়েল ওয়াটারসনের সাথে জোট বেঁধে ঘড়ি ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য সাধারণ জনগণের নাগালে থাকার উপযোগী একটা টিকা বানানো।

২৫০ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ফরমুলেশন নিয়ে কাজ করার পরে তারা S-Spike নামের এক ভাইরাসের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। একে বলা হচ্ছে করোনা ভাইরাসের ক্যান্ডিডেট ভাইরাস। এখন সেটা অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আর মাস দুয়েকের মাঝেই মানুষের ওপর ট্রায়াল শুরু করবেন তারা। মার্কেটে প্রথম করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন আনার জোর সম্ভাবনা আছে এই দলটির।

বাঁ থেকে, পল ইয়ং, কিথ চ্যাপেল এবং ট্রেন্ট মানরো; Image Source: Glenn Hunt

৩৮ বছর বয়সী ডক্টর চ্যাপেল জানিয়েছেন, “কার্যকরী ভ্যাক্সিন তৈরির কাছাকাছি চলে গেছি আমরা। তবে পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষের কাছে সেই ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেয়া কিন্তু আরেক অগ্নিপরীক্ষা। প্রশ্ন হলো, বিশালাকারে উৎপাদন শুরু করার ঝুঁকিটা আমরা নিতে পারব কি না।” ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিয়ে বারবারই কথা তুলেছেন তিনি। ভ্যাক্সিন কতটা কার্যকরী কিংবা ফলপ্রসূ হবে, তা অবশ্য প্রশ্নের উর্ধ্বে। সাধারণত কোনো নতুন ওষুধ ডেভেলপমেন্টের পেছনে একবছরের মতো সময় পান ফার্মাসিস্টরা, কিন্তু এই সংকটের মুহূর্তে সেটা অসম্ভব।

বড় কথা হলো, এই ভ্যাক্সিন যে করোনাভাইরাসের জাতভাই মার্সের (MERS) ওপর কাজ করে সে ব্যাপারে তারা শতভাগ নিশ্চিত। মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়া এই প্রাণঘাতী রোগে মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ, যা করোনার তুলনায় অনেক বেশি। তবে সৌভাগ্যবশত এটা করোনাভাইরাসের মতো এত সংক্রামক নয়। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক, ৬৪ বছর বয়সী প্রফেসর ইয়ং জানিয়েছেন, চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগে থেকেই তারা মার্স এবং মৌসুমী ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য ক্যান্ডিডেট ভ্যাক্সিন বানিয়ে পশুদের ওপর টেস্ট করেছেন। আর এ গবেষণায় দারুণ ইতিবাচক সাড়াও পেয়েছেন তারা।

করোনাভাইরাসের গঠন; Image Source: Nature

আমাদের মনে হয় না ব্যাপারটা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো জটিল হবে, বরং কভিড-১৯ ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের চেয়ে সোজাসাপ্টা। আর কভিড-১৯ ভাইরাসের মাঝে মিউটেশনের হারও কম।

মলিকিউলার ক্ল্যাম্পের ধারণাটা কিন্তু বেশ সরল। কোনো জীবিত কোষের ভেতরে আবাস গেড়ে বংশবৃদ্ধি করাই ভাইরাসের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। কভিড-১৯ এর দেহ স্পাইক-প্রোটিন দিয়ে ছেয়ে থাকে। প্রোটিনগুলো যতক্ষণ হোস্টকে খুঁজে না পায়, ততক্ষণ তারা একে অন্যের সাথে স্প্রিং দিয়ে সংযুক্ত থাকে। তো, মলিকিউলার ক্ল্যাম্প টেকনোলজিতে ল্যাবে বানানো এক বিশেষ পেপ্টাইড তথা অ্যামাইনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স ব্যবহার করা হয়। এই পেপ্টাইড স্পাইক প্রোটিনগুলোকে স্প্রিং দিয়ে সংযুক্ত থাকা অবস্থাতেই শনাক্ত করে ফেলতে পারে। ফলে হোস্টের দেহের ইমিউন সিস্টেম একে সক্রিয় হবার আগেই ধ্বংস করে দেয়। ভ্যাক্সিনে একটি বুস্টিং এজেন্ট যোগ করা হয়েছে, যাতে ইমিউন রেসপন্স ত্বরান্বিত হয়। পোস্টডক্টরাল থিসিস করার সময়্যেই ডক্টর চ্যাপেলের মাথায় এই চিন্তা এসেছিল। শুধু ইনফ্লুয়েঞ্জা আর মার্স না; ইবোলা, সার্স আর নিপাহ ভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী ছোঁয়াচে রোগের ভাইরাস ঠেকাতেও পদ্ধতিটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

নরওয়ের অসলোভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম ২০১৮ সালে এই টেকনোলজির কার্যকারিতাকে স্বীকৃতি দেয়। কোয়ালিশন অফ এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন নামের এই প্রতিষ্ঠানের মূল বাজেট আসে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে। তারা প্রথমে মলিকিউলার ক্ল্যাম্প প্রোগ্রামে ১৫ মিলিয়ন ডলার ঢালে। ২০১৯ সালে তারা সিদ্ধান্ত নেন, যেকোনো মহামারী ঘটলে ১ সপ্তাহের মাঝে ভ্যাক্সিন বানানো যায় কীভাবে, সেটার পরীক্ষামূলক একটা টেস্ট করবেন তারা। কিন্তু তার আগেই বাস্তব জীবনের মহামারী শুরু হয়ে যাওয়ায় তাদের ওপর চাপ এখন শত গুণে বেড়ে গেল।

Image Source: NBC Times

এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ৩৫টি দেশের কোম্পানি এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলে এই রোগের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে।

আমেরিকান কোম্পানি মর্ডার্ন থেরাপিউটিকস এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে কিছুটা। সেখানকার গবেষকেরা সিনথেটিক মেসেঞ্জার আরএনএ দিয়ে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে শনাক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রফেসর ইয়ং জানান, “এটা কোনো প্রতিযোগিতার বিষয় না। যুতসই একটি ভ্যাক্সিন বের করতে পারলেই হলো, সে যে-ই বের করুক না কেন।” এদিকে তার সাথে কাজ করা প্রফেসর মানরো কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রেরই গবেষক, তিনি গত আগস্টেই যোগ দেন অস্ট্রেলিয়ার গবেষকদের সাথে। তার মতে, “ভ্যাক্সিন বানানোর প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। কীভাবে উৎপাদন করা যায়, সেটাই হলো আসল চিন্তা।” এতে প্রায় ২০-৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ পড়তে পারে। অস্ট্রেলিয়ার এত বড় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি নেই যদিও, তবে বিশ্বব্যাপী ভ্যাক্সিন সরবরাহকারী কোম্পানি সিএসএল-সেকিউরাস এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

Image Source: Houston Chronicle

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের কায়জার পারমানেন্ট রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে পরীক্ষামূলক টিকাদানের কর্মসূচী শুরু হয়ে গেছে। তাদের ভ্যাক্সিনে একটি নিরীহ জেনেটিক কোড ব্যবহার করা হচ্ছে, যা কোভিড-১৯ এর কার্যক্রমকে অনুকরণ করতে পারে। এ পর্যন্ত ৪ জন সুস্থ ভলান্টিয়ারের ওপর এ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলাফল পেতে প্রায় এক মাস সময় লেগে যাবে।

এদিকে করোনাভাইরাস নিরাময়ের উপায় নিয়ে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষকেরা।

১৮ই মার্চের খবর অনুযায়ী, চীনের মেডিকেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাপানে ব্যবহৃত একটু ভিন্ন প্রকৃতির ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ বেশ ভালোরকম কাজ করেছে এ ভাইরাসজনিত অসুখ ঠেকানোর ব্যাপারে। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ঝ্যাং ঝিনমিন জানিয়েছেন, ফ্যাভাইপিরাভির নামের এই ওষুধ চীনের ইউহান এবং শ্যানঝেন প্রদেশের ৩৪০ জন রোগীর ওপরে বেশ চমকপ্রদ কাজ করেছে। তার মতে, ওষুধটা নিরাপদ এবং বেশ কার্যকর। শ্যানঝেন প্রদেশের রোগীরা এই ওষুধ সেবনের চারদিনের মাঝেই তাদের ওপরে রোগের প্রকোপ কমে এসেছে। তাছাড়া এক্স-রে করে দেখা গেছে, এই ওষুধ সেবন করা ৯১ শতাংশ রোগীর ফুসফুসের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। ২০১৬ সালে গিনিতে ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ে এই ওষুধ ব্যবহৃত হয়েছিল।

সিয়াটলে এক ভলান্টিয়ারকে টিকা দেয়া হচ্ছে; Image Source: Nytimes.com

অবশ্য এই ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, ফুজিফিল্ম টয়ামা কেমিক্যাল, এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। জাপানের মেডিক্যাল কর্মকর্তারা দাবি করছেন, মৃদু অসুস্থ রোগীদেরকে হয়তো এ ওষুধ দ্বারা সারিয়ে তোলা সম্ভব, কিন্তু মরণাপন্ন রোগীদের জন্য এটা তেমন একটা কাজে আসবে না।

সবশেষে আসি বাংলাদেশী এক গবেষকের প্রসঙ্গে।

আইইডিসিআরে স্বল্প পরিমাণ করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের কিট নিয়ে উদবিগ্ন সারা দেশ। এরকম সময়ে সুসংবাদ নিয়ে এসেছেন ডক্টর বিজন কুমার শিল। তার এই পদ্ধতির মাধ্যমে ৩৫০ টাকার একটি কিট দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিটের মাঝে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত করা যাবে। ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস মোকাবেলায় সিঙ্গাপুরের এক ল্যাবে তিনি ‘র‍্যাপিড ডট ব্লট’ নামের এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই ফর্মুলা পরবর্তীতে চীন সরকার কিনে নিয়ে সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সমর্থ হয়। 

এ গবেষণায় তার সাথে ছিলেন ডক্টর নিহাদ আদনান, ডক্টর মোহাম্মদ রাশেদ জমিরউদ্দিন ও ডক্টর ফিরোজ আহমেদ। এই কিট বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল এজেন্ট কিনতে হবে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্য থেকে। ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি পাওয়ামাত্র তারা এই কিট উৎপাদনের কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন।

করোনাভাইরাসের নিয়মিত আপডেট জানতে ফলো করুন 

করোনাভাইরাসের লাইভ আপডেট

Related Articles