এই ব্যস্ত জীবনে আমরা নানারকম শব্দ শুনতে পাই। গাছের পাতা নড়ার মৃদু শব্দ বা ট্রাকের হর্নের মতো কর্কশ শব্দ আমাদের মস্তিষ্ক বুঝতে পারে কানের সাহায্যে। যদিও বর্তমান যানজট ও দূষণের পৃথিবীতে অনেক বেশি জোরালো শব্দের ভিড়ে হালকা শব্দগুলো চাপা পড়ে যায়। কিন্তু এত শব্দের ভিড়ে মাঝে মাঝে আমাদের ভেতর থেকেই কেউ এমন এক শব্দের কথা বলে, যা নিরবচ্ছিন্নভাবে কানে বাজতে থাকেই। অথচ সে শব্দের উৎপত্তি তার চারপাশের পরিবেশ থেকে নয়।
শুধুমাত্র বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতে নয়, প্রাচীন মিশরের, প্রাচীন রোমান এবং গ্রিসের চিকিৎসকদের হাতে তৈরি পুঁথিপত্রে উল্লেখ আছে কানে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পারার কথা। অনেকের মতে, তিনি শিস দেবার আওয়াজ বা কেটলিতে পানি বাষ্প হবার আওয়াজ শুনতে পান। আবার অনেকের মতে, হিসহিস বা রেলগাড়ি চলার মতো আওয়াজ। এছাড়াও, ঝিঁঝি পোকা বা টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাবার পর যেমন শব্দ হয়, তেমন শব্দ শোনার কথাও উল্লেখ আছে।
প্রাচীন চিকিৎসাব্যবস্থা বা সে সময়ের চিকিৎসকরা এ সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পারেননি। এজন্য অনেক অদ্ভুত চিকিৎসার কথা শোনা যায়। অনেকের পরামর্শ ছিল, গোলাপজল তামার টিউব দিয়ে কানে ঢালতে। রোমান লেখক পিনলি দ্য এল্ডার বলেছিলেন, হাঁসের চর্বিতে কেঁচো সেদ্ধ করে কানে ঢালার জন্য। মধ্যযুগের ওয়েলশ চিকিৎসক মিডিফাই তার রোগীদের পরামর্শ দিতেন, বনরুটি যতটা সম্ভব গরম করে তা দুই কানে চেপে ধরতে। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে দেবতাকে ডাকলে নাকি কানের অস্বাভাবিক শব্দ শোনা থেকে মুক্তি লাভ হবে।
এমন পরামর্শ শুনে আঁতকে উঠবেন না। চারিদিক নিস্তব্ধ থাকার পরও কানে অস্বাভাবিক শব্দ শোনার সমস্যাকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান শনাক্ত করেছে। একে বলা হয় টিনিটাস। শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ইংরেজি শব্দ 'টিনিয়ার' থেকে, যার অর্থ হচ্ছে ঘণ্টার শব্দ।
অনেকের কাছে টিনিটাস রোগের নাম নতুন হলেও কানে শব্দ শোনার এ সমস্যা চিকিৎসাশ্রাস্ত্রে কিন্তু নতুন নয়। জরিপে দেখা গেছে, ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ দাবি করেন, তারা ছয়মাস বা তারও বেশি সময় ধরে কানে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। ১ থেকে ৩ শতাংশ বলেন আরও ভয়ংকর কথা। এমন শব্দের কারণে তারা সাধারণ জীবন-যাপন করতে পারছেন না। কাজে মন বসাতে সমস্যা হচ্ছে। রাতে চারিদিক নিরিবিলি হবার কারণে শব্দ বেশি শোনা যায় বলে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। ফলে ইনসমনিয়া, ডায়াবেটিসের মতো জটিল সমস্যার সম্মুখীন হওয়া ছাড়াও অনেকে আত্মহত্যার দিকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
কিন্তু টিনিটাস কেন হয়? এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করার আগে বলে রাখা ভালো, কানে এমন শব্দ শোনার জন্য কিন্তু দায়ী আমাদের মস্তিষ্ক। এবং অনেকেই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন কারণে এই শব্দ কিছুটা হলেও শুনেছেন। হুট করে প্রচণ্ড শব্দে কোনোকিছু বিস্ফোরিত হবার পর বা জোরালো শব্দের কনসার্ট থেকে ফেরার পর অনেকেই হুট করে কানে এ শব্দ শুনতে পান। এছাড়াও, অতিরিক্ত হেডফোন ব্যবহার, অপর্যাপ্ত ঘুম বা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা অস্থায়ী টিনিটাস তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে তা সেরে যায়।
এছাড়াও কিছু ওষুধ, যেমন: অ্যাসপিরিন বা ননস্টেরেয়োডিয়াল অ্যান্টিফ্ল্যামেটরি ওষুুধের কারণে টিনিটাস হতে পারে। এক্ষেত্রে, ওষুধের ডোজ কমিয়ে দিলে বা বাদ দেবার সাথে টিনিটাসও চলে যায়। কিন্তু অস্বাভাবিক শব্দ শোনার মেয়াদকাল যদি ছয়মাস বা তারও বেশি হয়, তবে তা স্থায়ী টিনিটাস। আমেরিকায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন মানুষ স্থায়ী টিনিটাসে আক্রান্ত। তবে ৫৫ বছরের আশেপাশের মানুষদের জন্য এটি খুবই সাধারণ। অনেকে ধারণা করে থাকেন, টিনিটাস হচ্ছে বধির হয়ে যাওয়া বা মস্তিস্কে বড় কোনো সমস্যার চিহ্ন। এ ধারণা মাঝে মাঝে সত্য বলে প্রমাণিত হয়।
টিনিটাস কোনো রোগ নয়, বরং রোগের লক্ষণ। সাধারণত টিনিটাসে ভুক্তভোগী ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি এ শব্দ শুনতে পান না। তবে অনেকসময় দেখা যায়, এ শব্দ ডাক্তার তার স্টেথোস্কোপ দিয়ে শুনতে পাচ্ছেন। আবার অনেকে কানে হার্টবিটের মতো শব্দ লক্ষ করেন, যা সাধারণত রাতে বেশি শোনা যায়। বয়স্কদের ভেতর বেশি দেখা যাওয়া টিনিটাসের এ প্রকৃতির নাম 'পালসাটাইল টিনিটাস'।পালসাটাইল বা স্থায়ী টিনিটাস থাকলে অতি দ্রুত একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞকে দেখানো প্রয়োজন। কারণ এই দুই ধরনের টিনিটাসের কারণ টিউমার বা রক্তনালীর সংক্রমণও হতে পারে।
সাধারণত শব্দতরঙ্গ আমাদের কানের ভেতর দিয়ে মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণ হয়ে শোনার জন্য যে কোষগুলো আছে, সেগুলোর মাধ্যমে ও ক্লকিয়ার সাহায্যে শব্দতরঙ্গ বৈদ্যুতিক সংকেত হিসেবে অডিটরি কর্টেক্স বা অডিটরি নার্ভে গিয়ে পৌঁছায়। কোনো কারণে যদি শ্রবণে সহায়ক এই কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে মস্তিস্ক আর সংকেত শুনতে পায় না। এ কারণে নিউরনে অস্বাভাবিক ক্রিয়াকালাপের সৃষ্টি হয়, যার ফলাফল এই টিনিটাস। যেহেতু মস্তিস্কে নতুন সংকেত আসছে না, তাই মস্তিষ্ক তা পুনর্নির্মাণ করা শুরু করে। এজন্য নিউরন নিজেই নিজেকে একটি চক্রের ভেতর ফেলে দেয়। এর পরিণতি- বিরতিহীন এক শব্দ। তাই টিনিটাসে আক্রান্ত ব্যক্তির অডিটরি নার্ভ কেটে বাদ দেবার পরও এ আওয়াজ থেমে যায় না।
টিনিটাস আসলে কেন হয়, এর প্রাথমিক ধারণা পেতে এতটুকু তথ্য জানলেই চলে। তবে আমাদের মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ অংশ বা কিছু নির্দিষ্ট অংশের কাজের ধরন সম্পর্কে যেমন এখনও আমরা জানি না, তেমনি মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া এ আওয়াজের কারণ সিংহভাগই আমাদের জানার বাইরে। ছোট্ট একটি উদাহরণ এ বিষয়টিকে স্পষ্ট করবে।
লওরে নামক এক যুবক, গ্রীষ্মের প্রায় পুরো সময় ধরে একটি ফার্মে কাজ করেছিলেন। সেখানে অত্যধিক জোরালো আওয়াজের ভেতর তাকে কাজ করতে হতো। এ কাজের ফলে একসময় তিনি কিঞ্চিৎ শ্রবণশক্তি হারান। একইসাথে তীক্ষ্ণ জোরালো শব্দের টিনিটাস সমস্যা শুরু হয়। এভাবে তিনি জীবনের ৪০টি বছর পার করেন। ৬৩ বছর বয়সে তার স্ট্রোক হয়। সিটিস্ক্যান ও এমআরআই করার পর চিকিৎসকেরা দেখতে পান, তার মস্তিস্কের কাডের্ট ও পুটেমেন নামক অংশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু স্ট্রোকের জন্য ব্রেনের কিছু অংশ ক্ষতি হবার পরও কিছু আশ্চর্য পরিবর্তন এসেছে। কোনোরকম নতুন শ্রবণশক্তি হারানো ছাড়াই, ৪০ বছর ধরে একনাগাড়ে বেজে চলা টিনিটাস একদম সেরে গেছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেভেন চেং ও পল লারসন, লওরের এ অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেন। তারা খেয়াল করে দেখেন, পারকিনসন'স রোগের চিকিৎসার জন্য মস্তিস্কে যে ব্রেন স্টেম স্থাপনা করা হয়, তার ইলেকট্রোডগুলো লক্ষ্যে পৌঁছায় ব্রেনের কার্ডেট ও পুটেমেন নামক অংশ দিয়ে। চেং ও লারসন পাঁচজন রোগীকে খুঁজে বের করেন, যারা পারকিনসন'স রোগের পাশাপাশি টিনিটাসের মতো সমস্যায়ও ভুগছে। তারা এই রোগীদের নিয়েই পরীক্ষা করেন। অস্ত্রোপচারের সময় তারা কিছু সময় নিয়ে মস্তিস্কের ঐ অংশে 'ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন' চালান। এরপরই তারা লক্ষ করেন, পাঁচজনের মধ্যে চারজনের টিনিটাসের আওয়াজ বেশ ক্ষীণ হয়ে গেছে।
অজানা এমন কারণ ছাড়াও শ্রবণকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও টিনিটাসের অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত জোরালো শব্দ বা হট্টগোল, ওষুধ বা অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে এ কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। টিউমার বা একুয়াস্টিক নিউরোমা, মেনিয়ার্স ডিজিজ, মস্তিস্কে স্ট্রোক, মধ্যকর্ণে জটিলতা, সাইনাস, রক্তনালি বা কানের ভেতরে কোনো সংক্রমণের কারণে হুট করে টিনিটাস হতে পারে। তাই দুই বা তারও বেশি সময়ে টিনিটাস সমস্যা হয়ে থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
মস্তিস্কের শ্রবণ অংশের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে সৃষ্ট এ সমস্যার উপযুক্ত সমাধান নেই। তাই কোনো রোগী টিনিটাসের সমস্যা নিয়ে গেলে চিকিৎসক তার মেডিকেল হিস্টোরি ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সমস্যার উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে তার চিকিৎসা করলে টিনিটাসও ভালো হয়ে যায়। কিন্তু, প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষারও পরও কোনো সমস্যা না পাওয়া গেলে চিকিৎসকরা সাধারণত এমআরআই বা সিটিস্ক্যান করে দেখতে চান, মস্তিস্কে কোনো সমস্যা আছে কি না।
এক্ষেত্রে তারা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা কোষ বা টিউমার ও রক্তনালীর অস্বাভাবিকতার দিকে বেশি মনোযোগ দেন। একজন অডিওলোজিস্ট দ্বারা শ্রবণ পরীক্ষা করেও দেখা হয় যে, কানে কম শোনার জন্য এই টিনিটাসের আবির্ভাব হয়েছে কি না। মস্তিস্কের অস্বাভাবিকতা ছাড়াও ঘাড়ে খিঁচুনি, দাঁতে ব্যথা, পুরনো কোনো আঘাত বা পেশীতে টান লাগার ফলে টিনিটাস হতে পারে। এমন কোনো সমস্যা থাকলে মালিশ ভালো কাজে দিতে পারে।
এ ধরনেরও কোনো সমস্যা না পাওয়া গেলে রোগীর স্বাস্থ্যই টিনিটাস হবার কারণ হিসেবে ধরা হয়। তখন চিকিৎসক রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের সাথে পর্যাপ্ত শরীরচর্চা করার পরামর্শ দেন। এছাড়াও, ডিপ্রেশন, ইনসমনিয়া, উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা থাকলে উপযুক্ত ওষুধ নেয়া যেতে পারে বা একজন সাইকোলজিস্টের সাথে আলাপ করা যেতে পারে।
বর্তমানে কানে শব্দ শোনার জন্য বেশ কিছু ওষুধ পাওয়া যায়। যা দীর্ঘদিন ধরে সেবনের পর কিছুটা ভালো ফলাফল পাওয়া যায়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগে না। তাই টিনিটাসের সমস্যা মনে হলে শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যজনিত অস্বাভাবিকতা আছে কি না, তার খোঁজ করাই সবথেকে ফলপ্রসূ চিকিৎসা।
তবে পৃথিবীতে অনেক মানুষ বেঁচে আছেন, যারা দীর্ঘ সময় ধরে টিনিটাসের সাথে বসবাস করছেন। তাদের শরীর বা মস্তিস্কে কোনো উপসর্গ নেই। কোনো এক অজানা কারণে শ্রবণকোষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার উত্তর চিকিৎসকের কাছেও নেই। স্থায়ী টিনিটাস বা শ্রবণ কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে তৈরি টিনিটাসের সাথে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সাধারণত এ ধরনের উপসর্গে দিনের বেলা কোলাহলের মাঝে সেভাবে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু সমস্যা হয় রাতে ঘুমানোর সময়। এজন্য কানের শব্দকে উপেক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘরে টিকটিক শব্দ করে চলা দেয়ালঘড়ি বা মোবাইলে টিনিটাস মাস্কিং অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে কারো টিনিটাসের আওয়াজ যদি খুবই জোরালো হয়, তবে হিয়ারিং এইডের মতো টিনিটাস মাস্কার ব্যবহার করলে আওয়াজ কমিয়ে রাখা সম্ভব। এছাড়া, ব্যায়াম, মেডিটেশন, কাউন্সেলিং বা আকুপাংচারের প্রয়োজন হলেও হতে পারে। কিন্তু এর কোনোটাই স্থায়ী সমাধান নয়।
বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, টিনিটাসের রহস্য সমাধান করা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। ট্রাফিক, স্মার্টফোন বা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করা বিভিন্ন যন্ত্রই কানে না শোনার পেছনে দায়ী; একইসাথে টিনিটাস তৈরিরও। তবে কার্যকরী একটি সমাধান খুঁজে পেলে পুরো মানবজাতির প্রায় ৩৫ শতাংশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। কিন্তু ততদিন এই মস্তিস্কে বেজে চলা শব্দের সাথেই মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। তবে, অতিরিক্ত আওয়াজে অতিষ্ঠ হয়ে প্রাচীনকালের মতো করে কানে গরম রুটি চেপে ধরার মতো উন্মাদ পদ্ধতি কিন্তু ব্যবহার করা যাবে না!
This article is in Bangla language. It is about a human brain problem which is Tinnitus or Ringing in the ear.
Necessary references have been hyperlinked inside the article.
Featured Image: hearinglikeme