Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি: কী, কেন, কীভাবে?

মহামারীর এই সময়ে আপনি হয়তো সংবাদে প্রায়ই শুনছেন প্লাজমা থেরাপির কথা কিংবা ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে দেখছেন পরিচিত কেউ হয়তো কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা খুঁজছে। শত বছরের পুরোনো এই প্রক্রিয়াটি নতুন করে উঠে এসেছে আলোচনায় যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিটিই সেরে উঠার পর বাঁচাতে পারে অন্য কারো জীবন। কী এই প্লাজমা থেরাপি, প্রক্রিয়াটি ঠিক কেমন আর এতে ঝুঁকিই বা কতখানি?

প্লাজমা এবং অ্যান্টিবডি

ধরুন, আপনার রক্ত থেকে শ্বেত রক্তকণিকা, লোহিত রক্তকণিকা, অণুচক্রিকা এবং আরো অন্যান্য কোষীয় উপাদান সরিয়ে নেওয়া হলো। এরপর যে হলুদ কিংবা খড়-বর্ণের তরল অংশটুকু রয়ে যাবে তা-ই মূলত প্লাজমা। মানুষের দেহে রক্তের প্রায় পঞ্চান্ন শতাংশ জুড়ে থাকে এই প্লাজমা যার প্রায় একানব্বই থেকে বিরানব্বই শতাংশই মূলত পানি।

আপনার রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কল্পনা করুন একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। যখনই বাইরে থেকে কোনো অজানা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া আপনার দেহকে আক্রমণ করছে, তখনই আপনার রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা উপযুক্ত সৈন্য প্রস্তুত করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর এই সৈন্যদের দলে থাকে অ্যান্টিবডি নামক একধরনের প্রোটিন যা প্রথমে অজানা সেই শত্রুটির সাথে যুক্ত হয়, এরপর একে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে এবং সবশেষে একে পরাস্ত করে নিঃসরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। এভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সক্ষম হলেই আপনি যুদ্ধে জয়ী হচ্ছেন অর্থাৎ সুস্থ হয়ে উঠছেন।

 সাধারণ সেন্ট্রিফিউগেশন প্রক্রিয়ায় পৃথক হওয়া রক্ত এবং প্লাজমা © horiba.com

আমরা যে প্লাজমা নিয়ে কথা বলছি, অ্যান্টিবডিগুলো মূলত রক্তের এই অংশেই ঘুরে বেড়ায়। এখানে বলে রাখি, প্রতিটি অ্যান্টিবডিই ‘প্যাথোজেন স্পেসিফিক’ অর্থাৎ একপ্রকার শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করা অ্যান্টিবডি অন্য প্রকার শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করবে না। অন্যদিকে রক্তের কিছু মেমরি সেল বা স্মৃতিকোষ শত্রুর সেই ছবিটিকে মনে রেখে দেয়। আপনি পুনরায় একই শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে মেমরি সেলগুলো ত্বরিত-গতিতে সেই নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করা শুরু করে। শত্রুকে কাবু করার জন্য কী অসাধারণ সমন্বয়!

আপনি সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই অ্যান্টিবডিগুলো আপনার প্লাজমাতে উপস্থিত থাকতে পারে, কিন্তু এই সময়কাল ভাইরাসভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। আর আরোগ্য লাভের পর এই অ্যান্টিবডিসমৃদ্ধ প্লাজমাকেই আমরা বলছি ‘কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা’। আপনি এই অ্যান্টিবডিসমৃদ্ধ প্লাজমা দিতে পারেন একই রোগে আক্রান্ত অন্য কোনো ব্যক্তিকে। অর্থাৎ তার দেহে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভাইরাসটির বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে যে সময় নিত, তার আগেই আপনি আপনার শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি প্রবেশ করিয়ে তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে তরান্বিত করছেন। ব্যাপারটি মূলত এরকম যে, আপনার সৈন্য অন্য কাউকে একই শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে লড়াই করছে।

ভ্যাক্সিন গ্রহণের মাধ্যমে আপনার শরীর নিজস্ব অ্যান্টিবডি তৈরি করছে, আর তা যদি হয় ‘সক্রিয় ইমিউনিটি’, তাহলে বাইরে থেকে অ্যান্টিবডি ধার করার এই প্রক্রিয়াটিকে ‘পরোক্ষ ইমিউনিটি’ বলা যেতে পারে।

‘কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ কোনো নতুন ধারণা নয়। ১৮৯০ সালে জার্মান শারীরতত্ত্ববিদ এমিল ভন বেহরিং রক্তের আরেক উপাদান সেরাম-এ উপস্থিত অ্যান্টিবডিকে কাজে লাগিয়ে ডিপথেরিয়া চিকিৎসায় সাফল্য পান। এরপর থেকেই প্রায়ই নতুন কোনো ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় এই থেরাপির ব্যবহার দেখা যেতে থাকে। এর কিছু উদাহরণ দেখে নেয়া যাক।

  • ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু চলাকালীন কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে এইচ১এন১ ভাইরাসের চিকিৎসায় এই থেরাপি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
  • ২০০২ সালের সার্স মহামারীতেও প্লাজমা থেরাপি আক্রান্তদের দ্রুত আরোগ্য লাভে সাহায্যের নজির রেখেছিল।
  • ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইবোলা ভাইরাস প্রতিরোধে প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করে।
  • ২০১৫ সালে মার্স-এর চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার জন্য একটি প্রোটোকল ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
  • এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, এইচআইভি, পোলিও, মাম্পস, মিজেলস- এসব রোগের চিকিৎসায়ও প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার দেখা যায়।

বর্তমানে বিভিন্ন ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি ডিসঅর্ডার, জেনেটিক এম্ফাইসিমা, র‍্যাবিস, টিটেনাস, ক্যান্সার-চিকিৎসা, সার্জারি কিংবা ডায়ালাইসিসের কাজে, কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন, আগুনে দগ্ধ রোগীর চিকিৎসাসহ বহু ক্ষেত্রে প্লাজমা ব্যবহৃত হচ্ছে।  

প্রক্রিয়াটি ঠিক কেমন?

সর্বপ্রথমে নিশ্চিত হতে হবে, সুস্থ হয়ে যাওয়া ব্যাক্তিটি তার দেহে ভাইরাসের আর কোনো চিহ্ন বহন করছে কিনা। এজন্য সুস্থ হবার পরে মোটামুটি সাত থেকে চৌদ্দ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে এই সময়কাল বিশ থেকে বাইশ দিনও হতে পারে। এর মধ্যে যদি আপনি রোগের আর কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করেন এবং আপনার প্লাজমাতে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিবডি মজুদ থাকে, তবে আপনি আক্রান্ত অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্লাজমা দেওয়ার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত।

প্লাজমা দান করার প্রক্রিয়াটি রক্তদান প্রক্রিয়া থেকে একটুখানি আলাদা। ‘অ্যাফেরেসিস’ নামক এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা বদ্ধচক্রের মতো। আপনার এক বাহুর শিরায় একটি সুঁই প্রবেশ করানো হয়, যা শরীর থেকে রক্ত টেনে বের করে নিয়ে একটি মেশিনে প্রবেশ করায়। সেখানে ‘সেন্ট্রিফিউগেশন’ প্রক্রিয়ায় রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করা হয়। কণিকাসহ রক্তের অবশিষ্ট অংশ মেশিন থেকে ভিন্ন পথে অন্য একটি সুঁইয়ের মাধ্যমে আপনার অন্য বাহুতে অর্থাৎ পুনরায় আপনার দেহে প্রবেশ করানো হয়। এই চক্রটি বেশ কয়েকবার চালানো হয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ প্লাজমা সংগৃহীত হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা সময় লাগে। সাধারণ রক্তদান প্রক্রিয়ার মতোই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আপনি ক্লান্তি, হালকা মাথা ঘোরানো, অবসাদ- এগুলো অনুভব করতে পারেন। এক থেকে দুই দিনের মধ্যেই আপনার শরীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হারানো প্লাজমার ঘাটতি পূরণ করে ফেলে।

‘অ্যাফেরেসিস’ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত মেশিন ও সংগৃহীত প্লাজমা © Dayton Daily News

পুরো প্রক্রিয়া একবার সম্পাদনে মোটামুটি দুই থেকে চার ইউনিট বা ২০০-৬০০ সিসি প্লাজমা সংগ্রহ করা যায় যা এক থেকে তিনজন আক্রান্ত রোগীকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে সংগৃহীত প্লাজমা অন্য কাউকে দেওয়ার আগে ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিন্সট্রেশনে’র প্রবিধান অনুযায়ী অবশ্যই পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে, দেখে নিতে হবে তা থেকে কোনো রক্তবাহিত রোগ, হেপাটাইটিস, এইচআইভি বা অন্য কোনো রোগ সংক্রমিত হবার আশঙ্কা আছে কিনা। এছাড়াও মনে রাখতে হবে এই প্রক্রিয়াতেও দাতা এবং গ্রহীতার ‘ম্যাচিং টাইপে’র ব্যাপারে কিছু নিয়ম রয়েছে।

সংগৃহীত প্লাজমা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে রাখা যায় অথবা সাথে সাথেই আক্রান্ত অন্য কোনো ব্যক্তির দেহে পরিব্যাপ্ত করা যায়। এখানে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের সাথে সংগৃহীত প্লাজমার ‘ট্রান্সফিউশন’ বা সংমিশ্রণ ঘটে। কাঙ্ক্ষিত অ্যান্টিবডি রক্তে মিশে টিস্যুতে এবং কোষীয় ধাপে প্রবেশ করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। সঞ্চারিত অ্যান্টিবডি কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত গ্রাহক দেহে থাকতে পারে।

কী কী ঝুঁকি রয়েছে?

  • হিতে বিপরীত হতে পারে যদি সংগৃহীত প্লাজমায় কিছু ভাইরাস তখনো থেকে যায়। তাহলে কিন্তু অ্যান্টিবডির সাথে আপনি কিছু ভাইরাসও রোগীর দেহে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছেন, যাতে অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে।
  • প্লাজমা থেরাপিতে একটি সংমিশ্রণ বিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাইরে থেকে প্লাজমা প্রবেশ করানোর অর্থ হচ্ছে আপনি দেহের সংবহন ব্যবস্থায় অতিরিক্ত পরিমাণ বা আয়তন যোগ করছেন। এতে কার্ডিয়াক সিস্টেম বোঝাই হয়ে আপনাকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
  • অনেক সময় এই প্রক্রিয়াতে আপনার নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্লাজমার সাথে আসা অন্য কোনো উপাদানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসতে পারে, যা বাড়তি কোনো অসুস্থতার কারণ হতে পারে।

তবে ‘প্যাথোজেন ডিটেকশন টেকনিক’সহ আরো বেশ কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়ানো যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ঝুঁকি কমানোর ব্যাপারে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গবেষণা চলছে।

কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ড. ঝোউ মিং উহানের একটি হাসপাতালে প্লাজমা দান করছেন, মার্চ ২০২০ © AP File Photo

বর্তমানে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জরুরি অবস্থায় প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গবেষকরা বলছেন, এতে আক্রান্তরা আগের চেয়ে দ্রুত সেরে উঠছেন। বাংলাদেশেও স্বল্প পরিসরে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ গুটিকতক হাসপাতালে প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে।

তবে জানার আছে আরো অনেক কিছু। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে অ্যান্টিবডির সন্তোষজনক ডোজটি ঠিক কতটুকু? আক্রান্ত হওয়ার ঠিক কোন পর্যায়ে এই থেরাপি কার্যকর হতে পারে? কোন ধরনের রোগী এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন? ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা অন্য কোনো রোগের উপস্থিতি এতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে? এমনই আরো অনেক প্রশ্নের ভীড়ে প্লাজমা থেরাপির সফলতা নিয়ে এখনো কোনো নিশ্চিত উপসংহার ঠিক টানা যাচ্ছে না। 

Related Articles