Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

২০১৮ সালেই কি বিদায় নেবে পোলিও?

পোলিও নিয়ে মানুষের চিন্তার শুরু আজ থেকে নয়। এর পূর্ণরূপ ‘পোলিওমাইলিটিস’। মানব সভ্যতার প্রায় শুরু থেকেই পোলিও বাস করছে মানুষের সাথে। তবে এর প্রকোপ ভালোভাবে মানুষের চোখে পড়ে বিংশ শতকে। বিশেষ করে প্রাথমিকভাবে ইউরোপ ও আমেরিকায় পোলিওর প্রকোপ বেড়ে যায়। মেরুদণ্ড ও শ্বাসযন্ত্রের পক্ষাঘাতের মাধ্যমে পোলিও মানুষকে মেরে ফেলতে এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুগতে বাধ্য করে। একটা সময় কোনো ঔষধেই কাবু না হওয়া পোলিও বর্তমানে অনেকটা প্রতিরোধ যোগ্য হয়ে উঠেছে। টিকার মাধ্যমে মানুষের শরীর পোলিও প্রতিরোধক হয়ে উঠেছে অনেকটা।

আমেরিকা এবং ইউরোপে প্রবলভাবে আঘাত হানে পোলিও; Source: Global Polio Eradication Initiative

পোলিওর একেবারে শুরুর নিদর্শন পাওয়া যায় মিশরীয় এক চিত্রে। ১৪০৩ থেকে ১৩৬৫ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যকার সেই চিত্রে দেখা যায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত একটি মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে। পোলিওর চিহ্নগুলো খুঁজে পাওয়া যায় সেই ব্যক্তির মধ্যে। ১৭৮৯ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক মাইকেল আন্ডারউড প্রথম পোলিওর ক্লিনিক্যাল ব্যাখ্যা দেন। পরবর্তীতে ১৮৪০ সালে জ্যাকব হেইন পুরো ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। শিল্প বিপ্লবের পরপরই এই রোগের উপদ্রব অনেক বেশি বেড়ে যায়। ১৯১৬ সালে নিউ ইয়র্কে পোলিওর প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেসময় পোলিও রোগে আক্রান্ত হন প্রায় ৯,০০০ মানুষ এবং তাদের মধ্যে মারা যান ২,৩৪৩ জন।

এ তো গেল কেবল নিউ ইয়র্কের কথা। পুরো দেশে মোট আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার এবং এতে মারা যান প্রায় ৬ হাজার মানুষ। এ সমস্যার কবলে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয় শিশুরা। ১৯৫২ সালে রেকর্ড ৫৭,৭২৮ জনে পৌঁছায়। ১৯২৮ সালে ফিলিপ ড্রিংকার এবং লুইস শ’ প্রথম পোলিও আক্রান্তদের বাঁচাতে ‘আয়রন লাং’ নামক একটি উদ্ভাবন নিয়ে আসেন। এর মাধ্যমে পোলিও আক্রান্ত যে রোগীরা শ্বাস নিতে পারছিল না তারা বেঁচে যায়। তবে সেবার সবাইকে সাহায্য করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫২ সালে ডক্টর জোনাস স্টল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ রাখেন পোলিও নিরসনের পথে। পোলিও প্রতিরোধ করতে পারে এমন এক টিকার পদ্ধতি আবিষ্কারের কাজ শুরু করেন তিনি। খুব দ্রুত এই টিকা তৈরি হয় আর কাজ করে চমৎকারভাবে।

১৯৫৩ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে পোলিও আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার, সেখানে ১৯৫৭ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় মাত্র ৫,৩০০ জনে। ১৯৬১ সালে আলবার্ট সাবিন প্রথম মুখ গ্রহণযোগ্য টিকা আবিষ্কার করেন। এরপর থেকেই একটু একটু করে দূরীভূত যেতে থাকে পোলিও সংক্রান্ত সমস্যা। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ব্যবহার করতে থাকে এই টিকা। ১৯৮২ সালে যুক্তরাজ্যে নতুন করে কোনো পোলিও আক্রান্তের কথাই জানা যায়নি।

আমেরিকায় পোলিওর তৎকালীন চিকিৎসা; Source: NPR

১৯৮৮ সালের ভেতরেই পোলিও নামক শব্দটি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের অনেকগুলো দেশ থেকে হারিয়ে যায়। তবে আরো ১২৫টি দেশ তখনো এ রোগের ভুক্তভোগী ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ সে বছর সিদ্ধান্ত নেয়, ২০০০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে পোলিওকে নিশ্চিহ্ন করার। পোলিওর টিকা চলে আসে অনুন্নত এবং স্বল্প উন্নত দেশগুলোর হাতেও। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার সমস্ত অঞ্চলকে পোলিওমুক্ত বলে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একে একে পোলিওমুক্ত হয় চীন, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং ইউরোপ। তবে ২০১২ সালেও নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তানে প্রকোপ দেখা যায় পোলিওর। চীন আবার ফিরে আসে নিজের আগের স্থানে। অবশ্য ২০১৩ সালে আবার পোলিওমুক্ত হয় চীন।

২০১৫ সালে পাওয়া তথ্যানুসারে, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান পোলিওর কথা শোনা গেলেও অন্য স্থানগুলো ছিল এর বাইরে। আশার কথা হলো, ২০১৭ সালে পোলিওর নতুন মোট ১৬টি ঘটনা পাওয়া যায়। আর সেগুলো পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ বছরই পোলিওর শেষ বছর। ২০১৮ সালেই পুরোপুরি পোলিওমুক্ত হবে পৃথিবী। কিন্তু সত্যই কি সেটা সম্ভব?

পোলিওর বর্তমান অবস্থা; Source: Twitter

ইউনিসেফের পোলিও নির্মূলকারী উদ্যোগের উপ-পরিচালক জালা আবদেলওয়াহাব জানান, “আমরা এর আগে কখনো সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এত বেশি সাফল্য পাইনি। আশা করছি, পরবর্তী সংক্রমণের সময় পেরিয়ে গেলে আমরা দেখবো যে, সংখ্যাটি শূন্যে নেমে এসেছে”। তেমনটা হলে, ২০১৭ সালের ১৬ নম্বর পোলিও আক্রান্ত রোগীকেই পোলিওর সর্বশেষ রোগী বলে ধরে নেওয়া যায়। বসন্তের (Small pox) পর আরেকটি রোগকেও মানুষ একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে পোলিওর মাধ্যমে। পুরো বিষয়টি অবশ্য কখনোই এত সহজ ছিল না। বেশ বড় একটি পথ পাড়ি দিয়ে তবেই এমন একটি অবস্থানে এসে পৌঁছতে পেরেছে পৃথিবী। রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, ইউনিসেফ- এমন অনেক সংস্থার মিলিত প্রয়াস এটি।

তবে পোলিওকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে যে দুটো জিনিস সবচাইতে বেশি সাহায্য করেছে সেগুলো হলো খাওয়ার টিকা এবং ইনজেকশন। ইনজেকশন অসম্ভব বাজে একটি ব্যাপার ছিল শিশুদের জন্য। সেক্ষেত্রে পোলিও আক্রান্তদের কাতারে এগিয়ে থাকা শিশুদের জন্য মুখে খাওয়ার টিকা আবিষ্কার এবং তার সঠিক প্রয়োগ ছিল বেশ কার্যকরী। খাওয়ার টিকা তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল। মোট ৪৫০ মিলিয়ন শিশুকে ইউনিসেফ প্রতি বছর টিকা খাইয়ে থাকে বলে জানান আবদেলওয়াহাব। পোলিও প্রতিরোধের এই কাজে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হচ্ছে তবুও এই কার্যক্রম নিয়মিত চলছে। পোলিও যদি এরপর থেকে আর নতুন করে কাউকে আক্রান্ত না-ও করে তবুও এই টিকা প্রদানের প্রক্রিয়া সবসময় চালিয়ে যেতে হবে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

শিশুকে পোলিও টিকা খাওয়ানো হচ্ছে; Source: The Logical Indian

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত দুইশ’র বেশি মানুষ কোনোরকম চিহ্ন ছাড়াই পোলিওর ভাইরাস নিজেদের শরীরে নিয়ে ঘুরছে এবং তাদের কাছ থেকে অন্যদের শরীরে পোলিওর জীবাণু সংক্রমিত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তাই সেটি প্রতিরোধ করতে পোলিওর টিকা নেওয়া জরুরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে- এখন যদি পোলিওর টিকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে এক যুগের মধ্যেই পোলিও আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়ে প্রতি বছর ২,০০,০০০ জনে পৌঁছে যাবে। ফলে এক বছর পোলিওর টিকা না দেওয়া বেশ ভয়াবহ প্রভাব এনে দিতে পারে। এতদিন ধরে যে কাজ করে এসেছে মানুষ তার সবটুকুকে ব্যর্থ করে দিতে কেবল একটি বছরই যথেষ্ট। তাই পোলিও সংক্রমণ কমিয়ে ফেলা বা বন্ধ করে দেওয়াটাই মূল উদ্দেশ্য নয়, পোলিওকে একেবারেই পৃথিবী থেকে বিদায় করতে হলে নিয়মিত টিকা নেওয়াটাও দরকার। তাতে করে পোলিও নামক প্রকোপটি আমাদের পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় না নিলেও নতুন করে এর প্রভাবে কোনো সমস্যায় ভুগতে হবে না কাউকে।

বিদায় পোলিও; Source: NCBI

ওপিভি (খাওয়ার টিকা) এবং আইপিভি (ইনজেকশনের মাধ্যমে নেওয়া টিকা)- দু’রকমভাবে পোলিওর টিকা গ্রহণ করা যায়। বর্তমানে খাওয়ার টিকাকে বেশি ব্যবহার করা হলেও পোলিও আক্রান্তদের পরিমাণ কমে শূন্যতে পৌঁছালে আইপিভি ব্যবহার শুরু করার পরিকল্পনা আছে সবার। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আর খুব বেশিদিন বাকি নেই। পোলিও আক্রান্ত মানুষ আর না থাকলে সেক্ষেত্রে পোলিওর টিকা প্রদানের খরচ হয়তো থাকবে, তবে সেটা একটু হলেও কমিয়ে আনা যাবে। বাড়তি টাকা খরচ করা যাবে অন্য কোনো রোগ প্রতিরোধে। সত্যিই কি এমন কিছু হবে? উত্তরটা জানা যাবে এ বছরই!

ফিচার ইমেজ: NCBI

Related Articles