জাপান আমেরিকাকে হারাতে পারবে না। জাপানের উচিত হবে না আমেরিকার সাথে যুদ্ধে যাওয়া।
-ইসোরোকু ইয়ামামোটো
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর সকালে সাম্রাজ্যবাদী জাপানের নৌবাহিনী হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে আমেরিকার নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। অতর্কিত এই আক্রমণ সামরিক ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। এই আক্রমণের ফলেই আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জাপানের নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোটো। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে তিনি শুরু থেকেই আমেরিকার সাথে যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে ছিলেন। এমনকি আক্রমণ করার সময়ও জানতেন জাপান বেশি দিন এই যুদ্ধে পেরে উঠবে না।
ইসোরোকু ইয়ামামোটো ছিলেন সাহসী দেশপ্রমিক এবং জাপানের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সামরিক কৌশলবিদ। ত্রিশের দশকে ইউরোপে যখন ফ্যাসিবাদ চরম আকার ধারণ করছিল, জাপানও দূর প্রাচ্যে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করছিল, ইয়ামামোটো তখন শান্তি বজায় রাখা নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয় তিনি খুব অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। তার দেশের সহকর্মী ও অন্যান্যদের বোঝাচ্ছিলেন পশ্চিমাদেরকে উসকানি দেওয়ার ফল ভালো হবে না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও দুই বছর ওয়াশিংটনে জাপানের নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করার সুবাদে আমেরিকার প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা ছিল। তিনি আমেরিকার শিল্প ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
জাপানের যুদ্ধে জড়ানোর ব্যাপারে তিনি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ ছিলেন না। কিন্তু যখন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত চলে এল, তখন জাপানের সম্মিলিত বহরের প্রধান কমান্ডার হিসেবে তিনি দ্রুতই নিজের সামরিক প্রজ্ঞা বিচার করে দেশের জন্য নেমে পড়লেন যুদ্ধের কৌশল ঠিক করার কাজে। একটা ব্যাপারে তিনি অনড় ছিলেন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের কর্তৃত্ব স্থাপন করার একমাত্র উপায় হিসাবে তিনি হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবার আক্রমণ করার প্রস্তাব দেন। প্রাথমিকভাবে এতে উপর মহলের সমর্থন না পেলেও একসময় তারা ইয়ামামোটোর প্রস্তাব মেনে নেন। বাকিটা ইতিহাস। এই আক্রমণ সফল হলেও জাপান ও ইয়ামামোটোর জন্য কঠিন দুর্যোগ নিয়ে আসে।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
ইসোরোকু ইয়ামামোটো ১৮৮৪ সালের ৪ এপ্রিল জাপানের এক সামুরাই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সাদায়োশি টাকানো ছিলেন একজন সংস্কৃতমনা কিন্তু দরিদ্র স্কুল শিক্ষক। তিনি জাপানের হোনশু দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে নাগাওকা শহরের এক প্রাথমিক স্কুলে সামুরাই ক্লাস নিতেন। ইয়ামামোটো ছিলেন তার সপ্তম সন্তান। ইয়ামামোটোর নামের প্রথম অংশের অর্থ ‘ছাপ্পান্ন’। বাবার ৫৬ বছর বয়সে ইয়ামামোটোর জন্ম হয়। তার শৈশব জীবন ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। একটা ছোট কাঠের ঘরে তারা থাকতেন। ভাত ছিল তাদের কাছে দুর্লভ বস্তু। গরমের সময়টা কাটাতে হতো বাগানের কাজ করে, আর শীতের সময় তুষার পরিষ্কার করে। সারা বছরই মাছ ধরতে হতো জীবিকার জন্য।
শিক্ষাজীবনের শুরুতে তিনি পড়াশোনা করেন খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে, যদিও তিনি কখনো খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেননি। তিনি প্রায়ই ইনফ্লুয়েঞ্জাতে ভুগতেন। বাইবেল পড়তেন, কবিতা লিখতেন, ইংরেজি ভাষা শিখতেন। মিশনারিতে পড়ার সুবাদে ব্রিটিশ ও আমেরিকান সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বাবা তাকে বলতেন আমেরিকায় মানুষখেকো চুল লম্বা দুর্গন্ধযুক্ত বর্বর লোকরা থাকে। কিন্তু বুদ্ধিমান ইয়ামামোটো দ্রুতই এসব কল্পকাহিনী অগ্রাহ্য করেন। পরিবার আর বন্ধুদের সাথে তার স্কুলের মাঠে বেসবল খেলা দেখতে যেতেন। আমেরিকার জাতীয় বিনোদন তখন জাপানেও জনপ্রিয় হচ্ছিল।
তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল শরীরচর্চার প্রতি। তিনি এতেও দক্ষ হয়ে ওঠেন। ১৮৯০ এর দশকে মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময়ে জাপানি সেনাবাহিনী আয়োজিত বার্ষিক মহড়াতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার জাপানি ছেলেদের সাথে ইয়ামামোটোও অংশগ্রহণ করতেন। তরুণ বালকরা এখানে সত্যিকার অস্ত্র ব্যবহার করতে পারত, কিন্তু সেগুলোতে কোনো গুলি থাকত না। ইয়ামামোটো প্রতি বছর রোমাঞ্চের সাথে এই অনুষ্ঠানের অপেক্ষা করতেন।
তিনি ঠিক করেন নৌবাহিনীতে ক্যারিয়ার গড়বেন। নতুন শতক শুরু হলে তিনি ইনল্যান্ড সাগরে এটাজিমার নৌ একাডেমিতে ভর্তির আবেদন করেন। ৩০০ জন আবেদনকারীর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তার বয়স ছিল তখন ১৬ বছর। একাডেমির শাসন ছিল খুব কড়া। ক্যাডেটদের জন্য পানাহার, ধূমপান, মিষ্টি খাওয়া এবং নারীসঙ্গ নিষিদ্ধ ছিল। চতুর্থ বর্ষ তাদের কাটাতে হতো নৌবাহিনীর জাহাজে। ইসোরোকু ১৯০৪ সালে তার শ্রেণিতে সপ্তম স্থান অধিকার করেন।
ইয়ামামোটো পশ্চিমা ভাবধারাকে সম্মান করতেন। কিন্তু তার সহপাঠীদের মধ্যে এই শ্রদ্ধাটা ছিল না। জাপানের নৌবাহিনী ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনী দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিল। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র উন্নত প্রযুক্তি, সামরিক কৌশল আর যুদ্ধপদ্ধতি সম্পর্কিত ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ ছিল। জাপানের সামরিক বাহিনীর পশ্চিমাদের প্রতি ঘৃণা থাকার কারণও ছিল। ১৮৯৪-৯৫ সালে সাইনো-জাপানি যুদ্ধে জাপান চীনের কাছ থেকে দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়ার উপদ্বীপ দখল করে নেয়। ফ্রান্স, জার্মানি ও রাশিয়া জাপানকে চাপ দেয় কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি চীনের কাছে ফিরিয়ে দিতে। পশ্চিমাদের প্রতি বিশেষ প্রীতি থাকার অভিযোগ থাকলেও ইয়ামামোটো তাদের প্রযুক্তিগত, সামরিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো বোঝার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন।
নৌবাহিনীতে কর্মজীবন ও আমেরিকায় গমন
১৯০৪ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর গানারি স্পেশালিস্ট হিসাবে কাজ করা শুরু করেন। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রুশো-জাপানি যুদ্ধ। তরুণ যোদ্ধাকে তখন পাঠানো হয় সাম্রাজ্যবাদী নৌবহরের নিসসিন ক্রুজারে, যার অ্যাডমিরাল ছিলেন হেইহাচিরো টোগো। ১৯০৫ সালের ২৬-২৮ মে তাকে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। তখন সুশিমা প্রণালিতে জাপান-কোরিয়ার যুদ্ধের সময় রুশ যুদ্ধ জাহাজগুলোকে ধ্বংস হতে দেখেন। আয়রনক্ল্যাডের সেই যুদ্ধে জাপানের নৌবাহিনী রুশ শক্তিকে উড়িয়ে দেয়। রাশিয়ার ১২টি বড় যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়। জলপথে প্রায় সমশক্তির দুই পক্ষের যুদ্ধে এ রকম এক তরফা বিজয় ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি। ব্রিটেনে পড়শোনা করা নির্দয়-নিষ্ঠুর অ্যাডমিরাল টোগো হয়ে যান জাতীয় বীর।
২৭ মে সুশিমার যুদ্ধের সময় ইয়ামামোটো মারাত্মকভাবে আহত হন। বোমার আঘাতে উরুর মাংস উড়ে যায় তার। বাম হাতের দুই আঙুলও হারান। দুই মাস হাসপাতালে কাটানোর পর নিজ শহর নাগাওকাতে ফিরে আসেন অসুস্থতার ছুটি কাটাতে। সুস্থ হওয়ার পর তিনি গানারি স্কুলে ফিরে যান। এরপর পদোন্নতি পেয়ে কমান্ডার হন এবং টোকিওতে নৌবাহিনীর সদর দফতরে কাজ করা শুরু করেন। এই সময়টাতে তিনি চীন ও কোরিয়াতে ক্রুজ জাহাজগুলোতে প্রশিক্ষণ নেন।
১৯১৩ সালে তিনি নেভাল স্টাফ কলেজে ভর্তি হন। নৌবাহিনীতে পদোন্নতির জন্য এখানের ডিগ্রির প্রয়োজন ছিল। ১৯১৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট হন এবং ১৯১৫ সালে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদে উন্নীত হন। ১৯১৬ সালে তার স্নাতক সম্পন্ন করেন। এ সময়টাতে তার বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা মদ্যপান ও ফূর্তিতে কাটানো সহকর্মীদের তুলনায় তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ইয়ামামোটো যদিও নারীসঙ্গের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট ছিলেন, কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি অধিক পরিমাণ অ্যালকোহল পান করে থাকতে পারবেন না। তাই মদ্যপান ছেড়ে দেন। তবে তিনি ছিলেন ভয়ঙ্কর জুয়াড়ি। কখনো কখনো অর্ধেক রাত পার করে দিতেন শোগি (জাপানি দাবা) খেলে। বেশ কয়েকটি প্রেম করার পর ১৯১৮ সালের আগস্টে রেইকো নামের এক রূপবতী নারীকে বিয়ে করেন। তাদের ছিল দুই ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তান।
১৯১৯ সালের এপ্রিলে তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। তার বিষয় ছিল অর্থনীতি ও পেট্রোলিয়ামের উৎস নিয়ে। তার সাথে ছিলেন আরো ৭০ জন স্বদেশী সহপাঠি। ইয়ামামোটো খুব সহজেই আমেরিকান জীবনযাত্রার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেন। সেখানকার ব্রিজ আর পোকার খেলা দ্রুতই শিখে নেন। পোকারের প্রতি তার ছিল বিশেষ আকর্ষণ। তিনি পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন। সব জায়গাতেই পড়াশোনা করতেন। ইংরেজিতে খুব দক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি রাতে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমাতেন।
জাপানি অফিসারদের পড়াশোনার পাশাপাশি পশ্চিমে পাঠানো হতো দেশগুলো সম্পর্কে তথ্য পাঠানোর জন্য। তাই ইয়ামামোটো তার অবসর সময়টাতে আমেরিকায় ঘুরে বেড়াতেন। শিল্প আর প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে তেল সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা করতেন। তিনি জানতেন আধুনিক নৌবাহিনীর জন্য তেল হতে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কয়েকটা তেলের কোম্পানি তাকে চাকরির প্রস্তাবও দিয়েছিল।
হার্ভার্ডে পড়ার সময় ইয়ামামোটো নৌ বিমানচালনা নিয়েও আগ্রহী হয়ে ওঠেন, যেটা নিয়ে ১৯১২ সালে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে কাজ শুরু হয়েছিল। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ‘এইচএমএস আরগাস’ এর কাজ শেষ হয়, যা ছিল বিশ্বের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। নৌ বিমানচালনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ থাকা ইয়ামামোটোকে ভবিষ্যত কর্মক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে দেয়। তিনি দ্রুত বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন- জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা আর শিল্পক্ষেত্রে জটিলতা থাকার কারণে আমেরিকার সাথে যুদ্ধে জাপান পেরে উঠবে না।
(এরপর দেখুন ২য় পর্বে)
This is a Bengali article is written about admiral Isoroku Yamamoto.
References
1. From the Nisshin to the Musashi: The Military Career of Admiral Yamamoto Isoroku, Association for Asian Studies
2. Why Admiral Isoruoku Yamamoto Warned Imperial Japan Not to Attack America, Yahoo News
3. A Reluctant Enemy, New York Times
Featured Image: Wikimedia