Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: প্রাচ্যের প্রাচুর্য (পর্ব ৪)

তৃতীয় পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: মিশরের নতুন দেবতা

আলেকজান্ডার দামেস্ক থেকে এগিয়ে গেলেন পূর্ব দিকে, দারিউস তার বাহিনী নিয়ে ব্যাবিলন থেকে পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দুই বাহিনী একে অপরের মুখোমুখি হলো গগামেলার বিশাল প্রান্তরে। দারিউস গগামেলায় আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং আলেকজান্ডারের আগেই পুরো যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে আগেই খোঁজখবর নিয়ে রাখলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্র এমনভাবে সাজালেন, যেন আলেকজান্ডার কোনো বুবি ট্র্যাপ কিংবা প্রাকৃতিক কোনো সুবিধা না পান। দারিউস এবার আরো বেশি সৈন্য জড়ো করেছেন। দু লক্ষ সৈন্যের সাথে ৪০ হাজার ঘোড়সওয়ারের এই বিশাল পার্সিয়ান বাহিনী অপেক্ষা করছে মেসিডন বাহিনীর আগমনের অপেক্ষায়।

যতই যুদ্ধ ঘনিয়ে আসতে থাকল, আলেকজান্ডারের নিজের আত্মবিশ্বাস যেন ক্রমেই বেড়ে চলছিল। গ্রানিকাস, ইসাস আর টায়ারের যুদ্ধ থেকে শুরু করে ছোটখাটো সব যুদ্ধই জিতে আসায় মেসিডন বাহিনীর মনেও গেঁথে গিয়েছিল আলেকজান্ডার অদম্য, কোনো শক্তিই তার বাহিনীকে থামাতে পারবে না। আমুনের মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আলেকজান্ডারও একই জিনিস ভাবা শুরু করেছেন। পার্সিয়ান বাহিনীর বিশাল সংখ্যা কিংবা প্রস্তুতিও তাকে সামান্যতম বিচলিত করেনি, বরং তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন এশিয়া কোনো বাধা ছাড়াই তার পদানত হবে।

যুদ্ধের আগের রাতে পারমেনিয়ন আলেকজান্ডারকে পরামর্শ দিলেন, রাত থাকতেই পার্সিয়ানদের অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু আলেকজান্ডার এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি কোনোরকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে চাইলেন না। এমনকি সকালবেলা তার সেনাপতিরা তাকে ডেকে তুলেছিলেন প্রস্তুতি নিতে দেরি হওয়ার জন্য। এদিকে ঐ রাতেই দারিউসের স্ত্রী স্তাতেইরা মারা যান, প্রাকৃতিক কারণে, নাকি মেসিডনদের ভুল চিকিৎসার কারণে- তা জানা যায়নি।

নিজেদের একজন সৈন্যের বিপরীতে পার্সিয়ানদের পাঁচজন দেখে আলেকজান্ডার সরাসরি আক্রমণ করতে রাজি হলেন না। এদিকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো, পার্সিয়ান বাহিনীর একেক দল একেক জায়গা থেকে এসেছে। ব্যাকট্রিয়া, পার্সিয়া, মিডিয়া, ব্যবিলন থেকে শুরু করে পার্সিয়ার বিভিন্ন কোণা থেকে দারিউস নিজের সৈন্যদল সাজিয়েছেন। আলেকজান্ডারও সেভাবেই পরিকল্পনা করলেন। যুদ্ধের জন্য আলেকজান্ডার তার প্রিয় ঘোড়া বুকেফ্যালাসকে সাথে নিলেন। বুকেফ্যালাসকে এখন আলেকজান্ডার সবসময় ব্যবহার করেন না, তার ছোটবেলার সাথীর শক্তি ধরে রাখার জন্য। কিংস কম্প্যানিয়নদেরকে সাথে নিয়ে আলেকজান্ডার সামনে এগিয়ে গেলেন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।

গগামেলার যুদ্ধে ভারত থেকে আনা হাতি; Image Credit: Marshall Monroe

ফ্যালানক্স রেজিমেন্ট সরাসরি পার্সিয়ানদের মাঝখানে আক্রমণ চালাল এবং ক্রমাগত নিজেদের ডানদিকে সরে যেতে থাকল। নিজেদের নিশ্ছিদ্র ঢাল একত্র করে একপা একপা করে পার্সিয়ানদেরকে পেছনের দিকে ঠেলতে থাকলো মেসিডন বাহিনী। এদিকে, ডানদিকে সরে যাওয়ায় দারিউসও পার্সিয়ান বাহিনীকে নিজেদের বাঁদিকে সরে আক্রমণ চালাতে বললো। দারিউস তার রথারোহী বাহিনীকেও যুদ্ধের শুরুর দিকেই ব্যবহার করে ফেলেছিল। তাদেরকে থামাতে আলেকজান্ডার বেশ কিছু অকুতোভয় মেসিডনকে নিযুক্ত করলেন, যারা হঠাৎ ঢালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রথের ঘোড়াগুলোকে আক্রমণ করে আবার ফিরে আসবে। এভাবে দারিউসের রথারোহী বাহিনী মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল।

গগামেলার যুদ্ধ; Image Source: Medium

মূল ফ্যালানক্স বাহিনী একদিকে সরে যাওয়াতে পার্সিয়ানদের মূল বাহিনীও বাঁদিকে ঘেঁষে সরে পরেছিল। ফলে, পার্সিয়ানদের বাহিনীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পার্সিয়ান বাহিনীর বাঁদিকে বেশি সৈন্য চলে আসে আর মাঝখানে ফাঁকা হয়ে পড়ে। আলেকজান্ডার এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ কিং’স কম্প্যানিয়ন্সদেরকে নিয়ে সরাসরি দারিউসকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়ে বসেন আলেকজান্ডার।

মুহূর্তেই পার্সিয়ান বাহিনীর সামনের অংশ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে, আলেকজান্ডারের ঘোড়সওয়ার বাহিনী দারিউসের অনেকটা কাছাকাছি চলে আসে। এটি দেখে দারিউস ইসাসের মতো আবারো তার স্বল্পসংখ্যক বাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। পার্সিয়ান বাহিনী দারিউস পালানোর পর মনোবল হারিয়ে ফেলে। প্রান্তরের বিভিন্ন প্রান্তে মেসিডন বাহিনীকে পরাস্ত করে ফেলা বেশ কিছু পার্সিয়ান উপদল জিতে গেলেও দারিউসের পলায়ন দেখে তারাও হাল ছেড়ে দেয় এবং আত্মসমর্পণ করে।

গগামেলায় আলেকজান্ডারের যুদ্ধকৌশল; Image Source: The Department of History, United States Military Academy

পার্সিয়ানদের রাজাদের রাজা দারিউস পালিয়ে গেলেন আরবেলায়, গগামেলা থেকে ৫০ মাইল দূরে। পুরোটা রাস্তাই আলেকজান্ডার আর তার কিংস কম্প্যানিয়ন্স তাকে ধাওয়া করে গেল ধরার জন্য। কিন্তু বুকেফ্যালাসের পিঠে চড়ে আলেকজান্ডার যখন আরবেলায় পৌঁছালেন, তখন টের পেলেন, শিকার সেখান থেকেও পালিয়েছে। যদিও এটি তখন আর কোনো বড় ব্যাপার নয়। আলেকজান্ডার তার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন।

পারস্যের বিশাল প্রান্তর এখন তার জন্য খোলা, তাকে বাধা দেওয়ার মতো আর কেউ অবশিষ্ট নেই। আলেকজান্ডার এবার তার বাহিনী নিয়ে ধীরে ধীরে ব্যাবিলনের দিকে অগ্রসর হলেন। ব্যাবিলন সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু আর আকেমেনিড সাম্রাজ্যের উপ-রাজধানী এই বিখ্যাত শহরের অধিবাসীরা আলেকজান্ডার আসাতেই ফটক খুলে দিলেন, গগামেলায় দারিউসের পতনের সংবাদ আগেই পৌঁছে গিয়েছে।

ব্যাবিলনে আলেকজান্ডার আর তার বাহিনী; Artist: Sebastien Leclerc

আলেকজান্ডার অন্য যেকোনো মেসিডন কিংবা গ্রিক সেনাপতিকে অনেক আগেই পেছনে ফেলে রেখে এসেছেন, তাদের তুলনায় সাম্রাজ্য কয়েকগুণ বড়। কিন্তু আলেকজান্ডার এতেও সন্তুষ্ট নন। পারস্যের বিখ্যাত দুই রাজধানী- সুসা আর পার্সেপোলিসও তার করায়ত্ত করা চাই। সুসার কথা উল্লেখ রয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টেও। তখনকার সময়ে মূলত পারস্যের চারটি রাজধানী ছিল: সুসা, পার্সেপোলিস, পাসারগাডা আর একবাটানা। সুসার পতন ঘটল কোনোরকম বাধা ছাড়াই। সুসার বিশাল সম্পদের কারণে মুহূর্তের মধ্যেই আলেকজান্ডার তার সময়ের সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত হলেন।

৪০ হাজার ট্যালেন্ট (১ ট্যালেন্ট = ৫৮ পাউন্ড) রূপার বিশাল পাহাড়ের মালিক বনে গেলেন তিনি। তবে আলেকজান্ডার ধন-সম্পদের প্রতি ততটা আসক্ত ছিলেন না। ফলে, কয়েকদিনের মধ্যেই এই বিশাল পরিমাণ সম্পদের প্রায় পুরোটাই মেসিডন বাহিনীর মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে ছড়িয়ে পড়লো।

সুসার পর আলেকজান্ডারের পরবর্তী গন্তব্য পার্সেপোলিস। মেসিডন বাহিনী পূর্বদিকে এগোতেই ধীরে ধীরে মাটির ধরন-গড়ন পরিবর্তন হতে শুরু করল। ব্যাবিলন আর সুসা, দুটো শহরের পাশেই সুপেয় পানির অভাব ছিল না। কিন্তু আলেকজান্ডার যতই পার্সেপোলিসের দিকে এগোতে থাকলো, ততই পানির অভাব দেখা যেতে শুরু করল। পারসা নামে পরিচিত (বর্তমান ইরানের ফারশান প্রদেশ) এই এলাকাতেই নিজের আস্তানা গেড়েছিলেন সাইরাস দ্য গ্রেট। পার্সিয়ান গেট বাধা হয়ে দাঁড়াল আলেকজান্ডারের সামনে, এই সরু গিরিখাতে পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে কাটা কলাগাছের মতো নুয়ে পড়ছিল মেসিডন সেনারা। গ্রিসের থার্মোপাইলির মতো এখানেও ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলো এক বিশ্বাসঘাতক। তার দেখানো বিকল্প পথে পার্সেপোলিসে তার বাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়ল আলেকজান্ডার।

পার্সেপোলিসে ঢোকার পর আলেকজান্ডার আর তার বাহিনী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো পুরো শহরের দিকে। বসতিহীন এই শহরে যেন পৃথিবীর অসাধারণ সব স্থাপনা এক জায়গায় তৈরি করা হয়েছে। সাইরাস, দারিউস আর জারজিসের উদ্দেশ্যে তৈরী স্তম্ভ, এমনকি ‘দ্য ইম্মোরটালস’ হিসেবে খ্যাত পারস্যের ১০ হাজার সৈন্যের সেই বিখ্যাত ব্যাটালিয়ন নিয়েও রয়েছে অনেকগুলো স্তম্ভ। ইতোমধ্যেই আলেকজান্ডার খোঁজ পেলেন দারিউস কয়েক শত মাইল উত্তরে থাকা একবাটানায় আশ্রয় নিয়েছেন।

দারিউসের কাছ থেকে তেমন কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই বলে আলেকজান্ডার শীতকাল বিশ্রামে কাটানোর জন্য পার্সেপোলিসকেই বেছে নিলেন। পাসারগাডে থাকা সাইরাস দ্য গ্রেটের সমাধিতেও আলেকজান্ডার ঢুঁ মারলেন। পার্সেপোলিসের বিশাল সব প্রাসাদ আর স্তম্ভের তুলনায় সাইরাসের এই সমাধি একেবারেই সাদামাটা। পাথরের সমাধিতে খোদাই করে লেখা,

হে মানুষ, জেনে রাখো এটি হলো সাইরাস, যে পার্সিয়ান সাম্রাজ্য তৈরি করেছে এবং সমগ্র বিশ্বকে শাসন করেছে। তার উপর হিংসা করতে পারো, তার সমাধিকে নয়।

আলেকজান্ডার সাইরাসের এই সমাধি দেখে খানিকটা থমকেই গেলেন। সুসা, পার্সেপোলিস, ব্যাবিলন কিংবা মিশর, এশিয়া মাইনর থেকে গ্রিস, কোথাও এত সাধারণ রাজার সমাধি দেখেননি আলেকজান্ডার। এটি কি নিছকই রসিকতা, নাকি এটিই সাইরাসের মহত্ত্বের আরেক উদাহরণ?

পার্সেপোলিসের ধ্বংসাশেষ; Image Source: ThoughtCo.

৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তে পার্সেপোলিসের প্রধান রাজপ্রাসাদ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আলেকজান্ডারের আদেশেই তা করা হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। তবে অনেক ইতিহাসবিদের মতে, তিনি ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অ্যাথেন্স জ্বালিয়ে দেওয়া পার্সিয়ানদের সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। তবে তিনি সুসা কিংবা অন্যান্য শহরের ওপর তেমন কোনো ধ্বংসযজ্ঞ চালাননি, এমনকি পার্সেপোলিসও পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়নি। আলেকজান্ডার যদি আসলেই অ্যাথেন্সের প্রতিশোধ নিতেন, তবে অন্য শহরগুলোতেও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতেন, বসতিবিহীন পার্সেপোলিসে নয়। 

পঞ্চম পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: পৃথিবীর শেষ প্রান্তে

Related Articles