Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্লাউনদের অজানা ইতিহাস

আমরা যারা ছোটবেলায় সার্কাস দেখেছি, সেই সার্কাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রটি ছিল এক অদ্ভুত দর্শনের বিচিত্র পোশাক পরা লোক, যারা ক্লাউন বা ‘ভাঁড়’ হিসেবে অধিক পরিচিত। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যাবে, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে এসেও এই ক্লাউন চরিত্রটি দর্শকদের বিনোদনের এক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিভিন্ন প্যারেড, সার্কাস এবং উৎসবে তাদের অংশগ্রহণ এককথায় অবধারিত। মুখে রঙ মেখে, নকল নাক ও পরচুলো পরে সে হয়ে ওঠে অন্য সবার থেকে আলাদা। রঙচঙে পোশাক আর বৈচিত্র্যময় প্যান্টালুন পরিহিত এ ক্লাউনদের নীরব ভাবভঙ্গি ও  শারীরিক কসরত দেখে না হেসে থাকা যায় না।

কিন্তু আজকের দিনে ক্লাউনদেরকে যে মেকআপ এবং বৈচিত্র্যময় পোশাকে আমরা দেখতে পাই, পূর্বে তারা এই অবস্থায় ছিলো না। ইতিহাসে দেখা যায়, সময়ের সাথে সাথে তাদের পোশাক, চালচলন এবং কাজের পরিধির ক্ষেত্রেও এসেছে নানা বিবর্তন। 

ক্লাউন চরিত্রের উৎপত্তি

বিশ্বের নানা প্রাচীন পুঁথি থেকে জানা যায়, ২৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরে প্রথম ক্লাউনদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন হায়ারোগ্লিফ থেকে জানা যায়, মিশরের পঞ্চম রাজবংশে ক্লাউনদের ভূমিকা ছিল রাজদরবারে ফারাওদের এবং তাদের পরিবারের মাঝে হাস্যকৌতুক উপস্থাপন করা। রাজা, তার পরিবারবর্গ ও সভাসদদের হাসিখুশিতে মাতিয়ে রাখতে তাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল।

প্রাচীন মিশরের রাজ দরবারে ফারাওদের মনোরঞ্জনের জন্য ভাঁড়দের ব্যবহার করা হতো; Image Source: wikimedia commons

প্রাচীন চীনে ১০৪৬- ২৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঝৌ রাজবংশের সময় ভাঁড় হিসেবে রাজদরবারে ক্লাউনদের অংশগ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়। সে সময়ের এক বিখ্যাত ভাঁড়ের নাম আজও ইতিহাসে রয়ে গেছে। তার নাম ইয়ু সেজ্যু। তিনি চীনের শিহ হুয়াং তি রাজার দরবারে কৌতুক পরিবেশন করতেন।

১০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্লাউন বা বিদুষক রাজ দরবারের অনুবাদক হিসেবে কাজ করতেন। চতুর্দশ শতকে জাগলার হিসেবে তাদের আবার নতুন রূপে দেখতে পাওয়া যায়।

মধ্যযুগে নাগরিক মঞ্চে বিনোদনের মাধ্যম

মধ্যযুগে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের রাজ দরবারে হাস্যকৌতুক মিশ্রিত নানা গল্পগাঁথা পরিবেশন করার কাজটি করতেন ক্লাউনরা। তারা খুবই পেশাদার ছিলেন। রাজসভায় নানা হাসি-ঠাট্টার আড়ালে কোনো সাম্প্রতিক বিষয় তুলে ধরতে তাদের জুড়ি ছিল না। মধ্যযুগের শেষে এসে রাজদরবারে ক্লাউনদের উপস্থিতি যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি শহরের নাগরিকদের বিনোদনের জন্য মঞ্চে তাদের অংশগ্রহণ ছিল বেশ চোখে পড়ার মতো।

প্রাচীন গ্রিস এবং রোমের নাগরিক মঞ্চগুলোতে ক্লাউন চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মঞ্চে তাদের চরিত্রটি ছিল মূলত বোকা চরিত্রে অভিনয় করা। একটি নির্দিষ্ট চরিত্রের মধ্যে তাদের অভিনয় সীমাবদ্ধ ছিল বলে পরে সকলের মাঝে তাদের চরিত্রটি ক্লাউন হিসেব পরিচিতি পেতে থাকে। মধ্যযুগের ধর্মীয় নাটকগুলোতে তারা হাস্যকৌতুকের মধ্য দিয়ে কমিক খলনায়কের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতেন। নাটকগুলোতে তাদের চরিত্রগুলো ধীরে ধীরে আরও বেশি করে ভাঁড়ামিতে পর্যবসিত হতে থাকে। অনেকেই মনে করেন, আজকের ক্লাউনদের যে কিম্ভূতকিমাকার সাজপোশাক এসেছে, তা ঐ সময়ে মঞ্চের কমিক শয়তানের চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত।

মধ্যযুগের ধর্মীয় নাটকগুলোতে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে ক্লাউন চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে; Image Source: wikimedia commons

প্রাচীন রোমেও একইভাবে মঞ্চের বিভিন্ন নাটকে ক্লাউন চরিত্রটি নানাভাবে উপস্থিত হতে দেখা যায়। সেখানে ক্লাউনরা একটি নির্দিষ্ট ডিজাইনের টুপি পরিধান করতো, বিভিন্ন রকম খেলা দেখাতো। এই সময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্যণীয়।

সেই সময়টিতে মঞ্চে আবার কিছু যাযাবর কৌতুক শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে, যারা কৌতুক পরিবেশনের পাশাপাশি ‘জাগলিং’ করতে পারতো, কেউ দেখাতে পারতো দড়ির খেলা, আবার অনেকে নানারকম শারীরিক খেলা ও ভেলকিও দেখাতে পারতো। পরবর্তীতে এ যাযাবর ক্লাউনদের সংখ্যা খুব কমে এলেও বিভিন্ন মেলাতে তাদের অংশগ্রহণ দেখা যেতো। 

নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে ক্লাউন চরিত্রের ভিন্ন প্রকাশ

নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে ক্লাউনের উপস্থিত রোমের ইতিহাস থেকে সামান্য ভিন্ন। উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে কোনো গোপন কার্যসিদ্ধির জন্য ক্লাউন চরিত্রের সাহায্য নিতে দেখা যেতো। তারা হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে কোনো গোপন সত্য প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে উন্মুখ থাকতেন। আবার নেটিভ আমেরিকানদের কিছু উপজাতি হাসাহাসিকে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে আসার অন্যতম এক উপায় হিসেবে ভাবতেন।

নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যেও ক্লাউন চরিত্রটির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়; Image Source: pinterest

উনবিংশ শতক এবং আধুনিক ক্লাউনের স্রষ্টা

অষ্টাদশ শতকে এসে দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ক্লাউন চরিত্রটি। এই সময়ে চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এ সময় রঙ্গমঞ্চে জোসেফ গ্রিমাল্ডি নামের মুখাভিনেতা ক্লাউন চরিত্রটিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তাকেই আধুনিক ক্লাউনের স্রষ্টা হিসেবে সকলে মানেন। ১৮০০ সালের শুরুর দিকে জোসেফ গ্রিমাল্ডি লন্ডনে তার পরিবেশনায় নতুন মাত্রা নিয়ে আসেন। তিনি ফিজিক্যাল কমেডি করতে ভালবাসতেন। তিনিই প্রথম পোশাকপরিচ্ছদ ও চেহারায় বৈচিত্র্য নিয়ে আসেন। 

অষ্টাদশ শতকে ক্লাউন চরিত্রটিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান জোসেফ গ্রিমাল্ডি; Image Source: wikimedia commons

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে এবং উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে তিনি দর্শকদের সবার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালের ক্লাউনদের ওপর তার প্রভাব ছিল বিরাট। জোসেফ গ্রিমাল্ডি ক্লাউন হিসেবে এক নতুন ধারা নিয়ে আসেন। তার পোশাকআশাকে ষোড়শ শতকের ইতালির দাস-চরিত্রের পোশাকআশাকের ছায়া লক্ষ্য করা যেত। পরনের প্যান্টটা ছিল একটু আলাদা রকমের, আর মাথাতেও ছিল বিচিত্র পরচুলা। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল পুরু ফাউন্ডেশনে মুখ, ঘাড় ও বুকের উন্মোচিত অংশে রক্তলাল ক্ষত, একটি চওড়া মালা, বিশাল পেটুক, গুহার মতো মুখ এবং ঠিকরে আসা চোখ। বেশ ভয়ঙ্কর ছিল তার চরিত্র রুপায়ন। এ সাজকে পরবর্তীতে ‘জোয়ি’ নামে অভিহিত করা হয়।

উনবিংশ শতকের জনপ্রিয় ক্লাউনদের কথা

গ্রিমাল্ডির পর জোয়ি ক্লাউনরাও সার্কাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন ‘হুইমজিক্যাল ওয়াকার’। একই সময়ে ফ্রান্সে জেন-গাসপার্ড ডিবুরো নামের একজন ক্লাউন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনিই প্রথম পেশাদার মুকাভিনেতা হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পান। গ্রিমাল্ডির মতো তিনিও তার পোশাক ও চেহারায় বৈচিত্র্য আনতে সচেষ্ট হন। ১৮৩৬  সালে ডিবুরো এক ছেলেকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন। পরে তিনি জেল থেকে মুক্তি পেলেও খুনি ক্লাউন হিসেবে জনগণের মাঝে কুখ্যাত হয়ে পড়েন। 

ফরাসিদের মধ্যে ক্লাউন চরিত্রকে জনপ্রিয় করেন জেন-গাসপার্ড ডিবুরো; Image Source: wikimedia commons

১৮৯২ সালে এক ইতালীয় অপেরা ‘পেগলিয়াসি’ (ক্লাউনস) দর্শকদের মাঝে খুব প্রশংসিত হয়। এই অপেরার ক্যানিও নামের চরিত্রটি খুব জনপ্রিয় হয়।

বিংশ শতকে জনপ্রিয় বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম

উনবিংশ শতকের শেষ দিকে আবির্ভাব ঘটে নতুন একধরনের ক্লাউনের। সাদামাটা পোশাক, বিরাট ব্যাগি প্যান্ট, গায়ের তুলনায় বিরাট লম্বা কোট, বড় বড় জুতো আর মোটা গোল লাল নাক। এই ক্লাউনদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন গ্রক।

এই সময়ে সার্কাসের স্টাইলের ‘ক্লাউনিং’ নির্বাক চলচ্চিত্রের পক্ষে বেশ উপযুক্ত ছিল। আর নির্বাক চলচ্চিত্রে ক্লাউন চরিত্রটিতে নতুন এক মাত্রা এনে দেন চার্লি চ্যাপলিন। তার ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি আপামর দর্শকের মাঝে বেশ প্রশংসিত হয়। তিনি এমন এক চরিত্রের সৃষ্টি করলেন, যিনি সার্কাসের মতো ক্লাউন হয়েও অত্যন্ত বাস্তব ও করুণ এক চরিত্র। তিনি এবং গ্রক অনেক নির্বাক চলচ্চিত্রে জুটি বেধে অংশ নেন।

নির্বাক চলচ্চিত্রে ক্লাউন চরিত্রটিতে নতুন মাত্রা আনেন চার্লি চ্যাপলিন; Image Source: Mature Times

উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সার্কাসে ক্লাউনদের রমরমা অবস্থা বাড়তে থাকে। এখানকার সার্কাসগুলোতে হোবো ক্লাউনরা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ হোবো ক্লাউনরা সাধারণত বিষণ্ন মুখ আর ছেঁড়া কাপড়ে সার্কাসে ঘুরে বেড়াতো, যা তখনকার মার্কিন সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়। এমনই এক হোবো ক্লাউন শিল্পী ছেলেন এমমেট কেলি। 

যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় হোবো ক্লাউন শিল্পী এমমেট কেলি; Image Source: wikimedia commons

১৯৫০ এবং ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি সময়ে শিশুদের বিনোদেনের জন্য বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রামে ক্লাউন চরিত্রের সৃষ্টি হয়। সে সময়ে তেমনি একটি জনপ্রিয় টিভি প্রোগ্রাম ছিল ‘বোজো দি ক্লাউন’।

তবে ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে আমরা ক্লাউনদের আরেক বিভৎস রূপ দেখতে পাই। জন ওয়েন গেসি নামের এক রেজিস্টার্ড ক্লাউনকে শিকাগো শহরে যৌন নির্য়াতন এবং ৩৫ জন যুবককে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৯৪ সালে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। 

ক্লাউন চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেন জন ওয়েন গেসি; Image Source: wikimedia commons

বর্তমান সময়ে এসে ক্লাউন চরিত্রটি শুধু আর রঙ্গমঞ্চে বা সার্কাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এই চরিত্রের সার্থক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে আমাদের এই সমাজ জীবনে এমন কিছু সত্যিকার ক্লাউনের দেখা আমরা পাই, যাদের দেখে হাসির চেয়ে তাদের প্রতি করুণাই প্রকাশ পায় অনেক বেশি।

ফিচার ইমেজ- festival.si.edu

Related Articles