ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বে আরবের প্রাচীন নানা সভ্যতা

সভ্যতা পৃথিবীর ইতিহাসকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি করেছে গতিশীল। সভ্যতার ফলে এসেছে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলো মানুষকে দান করেছে অসীম জ্ঞান, যা মানুষের উন্নতিকে এগিয়ে নিতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। সভ্যতার উৎকর্ষ যেমন মানুষকে করেছে উন্নত, তেমনি সভ্যতার পতনে মানুষের আবিষ্কারগুলো চাপা পড়েছে মাটির গভীরে।

সভ্যতার আঁতুড়ঘর হিসেবে খ্যাত মেসোপটেমিয়ার সমসাময়িক আরবেও গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু প্রাচীনতম সভ্যতা। সমগ্র আরব ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সভ্যতার ছায়াতলে এসেছিল সেই সময়ে। আরবরা যাযাবর বা বেদুঈন জাতি হলেও তাদের মধ্যেই কিছু কিছু জাতি এই সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করতে পেরেছিল। ফলে তারা একইসাথে নিজেদের এবং পৃথিবীর মানুষের জন্য সেসব সভ্যতার চিহ্ন রেখে গেছে। মধ্য আরব থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে দক্ষিণ ও উত্তর আরবে এসব সভ্যতা ছড়িয়ে পড়ে।

অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা বা আরব উপদ্বীপে অনেক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে এই উপদ্বীপে অবস্থিত দেশগুলো হলো সৌদি আরব, ইয়েমেন, ওমান, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার। পাঠক, চলুন দেখে নিই এসব অঞ্চলে কোন কোন সভ্যতা বা জাতির গোড়াপত্তন ঘটেছিল।

দিলমুন সভ্যতা

আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর পূর্বে (খ্রিস্টপূর্ব ৪,০০০ সাল) পারস্য উপসাগরের তীরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন আরবের সবচেয়ে পুরনো এক সভ্যতা, দিলমুন। এটি ছিল পূর্ব আরবের একটি প্রাচীন সেমিটিক-ভাষী সভ্যতা। দিলমুনকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। মূলত দিলমুন সভ্যতা ছিল মেসোপটেমিয়ার সমসাময়িক একটি সভ্যতা। এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রও ছিল। বর্তমান বাহরাইন ছিল প্রাচীন দিলমুন সভ্যতার কেন্দ্রীয় স্থান। এটি পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ছিল, আর মেসোপটেমিয়া এবং সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে এর বাণিজ্য ব্যবস্থা ছিল। ক্ষমতার উচ্চপর্যায়ে পৌঁছার পর পারস্য উপসাগরীয় বাণিজ্য রুটগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করত এই সভ্যতা।

দিলমুন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ; Image source: kita1010

সুমেরীয়রা দিলমুনকে পবিত্র ভূমি বলে মনে করত। সুমেরীয়দের গিলগামেশ মহাকাব্যে দিলমুনকে স্বর্গের বাগান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। দিলমুনের এই উদ্যানকে সুমেরীয় কাহিনী গার্ডেন অব ইডেনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। দিলমুন সভ্যতার প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপিতে। সেসব মাটির ট্যাবলেটে লেখা লিপি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষের দিকে উরুক শহরের দেবী ইনানার মন্দিরে পাওয়া যায়।

মাটির ট্যাবলেটে লেখা কিউনিফর্ম লিপি; Image source: gei.aerobaticsweb.org

চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ থেকে ১,৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত দিলমুন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ৩০০ বছরে দিলমুন খুব সমৃদ্ধ ছিল। ২,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১,৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে দিলমুনের বাণিজ্যিক শক্তি হ্রাস পেতে শুরু করে। মূলত পারস্য উপসাগরে জলদস্যুদের বিকাশ লাভই এর কারণ ছিল। তবে পরবর্তীতে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনীয়রা এবং এরপরে পারস্যরা তাদের সাম্রাজ্যে দিলমুনকে যুক্ত করে নিয়েছিল। দিলমুন সভ্যতা বাণিজ্যিকভাবে কৃষিকে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সামুদ্রিকপথে যুক্ত করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিন্ধু উপত্যকা আর মেসোপটেমিয়া এবং পরবর্তী সময়ে চীন ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল (খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত)।

দিলমুনে অনেক দুর্গ ব্যবস্থাও ছিল; Image source: brewminate.com

দিলমুনকে কখনও কখনও ‘সেই স্থান যেখানে সূর্য উদয় হয়’ এবং ‘জীবন্তের দেশ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এটি সুমেরীয় মিথের কিছু সংস্করণের আদলে গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা হয়। এই অঞ্চল থেকে কৃষিপণ্যের বিনিময়ে তামা এবং পাথরের পুঁতি, মূল্যবান পাথর, মুক্তা, খেজুর এবং শাক-সবজিসহ অন্যান্য বিভিন্ন পণ্য সুমের এবং ব্যাবিলোনিয়াতে পাঠানো হতো।

কাঠ ও মূল্যবান কাঠ, হাতির দাঁত, নীলকান্তমনি, সোনা, গ্লাসযুক্ত পাথরের পুঁতি, পার্সিয়ান উপসাগরের মুক্তো, শেল এবং হাড়ের খাঁজ ইত্যাদি বিলাসবহুল জিনিসপত্র মেসোপটেমিয়ায় পাঠানো পণ্যগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। রৌপ্য, টিন, উলের কাপড়, জলপাইয়ের তেল এবং শস্যের বিনিময়ে এসব বাণিজ্য হতো।

সামুদ সভ্যতা

সামুদ এক প্রাচীন আরব জাতি, যা খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীর দিকে আরব উপদ্বীপের হেজাজের উত্তরে গড়ে  উঠেছিল। ধারণা করা হয়, তাদের মূল আবাস ছিল দক্ষিণ আরব। আর পরবর্তীতে তারা সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে উত্তরে মাদাইন সালেহর কাছে বসতি স্থাপন করে।

মাদাইন সালেহ; Image source: al-talib.org

সামুদদের কোনো লিখিত আইন ছিল না, তবে তাদের উপজাতীয় নেতা শাসকের ভূমিকা পালন করত। সামুদদের উল্লেখ রয়েছে সমসাময়িক মেসোপটেমীয়, ধ্রুপদী এবং আরবীয় উৎসে, যার মধ্যে রয়েছে ১৬০-এর দশকে সামুদদের দেবতা ‘লহ’-এর জন্য নির্মিত একটি মন্দিরের শিলালিপি। ধারণা করা হয়- তারা প্রাচীন আরবি ভাষায় কথা বলত।

অ্যাসিরিয়ান এবং রোমান ইতিহাস মতে, সামুদ রাজ্য ছিল আরব উপদ্বীপের প্রথম রাজ্য। আসিরিয়ার রাজা সারগন ২-এর খ্রিস্টপূর্ব ৭১৫-এর লিপিই সামুদ জাতি সম্পর্কে সবচেয়ে পুরোনো প্রমাণ, যেখানে তাদেরকে আসিরীয়দের আয়ত্তে থাকা মধ্য ও পূর্ব আরবের লোকজনদের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়। ইসলামি ইতিহাসে সামুদ জাতির ইতিহাস তার আরও অনেক আগের, যেখানে তাদের পূর্বপুরুষ বলা হয় ইরাম ও আদ জাতিকে।

সামুদ জাতি তৈরি করেছিল পাথরের খোদাই করা বড় বড় অট্টালিকা; Image source: hiddenincatours.com

ইসলামিক সূত্রমতে, সামুদ এক আদি আরব জাতি যা প্রাচীনকালে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। পবিত্র কুরআন অনুসারে, সামুদরা ছিল ‘আদ’ নামক পূর্ববর্তী জাতির উত্তরসূরি, যারা তাদের পাপের জন্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পাপী জাতি হিসেবে তাদের ধ্বংস হওয়ার ঘটনা নৈতিক শিক্ষার অংশ হিসেবে পবিত্র কুরআনে সামুদকে তেইশবার উল্লেখ করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনের বিবরণ অনুযায়ী, সামুদরা ছিল একটি শক্তিশালী এবং মূর্তিপূজারী জাতি যাদের বাস ছিল হেগরার (বর্তমান মাদাইন সালিহ) উত্তর-পশ্চিম আরবের সালিহ শহর। সামুদ জাতি ছিল ইতিহাসের এক কালজয়ী জাতি। শক্তি, সাহস ও শৌর্যবীর্যে তারা ছিল অনন্য। এছাড়া, তৎকালীন শিল্প ও সংস্কৃতিতেও তারা এগিয়ে ছিল। তাদের মতো কোনো শক্তিশালী জাতি পৃথিবীতে ছিল না। তবে অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, আদ জাতির পর সামুদ জাতিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী জাতি। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার মান যত উন্নত ছিল, আচার-আচরণ ও নৈতিকতার মান ততই নিম্নগামী ছিল। তারা বাস করত বড় বড় পাহাড়ের খোদাইকৃত বাড়িতে, আর সেখানের বাজার ছিল পাহাড়ের চূড়ায়। দম্ভ আর অহঙ্কারের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল সামুদ জাতি। কুফর, শিরক, অবাধ্যতায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তাদের প্রত্যেকে। মিথ্যা অহমিকায় আল্লাহকে অস্বীকার করতেও দ্বিধাবোধ করল না এই জাতি। তাদের যখন এই অবস্থা তখন তাদের কাছে আল্লাহ প্রেরণ করলেন হযরত সালেহ (আ)-কে।

আল্লাহ সামুদদের সতর্ক করার জন্য নবী সালেহ (আ)-কে তাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি যখন একেশ্বরবাদ প্রচার করতে শুরু করেন, তখন তারা তাকে অস্বীকার করে। তারা বলে, তিনি নিছক একজন সাধারণ মানুষ। তখন সামুদরা ‘কাতেবা’ নামের পাথরময় পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী উটনী বের করে দেখাতে বলে। আর এটি দেখাতে পারলে তারা সালেহ (আঃ) এর নির্দেশিত পথে চলবে। হযরত সালেহ (আ) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, আর আল্লাহ একটি মাদী উট পাঠান। সালিহ (আ) তার দেশবাসীকে বলেন, তারা যেন উটের ক্ষতি না করে, এবং তাদের কূপ থেকে পান করতে দেয়। উটটি প্রতি দুই দিন পর পর একটি কূপের সমস্ত পানি পান করত, এবং তারপর মানুষের জন্য প্রচুর পরিমাণে দুধ উৎপাদন করত। কিন্তু গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বেশিরভাগই তাদের দেয়া কথা ভুলে যায়। একদিন সামুদের নয়জন লোক মিলে উটটিকে তীর দিয়ে হত্যা করে। এতে সালেহ (আ) সতর্ক করেছিলেন যে তারা তিন দিন পরে ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রথম দিন, তাদের ত্বক হলুদ হয়ে যাবে; দ্বিতীয় দিনে লাল; এবং ধ্বংসের শেষ দিনে কালো। আল্লাহর আদেশে গজব নেমে আসলো, এবং সালেহ (আ) ও কিছু অনুসারী ছাড়া পুরো সামুদ জাতি ধ্বংস হয়ে গেল। সামুদ জাতি ধ্বংসের আজাবগুলোর মধ্যে ছিল একটি বজ্রপাত, একটি ঝড়, একটি চিৎকার, এবং একটি ভূমিকম্প।

সাবা সভ্যতা

সাবায়ি বা সাবীয় হলো দক্ষিণ আরবের প্রাচীন অধিবাসী। তারা প্রাচীন দক্ষিণ আরবীয় ভাষাসমূহের একটি ভাষা সাবীয়তে কথা বলত। তারা সাবা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা কুরআন ও বাইবেলে উল্লেখিত ভূমি শেবা। এটি দক্ষিণ আরবীয় রাজ্যসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম, এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এর রাজধানী ছিল মা’রিব।

রানী শেবার সিংহাসন; Image source: theartssocietygrayshott.org

সাবা রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজ্যটি খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ২৭৫ অব্দের মধ্যে স্থায়ী ছিল। আবার কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে, সাবীয় রাজ্য কেবলমাত্র খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকেই প্রসার লাভ করেছিল। হিব্রু বাইবেলে সাবীয়দের সম্পর্কে বেশ কয়েক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে। কুরআনে এগুলোকে ‘সাবা’ অথবা ‘তুব্বার’ সম্প্রদায় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত সুলায়মান (আ) এবং শেবার রানী বিলকিসের ঘটনা সপ্তম শতাব্দীর এক অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে বিবেচিত। এটি কুরআন এবং বাইবেলে বর্ণিত একটি ঘটনা।

রাজত্ব দাবি করে বেশ কয়েকটি ইয়েমেনীয় রাজবংশের মধ্যে দীর্ঘ কিন্তু বিক্ষিপ্ত গৃহযুদ্ধ ও আরো বেশ কিছু কারণে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের শেষ দিকে সাবীয় রাষ্ট্র ও সভ্যতার উল্লেখযোগ্য অবক্ষয় ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে হিমিয়ার রাজ্য সাবা দখল করে। কিন্তু সাবা এবং ধু’রায়দানের রাজাদের প্রথম হিমিয়ার রাজ্যের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর, দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকে মধ্য সাবীয় রাজ্যের আবির্ভাব ঘটে। উল্লেখ্য, মধ্য সাবীয় রাজ্য নানা দিক দিয়ে প্রাচীন সাবীয় রাজ্য থেকে আলাদা ছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে হিমিয়াররা সাবীয় রাজ্য জয় করে নেয়। মধ্যযুগীয় আরব ভৌগলিকগণ মনে করেন, এটি সায়হাদ নামে মরুভূমির প্রান্তে অবস্থিত। এর বর্তমান নাম রামলাত আল-সাবাতায়িন।

এটি এমন শহর যা একটি বৃহৎ জলাধার দ্বারা আবদ্ধ একটি নিবিড় চাষাবাদ এলাকায় অবস্থিত ছিল। শহরের কাছে একটি বাঁধের পেছনে থাকা এই জলাধার ছিল রাজ্যের সেচ ব্যবস্থার অন্যতম উৎস। উৎপাদনশীল কৃষি এবং নগর সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে এর অবদান ছিল। সাবার সাম্রাজ্য ধূপ ব্যবসায় সমৃদ্ধ হয়েছিল, যা খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের প্রথমার্ধে প্রসারিত হয়। ধারণা করা হয়, সাবার (সাবিয়ান) জনগণ প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের উপর তাদের শাসন চালাত, অনেকটা স্বায়ত্তশাসনের মতো। রাষ্ট্রের চেয়েও উপজাতীয় ফেডারেশনের মতোই এটি কাজ করত বলে ধারণা করা হয়। প্রতিটি সম্প্রদায়ের পরিষদকে একজন প্রবীণ প্রতিনিধিত্ব করত, যারা রাজাকে পরামর্শ দিত। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক নথি থেকে জানা যায় যে সাবা ছিল এই অঞ্চলের প্রধান রাজ্য, অন্যান্য রাজ্যও খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে অস্তিত্ব লাভ করে।

সাবীয় জাতি দক্ষিণ আরবের সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। এই সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেরই প্রাচীন ইয়েমেনে আঞ্চলিক রাজ্য ছিল, উত্তরে ওয়াদি আল-জাওফ এ মিনীয়দের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের সাবীয়রা। একই সময়কার অন্যান্য ইয়েমেনীয় রাজ্যের মতো সাবীয়রাও অত্যন্ত লাভজনক মশলার ব্যবসা, বিশেষত লোবান এবং গন্ধরস ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। সাবা মশলা ও কৃষিপণ্যে বেশ সমৃদ্ধ ছিল, এবং সমুদ্রপথে কাফেলার মাধ্যমে প্রচুর বাণিজ্য করত। মূলত বাব আল-মান্দেব প্রণালী, যা আরবকে আফ্রিকা থেকে পৃথক করেছে, এটি সমগ্র রাজ্য জুড়ে একটি প্রধান বাণিজ্য পথ হিসেবে কাজ করেছিল। তারা প্রাচীন দক্ষিণ আরবি লিপির অনেক শিলালিপি রেখে গেছে।

প্রাচীন দক্ষিণ আরবের সাবায়ি লিপি; Image source: let.leidenuniv.nl

মুহাম্মদ শুকরি আল-আলুসি তার বুলুঘ আল-আরব ফি আহওয়াল আল-আরব এ ইসলামের সাথে তাদের ধর্মীয় অনুশীলনের কথা তুলনা করেছেন এভাবে:

প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবরা কিছু বিষয় অনুশীলন করত যা ইসলামী শরীয়তে অন্তর্ভুক্ত আছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা কোনো মা এবং তার মেয়ে উভয়কেই বিয়ে করেনি। তারা একইসাথে দুই বোনকে বিয়ে করা সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ বলে মনে করত। এছাড়াও যদি কেউ তার সৎ মাকে বিয়ে করত তাকে তিরস্কার করত, এবং তাকে ধাইজান বলে অভিহিত করত। তারা হজ্ব ও উমরা পালন করার জন্য কাবায় তীর্থযাত্রা করত, কাবা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ করত, সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌড়াত, পাথর নিক্ষেপ করত এবং যৌন মিলনের পরে নিজেরা গোসল করত। তারা গড়গড়া করত, তাদের নাকের ভিতর পর্যন্ত পানি দ্বারা পরিষ্কার করত, তাদের নখ কাটত, সমস্ত গুপ্ত লোম কেটে পরিষ্কার করত এবং খৎনা করার ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত। অনুরূপভাবে তারা চোরের ডান হাত কেটে ফেলত এবং ব্যভিচারীদের পাথর ছুড়ে মারত।

পবিত্র কুরআনের সূরা নমল এবং সূরা সাবা-তে দুবার সাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী উল্লেখ সুলায়মান (আ) এবং শেবার রানীর প্রসঙ্গে এই অঞ্চলকে বোঝায়, যদিও পরের উল্লেখ সাইল আল-আরিমকে (বাঁধের বন্যা) বোঝায়, যেখানে ঐতিহাসিক বাঁধটি বন্যার কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ‘কওম তুব্বা’ (তুব্বার লোক) বাক্যাংশটি, যা সূরা আদ দুখান এবং সূরা ক্বফ-এ উল্লেখ আছে, ‘তুব্বা’ হিমায়ারিতদের মতো সাবার রাজাদের উপাধি ছিল। বাইবেলের বই জব, জোয়েল, এজেকিয়েল এবং ইশাইয়াহতে সাবীয় জাতির উল্লেখ রয়েছে। জবের বইতে তাদের জবের পশুপাল এবং চাকরদের হত্যা করার কথা উল্লেখ আছে। ইশাইয়াহতে তাদের ‘দৈহিক গঠন লম্বা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

নবতাঈ বা নাবাতিয়ান সভ্যতা

নাবাতিয়ানরা ছিল প্রাচীন আরবের মানুষ, যারা মূলত উত্তর আরবে বসবাস করত। এই সভ্যতা ছিল একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সত্ত্বা, যা আধুনিক জর্ডান অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে, এবং রাজধানী শহর পেট্রার ধ্বংসাবশেষের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। নাবাতিয়ানরা মূলত যাযাবর বেদুইন জাতির মধ্যে একটি যারা তাদের পশুপালের জন্য চারণভূমি এবং জলের সন্ধানে আরবের মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াত। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ এবং ২য় শতাব্দীর মধ্যেই তারা নিজেদের সভ্যতা গড়ে তোলে। তাদের এই রাজ্যনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য ব্যবস্থায় কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, যা প্রাচীন বিশ্বে যথেষ্ট সম্পদ এবং প্রভাব নিয়ে এসেছিল।

নাবাতিয়ান শাসকরা তাদের সাম্রাজ্য শাসন করতেন মনোমুগ্ধকর শহর পেট্রা থেকে, যা বর্তমানে জর্ডানে অবস্থিত। আল উলায় তারা তাদের দ্বিতীয় রাজধানী হেগ্রা (আধুনিক নাম মাদাইন সালেহ) স্থাপন করেছিল।

নাবাতিয়ানদের রাজধানী শহর পেট্রা; Image source: velvetescape.com

নাবাতিয়ান মন্দিরগুলোতে দেবতাদেরকে কখনোই পূর্ণমূর্তিরূপে উপস্থাপিত করা হয়নি। কিন্তু দরজায়, মন্দিরের খাঁজে, মুদ্রায়, সমাধিতে, সিরামিকের উপর, এবং তাবিজ-কবজ হিসেবে খোদাই করে রাখতে দেখা যায়। তাদের সংস্কৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন দেবতা ছিল: আল-কওম, যে যুদ্ধের দেবতা, মানুষের রক্ষাকর্তা, রাতের দেবতা, আত্মার রক্ষাকারী; আল-কুতবি, যে জ্ঞান, লেখা এবং ভবিষ্যদ্বাণীর দেবতা; এবং আল’উজ্জা, যে সর্বোচ্চ মাতৃদেবী, ঐশ্বরিক এবং পার্থিব শক্তির অধিকারী। পরবর্তী দেবতারা হলো মানাত (ভাগ্য এবং উর্বরতার দেবী), আল-লাত (নবায়ন, বসন্ত এবং উর্বরতার দেবী), এবং দুশারা (সূর্যের সাথে সম্পর্কিত, পর্বত ও দিনের দেবতা)। এই সমস্ত দেবতার মধ্যে দুশারা ছিল সর্বোচ্চ দেবতা। মন্দিরের ছাদ থেকে তা পূজা করা হতো। নাবাতিয়ানরা রোমের সাথে যুক্ত হওয়ার পরেও মুদ্রায় তার প্রতিকৃতি রাখা হয়েছিল।

তাদের স্থাপত্য ঐতিহ্য মেসোপটেমীয় এবং গ্রিকদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত ছিল। মন্দির এবং সমাধির প্রবেশমুখ তারা পাথরের পাহাড় খোদাই করে তৈরি করেছিল। তাদের অনেক গ্রাফিতি এবং লিপির উদাহরণ মিললেও এখনও তাদের বাস্তবিক কোনো লেখা বা সাহিত্যের সন্ধান মেলেনি।

রোমান সম্রাট ট্রাজান ১০৬ খ্রিস্টাব্দে অভিযান চালিয়ে নাবাতিয়ান রাজ্য দখল করেন। ফলে এটি রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়, আর নাবাতিয়ান হিসেবে স্বাধীন সভ্যতার মর্যাদা হারায় তারা।

আল-মাগার সভ্যতা

আল-মাগার ছিল নব্যপ্রস্তরযুগ বা নিওলিথিক পিরিয়ডের একটি উন্নত সভ্যতা। এই সভ্যতার কেন্দ্রস্থল ছিল বর্তমান সৌদি আরবের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নজদে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৯,০০০ বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭,০০০ বছর পর্যন্ত এই সভ্যতা টিকে ছিল। আল-মাগার সম্ভবত বিশ্বের প্রথম সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি যেখানে নব্যপ্রস্তরযুগের প্রাণীদের, বিশেষত ঘোড়ার, ব্যাপক গৃহপালন করা হয়েছিল।

আল মাগারে পাওয়া ঘোড়ার মূর্তি; Image source: rattibha.com

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চল মরুকরণের আগেই আল-মাগারের বাসিন্দারা এই অঞ্চলে বসবাস করত। তারা মূলত পাথরের তৈরি বাড়িতে বসবাস করত, যা প্রমাণ করে তাদের মধ্যে স্থাপত্যবিদ্যার চর্চা ছিল। তারা ছিল বিশ্বের প্রথম সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতি, যারা কৃষি ও পশুপালনের জ্ঞান রপ্ত করেছিল। তাছাড়া, লাগামযুক্ত ঘোড়ার বড় মূর্তির আবিষ্কার এটাই ইঙ্গিত দেয় যে- এই অঞ্চলে ঘোড়ার গৃহপালন প্রায় ৯,০০০ বছর আগেই শুরু হয়, যা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক এগিয়ে। এছাড়া, এই অঞ্চলের আবিষ্কৃত বেশ কয়েকটি বস্তুর রেডিওকার্বন ডেটিং পরীক্ষায় প্রমাণিত যে, সেসব বস্তুর বয়স প্রায় ৯,০০০ বছর। অতএব, এটি যে প্রাচীন আরবের সবচেয়ে পুরনো সভ্যতা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্দাহ সভ্যতা

আরবের আরেকটি রাজ্য ছিল কিন্দাহ। কিন্দাহ উপজাতির এই রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে। কিন্ডাইটরা মধ্য আরবের নাজদে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার সাথে ইয়েমেনের অন্যান্য সংগঠিত রাজ্যের মিল ছিল না। তাদের প্রথম রাজধানী ছিল ক্বারিয়াত যাত কাহিল, যা আজ ক্বারিয়াত আল-ফাও নামে পরিচিত।

কিন্ডাইটরা খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত বহু-ঈশ্বরবাদী ছিল। তাদের প্রাচীন রাজধানী এখন দক্ষিণ-মধ্য আরবে (বর্তমান সৌদি আরব) অবস্থিত। এখানে পাওয়া আততার এবং কাহিল মূর্তিগুলো তাদের ধর্মীয় আচারের প্রমাণ দেয়। তারা কোন ধর্মে বিশ্বাসী ছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে একটি শক্তিশালী প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে যে ইয়েমেনে খ্রিস্টধর্ম দমন করার জন্য ইহুদি রাজার প্রচেষ্টার সময় তারা যু নুওয়াসের বাহিনীর মধ্যে ছিল।

৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, এবং তাদের আশেপাশের আরবের বিভিন্ন অঞ্চল বিজয়ের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও কিছু উপ-গোত্র মুহাম্মাদ (সা) এর ইন্তেকালের পর ধর্মত্যাগ করে।

এছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণ আরবে আরও বেশ কিছু ছোট ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিল। চলুন এরকম কিছু রাজ্য সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

পালমিরা রাজ্য

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সিরিয়ার মরু অঞ্চলে এই রাজ্য গড়ে ওঠে। এটি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে, এবং ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করে। উজায়নাহ ছিলেন এই রাজ্যের পরক্রমশালী রাজা। তার প্রধান কৃতিত্ব ছিল এশিয়া মাইনর, উত্তর আরব, সিরিয়া, মিসর ও আর্মেনিয়ায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করা। কিন্তু রোমান সম্রাট আরেলিয়ান ২৭২ খ্রিস্টাব্দে এই রাজ্য দখল করেন, এবং পালমিরা ধ্বংস করে দেন।

পালমিরার ধ্বংসাবশেষ; Image source: Lonely Planet

মিনীয় রাজ্য

সাবার পাশে মা’আন নামক স্থানে মিনীয়রা একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তাদের রাজধানী ছিল ‘কারনব’, যার বর্তমান নাম মাইন। ইয়েমেনের রাজধানী সানার উত্তর-পূর্বে এর অবস্থান। মিনীয়রা ছিল সাবেয়ীদের প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু সাবার অধিবাসীরা উন্নত সভ্যতার অধিকারী হওয়ায় তারা মিনীয়দের উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। কালক্রমে মিনীয় রাজ্য সাবার অধীন হয়ে যায়।

হাজরামাউত রাজ্য

বর্তমান হাজরা মাউতে ‘হাজরামাউত’ নামক পৃথক স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এটি দক্ষিণ আরবের একটি অঞ্চল, যা পূর্ব ইয়েমেন, পশ্চিম ওমানের কিছু অংশ এবং দক্ষিণ সৌদি আরব নিয়ে গঠিত। হাজরামাউতের রাজধানী ছিল ‘শাবওয়াহ’। হাজরামাউত শব্দের একটি অর্থ ‘মৃত্যু এসেছে’। এই অঞ্চলে এক ভয়াবহ যুদ্ধে অনেকে নিহত হয় বলে এই নামকরণ। আরেকটি তত্ত্ব মতে, সামুদ সভ্যতা ধ্বংসের পর নবী সালেহ (আ) তার প্রায় ৪,০০০ অনুসারীকে নিয়ে এই অঞ্চলে চলে আসেন, এবং সেখানেই তিনি মারা যান। এভাবে অঞ্চলটি ‘মৃত্যু এসেছে’ এই নামকরণ করা হয়। তবে এই অঞ্চলের অধিবাসী, যাদের হাজরামী বলা হয়, তাদের নাম থেকেও এই নামটি আসতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

হিমায়েরী রাজ্য

সাবিয়ান ও মিনীয় সভ্যতার পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ অব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ আরবে হিমায়েরী রাজবংশ রাজত্ব করে। হিমায়েরীদের রাজধানী ছিল ইয়েমেনের ‘জাফরা’ নামক স্থানে। আবিসিনিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন এই রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু পরবর্তীতে আবিসিনিয়রা হিমায়েরী রাজ্য দখল করে। ৩০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম হিমায়েরী রাজ্যের পতন হয়, এবং দ্বিতীয় হিমায়েরী রাজত্বের সূচনা হয়। এটি ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই সময় সর্বপ্রথম ইয়েমেনে খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্ম বিস্তার লাভ করে।

মূলত সভ্যতাগুলো ধ্বংসের পর তাদের নির্মিত প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে, যা পরবর্তীতে তাদের অস্তিত্বের কথা জানান দেয়। ছোট ছোট রাজ্যব্যবস্থা থেকেই গড়ে উঠেছে আজকের বৃহত্তম রাষ্ট্রব্যবস্থা। এভাবেই সভ্যতার ক্রমবিকাশ আজকে আমাদের এই উন্নতির দিকে ধাবিত করেছে। 

Related Articles

Exit mobile version