Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যানা অ্যাকুয়াশ হত্যাকাণ্ড: সত্তরের দশকে মার্কিন আদিবাসী বিদ্বেষ ও চক্রান্ত

দাবি আদায়ের আন্দোলন দমন করার জন্য হত্যাকাণ্ডের আশ্রয় নেওয়া অপরাধ জগতের ইতিহাসে খুব একটা বিরল ঘটনা নয়। আবার অনেক সময় কোনো আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্যও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সৃষ্টি হয় বিতর্কিত অধ্যায় ও তার একাধিক আলাদা প্রতিক্রিয়া। আর এসব ঘিরে তৈরি হয় সামাজিক বা রাজনৈতিক বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠীর সামর্থ্য পরীক্ষার খেলা।

বিংশ শতকের সত্তরের দশক এমনই এক সময় ছিলো। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছিলো। তার মধ্যে নিছক অপরাধ যেমন ছিলো, তেমনি ছকে বাঁধা অপরাধও ছিলো। এই দশকে দেশটিতে আদিবাসী বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার তীব্রতার মাত্রা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকতেই পারে, তবে নিঃসন্দেহে সময়ের অস্থিরতার এক মারাত্মক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফুটে উঠেছিলো।

১৯৭৬ সালে সাউথ ডাকোটা প্রদেশে ঘটে যাওয়া অ্যানা অ্যাকুয়াশ হত্যাকাণ্ড এমনই এক অস্থিরতার ফলাফল ছিলো। 

অ্যানা অ্যাকুয়াশ; Image Source: findgrave.com

১৯৭২ সাল থেকে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের মধ্যে বিক্ষোভ তৈরি হচ্ছিলো। প্রায় কয়েক শতক আগে মহাসাগরের ওপার থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ দখলদার শাসকরা তাদের আগ্রাসী যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। তার উপর ছিলো ‘ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশন’ নামে কয়েদখানার মতো বিভিন্ন আদিবাসী আবাসে নানা প্রকারের বিধিনিষেধ আর নির্যাতন। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকা বিভিন্ন আদিবাসী জাতির মানুষ বঞ্চনা সহ্য করে আসছিলো।  

অ্যানা অ্যাকুয়াশ ছিলেন আমেরিকার আদিবাসী মিগমাক ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর একজন শিক্ষিত নারী। কানাডার নোভা স্কোশিয়া অঞ্চলে ১৯৪৫ সালে তার জন্ম হয়েছিলো। বাল্যকাল থেকেই তিনি আদিবাসী হবার কারণে দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন। একদিন তার পূর্বপুরুষ ছিলো যে ভূখণ্ডের ভূমিপুত্র, সময়ের করুণ বিবর্তনে তিনি সেই ভূখণ্ডেই কার্যত পরবাসীর মতো জীবন কাটিয়েছেন।

১৯৬২ সালে অ্যানা ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশন এলাকা থেকে বোস্টনে চলে আসেন। এসময় থেকেই তার নিরলস কর্মীর জীবন শুরু হয়। তিনি শহরাঞ্চলে আমেরিকার ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীর সাথে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট (AIM) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো আদিবাসী আমেরিকানদের উপর করা অত্যাচার, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তিনি আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।

স্বামী নোগিশিক অ্যাকুয়াশের সঙ্গে অ্যানা; Image Source: antoinetteclaypoole.blogspot.com

বিশ শতকে আমেরিকার আদিবাসীদের জীবনে ১৯৭৩ সাল বেশ উল্লেখযোগ্য সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা প্রদেশের পাইন রিজ ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশন এলাকা যেন বহুদিনের জমানো ক্ষোভে রীতিমতো ফুঁসে উঠলো। যার ফলে আদিবাসী ওগলালা লাকোটা গোষ্ঠী উন্ডেড নি অঞ্চলে মার্কিন সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কার্যত সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিলো। এই অবস্থান ৭১ দিন স্থায়ী হয়ে মার্কিন প্রশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো।

উন্ডেড নি – সশস্ত্র আদিবাসী বিদ্রোহ; Image Source: alchetron.com

অ্যানা অ্যাকুয়াশ তার সহযোদ্ধা নোগিশিকের সাথে বিদ্রোহীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করলেন। তারা দুজন আদিবাসী রীতিতে বিয়ে করলেন। ১৯৭৫ সালে আদিবাসী মেনোমিনি গোষ্ঠীর দাবিদাওয়া নিয়ে সমাবেশে অংশ নিলে তিনি অস্ত্র আইনে গ্রেফতার হন। অবশ্য পরে শীঘ্রই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট সংগঠনে তার প্রভাব ক্রমাগত বেড়েই চলছিলো। বিশেষ করে আদিবাসীদের দাবি দাওয়া প্রশ্নে চরমপন্থী অবস্থানে থাকা নেত্রী হিসেবে তার পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হয়ছিলো। নরমপন্থী অনেক নেতা এমন অবস্থানের কারণে বিব্রত ছিলেন। বিশেষ করে তখনকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেরাল ফোর্ড প্রশাসন আদিবাসী আন্দোলন প্রশ্নে কার্যত ‘নো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলছিলো। এর ফলে অনেকে প্রয়োজনের সময় সশস্ত্র অবস্থানের বিরোধিতা করে। সংগঠনের নেতা লিওনার্ড পেল্টার ও ডেনিস ব্যাংকস এর সাথে তার রাজনৈতিক যোগাযোগ ভালো ছিলো। অনেকের মতে, ডেনিস ব্যাংকসের সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিলো। তবে এ কথার সত্যতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।

আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট নেতা ডেনিস ব্যাংকস ও রাসেল মিন্স; Image Source: tumblr.com

১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তার আকস্মিক নিখোঁজ হবার সংবাদ বাতাসের গতিতে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়লো। জলজ্যান্ত একজন সক্রিয় প্রতিবাদী মানুষ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।

১৯৭৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। সাউথ ডাকোটা এলাকার সেই পাইন রিজ রিজার্ভেশনের উত্তর-পূর্ব কোণে এক রাস্তার পাশে অ্যানা অ্যাকুয়াশের লাশ পাওয়া গেলো। ফেব্রুয়ারির শীতের তুষার গলে যাবার পর তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছিলো। ময়নাতদন্তে বলা হলো, প্রায় ১০ দিন আগে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। প্রথমে ঠান্ডায় তার মৃত্যুর কথা প্রচারিত হলেও পরে তার মাথার একপাশে গুলির চিহ্ন দেখা গেলো। উল্লেখ্য, তখনও লাশের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়নি। সাউথ ডাকোটায় তার লাশ জনৈক জেন ডো নামে কবর দেওয়া হয়।

১০ মার্চ অ্যানার পরিবার ও আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট কর্মীদের দাবির মুখে তার মৃতদেহ কবর থেকে তুলে আবার অটোপসি করা হলো। এবারের তদন্তে গুলির চিহ্ন, ক্ষতস্থান ইত্যাদি মিলিয়ে দেখা গেলো, এটা কোনো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি।

ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্স যুক্তরাষ্ট্রে আদিবাসী বিষয়ক ঘটনা তদারক করে থাকে। আর হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ভার ছিলো এফবিআই এর হাতে। কানাডায় অ্যানার পরিবারকে জানানো হলো, অত্যধিক শীতে ফ্রস্ট বাইটে তার মৃত্যু হয়েছে।

অ্যানা অ্যাকুয়াশের লাশ তোলার দৃশ্য; Image Source: cinemapolitica.org

এদিকে হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো। অনেকে ভাবছিলেন, আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের শীর্ষ নেতারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কারণ অ্যানা অ্যাকুয়াশকে অনেকে এফবিআই এজেন্ট হিসেবে সন্দেহ করা আসছিলেন। উন্ডেড নির সশস্ত্র অবস্থানের সময়ও তার অবস্থান এফবিআই এর চোখ হিসেবে কাজ করেছে- এমন গুজব রটেছিলো। আবার আদিবাসী অধিকার প্রশ্নে চরমপন্থী অবস্থানের কারণেও সন্দেহের তীর তার দিকে গিয়েছিলো।

অন্যদিকে এফবিআইও সন্দেহের লক্ষ্য হিসেবে বাইরে ছিলো না। বিশেষ করে ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশন এলাকায় মূলধারার শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের দ্বারা আদিবাসী নির্যাতন ও খুনোখুনি সত্তরের দশকে খুব একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিলো না। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন অ্যানাকে অল্প সময়ের জন্য গ্রেফতার করা হলে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ডেভিড প্রাইস নামের এক কাউবয় তাকে বলেন, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে দরকার অনুযায়ী সহায়তা না করলে আগামী আধা বছরের মাথায় তাকে হত্যা করা হতে পারে।

সে বছরের শেষ নাগাদই অ্যানা অ্যাকুয়াশ নিখোঁজ হন, আর পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে তার লাশ পাওয়া গেলো।

এফবিআই থেকে বলা হলো, আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট কর্মী জন গ্রাহাম তাকে হত্যা করেছে। আর্লো ক্লাউড নামক জনৈক সাক্ষীর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে এই দাবি করা হয়েছিলো। জন গ্রাহাম ২০০১ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যানা অ্যাকুয়াশকে অপহরণ করার কথা স্বীকার করে। তার ভাষ্যমতে, আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট তাকে এফবিআই এজেন্ট হিসেবে সন্দেহ করার কারণে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রাহামের চাচী থেডা ক্লার্ক সবার আগে অ্যানাকে এফবিআই চর হিসেবে দাবি করেছিলেন।

কিন্তু এফবিআই এজেন্ট ডেভিড প্রাইস এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, আদিবাসী বিদ্রোহের সময় তিনি এফবিআই এর কাছে গোপন খবর পৌঁছানোর জন্য কয়েকজন চর নিয়োগ করেন। তবে অ্যানা তাদের মধ্যে ছিলো না। 

২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাউথ ডাকোটা আদালত অ্যানা অ্যাকুয়াশের হত্যাকাণ্ডের অপরাধে থেলমা রিওস ও জন গ্রাহামকে অভিযুক্ত করে। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই মামলা অব্যাহত ছিলো। থেলমা রিওস পাইন রিজ অঞ্চলের একজন আইনজীবী ছিলেন। তিনি আদালতের কাছে দোষ স্বীকার করে শাস্তি লাঘবের আবেদন করেন। সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সাউথ ডাকোটা আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়। ২০১১ সালে থেলমা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।  

জন গ্রাহাম, অ্যানার হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত অন্যতম আসামী; Image Source: cbsnews.com

আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের নেতা ডেনিস ব্যাংকস ও রাসেল মিন্স অ্যানার হত্যাকান্ডের জন্য কার্যত এফবিআইকে দায়ী করেছিলেন। তারা এফবিআই এর বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের আলামত নষ্ট করা ও ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ আনেন। অন্যদিকে অ্যানা অ্যাকুয়াশের সন্তান ডেবি ম্যালোনি এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট আন্দোলনের পারস্পরিক কোন্দল ও হিংসাকে দায়ী করে থাকেন।

বিচারকার্য সুষ্ঠুভাবে চলমান থাকার দাবি করা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকার সচেতন মহলের কাছে অ্যানা অ্যাকুয়াশ হত্যাকাণ্ড এখন অবধি ধোঁয়াশা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী একে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা নিপীড়নের চেয়ে কিছুমাত্র আলাদা করে দেখে না। অন্যদিকে অনেক মানবাধিকার সংগঠনও একে অধিকার হরণের গুরুতর দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখে থাকে। 

ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

Related Articles