ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: ভারতীয়করণ (পর্ব-৬)

পঞ্চম পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (পর্ব-৫)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভারতীয় ফৌজের ভেতরে বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে ব্রিটিশদের কাছে। এক-ব্যাটালিয়ন প্রথা এবং রিজার্ভ প্রথা ঠিকভাবে কাজ করছে বলে মনে হয়নি তাদের কাছে, সিল্লাদার প্রথায় তৈরি ক্যাভালরি বাহিনীর কর্মদক্ষতাও আশানুরূপ মনে হয়নি। এমন অবস্থাতেই ১৯২১ সালে আবারো পরিবর্তন আনা হয়, সিল্লাদার প্রথাকে একেবারে উঠিয়ে দেওয়া হয়।

সওয়ার বাহিনী থেকে সিল্লাদার প্রথা উঠিয়ে নেওয়ার পর প্রতি ২টি রেজিমেন্টকে একত্র করে ১টি করে রেজিমেন্ট তৈরি করা হয়। পরিখা বা ট্রেঞ্চের যুদ্ধে সওয়ার বাহিনী খুব বেশি কাজে না লাগায় লোকজন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। ফলে পুনর্গঠনের পর সৈন্যসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে (৫৬%) নেমে আসে।

ইংরেজদের ইরেগুলার ক্যাভালরি বা সিল্লাদার; Image Source: The Indian Army – Boris Mollo

ইংরেজদের সামরিক জাতি তত্ত্ব ও প্রতিষেধক তত্ত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। এই প্রতিটি জাতির সৈন্যদের নিয়ে তৈরি একেকটি কোম্পানি তৈরির ফলে কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যেতে থাকে, যার ফলে সামগ্রিক রেজিমেন্টের ওপর বাজে প্রভাব পড়তে থাকে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে রেজিমেন্টের ভেতরকার সমন্বয়ের জন্য বড় হুমকি। এছাড়াও আরও একটি সমস্যা ছিল, ভারতীয় সৈন্যদের ক্ষেত্রে প্রতিটি সওয়ার ও পদাতিক বাহিনী নিজেরাই ভর্তি নিত, কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা ছিল না। যেমন: কোনো পাঠান রেজিমেন্ট সৈন্য ভর্তির জন্য নিজেরাই পাঠানদের মধ্যে থেকে সৈন্য নির্বাচন করতো, ফলে এর মধ্যে স্বজনপ্রীতি দেখা যেতে থাকে। আবার, রাজপুতদের রেজিমেন্ট সংখ্যা হয়তো অনেক কম, কিন্তু ডোগরাদের রেজিমেন্ট সংখ্যা আবার অনেক বেশি। ফলে ডোগরা রেজিমেন্টগুলোতে নিজেদের মধ্যেই স্বল্প সংখ্যক উত্তীর্ণ ডোগরা সৈন্যদের নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হতো। রেজিমেন্ট জাতগুলোর ভাষা জানা ইংরেজ অফিসারদের অভাবও ঝামেলা তৈরি করেছিল।

এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্ত পদাতিক ও সওয়ার বাহিনীকে ‘গ্রুপ’ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সওয়ার বাহিনীকে পুনর্গঠন করার পর সর্বমোট সওয়ার রেজিমেন্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১টিতে। এই ২১টিকে ৭ ভাগে ভাগ করা হয়, প্রতি ৩টি রেজিমেন্টকে ১টি গ্রুপের অধীনে আনা হয়। তবে এই গ্রুপ করার সময় খেয়াল রাখা হয় যে, একটি গ্রুপের ৩টি রেজিমেন্টেই যেন একই ধরনের জাত-কোম্পানি থাকে। এর উদ্দেশ্য মূলত রিজার্ভ সৈন্যদল তৈরি রাখা। ধরা যাক, কোনো একটি গ্রুপের ৩টি রেজিমেন্টেই ১টি করে মোট ৩টি শিখ জাত-কোম্পানি আছে, এর যেকোন একটিকে যুদ্ধে পাঠানো হবে এবং সেটি ক্লান্ত হয়ে গেলে বা বদলি করার প্রয়োজন পড়লে বাকি দুটি রেজিমেন্ট থেকে আরেকটি শিখ জাত-কোম্পানি পাঠানো হবে তাদের জায়গা পূরণ করার জন্য। এরকমভাবে পদাতিক বাহিনীতেও মোট ২০টি গ্রুপ তৈরি করা হয় গুর্খারা ব্যতীত, গুর্খাদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা লাইন তৈরি করা হয়।

৭নং গুর্খা রাইফেলস; Image Source: The Indian Army – Boris Mollo

১৯২২ সাল থেকে নতুন এই গ্রুপ প্রথা পুরোদমে চালু হয়। পদাতিক বাহিনীগুলোর ক্ষেত্রে গ্রুপ তৈরির পর বাহিনীগুলোর রেজিমেন্টগুলো বেশ বড় আকার ধারণ করে, যেগুলোকে ৪ থেকে ৫টি ব্যাটালিয়নে ভাগ করা হয়। এগুলোর মধ্যে আবার একটি বিশেষ ব্যাটালিয়নকে আলাদা করে রাখা হয়, যাদের কাজ হবে অন্যদের ট্রেনিং দেওয়া। প্রতিটি গ্রুপের এই ব্যাটালিয়নের জন্য ১০নং ব্যাটালিয়ন আলাদা করে রাখা হয়েছিল।

২০টি গ্রুপ হওয়ার পর আরও ৯টি সিঙ্গেল-ব্যাটালিয়ন রেজিমেন্ট বেশি থেকে যায়, কিছুদিনের মধ্যেই এগুলো ভেঙে দেওয়া হয়। দুঃখজনকভাবে ব্রিটিশদের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত ১৭নং ইনফ্যান্ট্রি (দ্য লয়্যাল রেজিমেন্ট)-কেও ভেঙে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরও দুটি বড় আকারের রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়, একটি হলো ৩য় মাদ্রাজ রেজিমেন্ট, যেটি ১৯২৮ সালে অর্থনৈতিক চাপ কমাতে ভাঙা হয়, অন্যটি ২০নং বার্মা রাইফেলস, বার্মা ভারতবর্ষ থেকে আলাদা হয়ে যায় বিধায় এই রেজিমেন্টের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়।

২০নং বার্মা রাইফেলসের এক সৈন্য (১৯৩৭); Image Source: The Indian Army – Boris Mollo

ভারতীয়করণ (Indianization)

ভারত ছিল ইংরেজদের জন্য অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ দেশ, ব্যতিক্রম ছিল না সৈন্যদের ক্ষেত্রেও। এজন্য স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে বের হওয়া ক্লাসের সেরা ছাত্রদের প্রথম পছন্দ ছিল ভারত। শুধু অ্যাডভেঞ্চার নয়, বিদেশে অবস্থানকালীন ভাতা হিসেবে অতিরিক্ত বেতন পাওয়ার সুযোগও ছিল, যেটি ইংল্যান্ডে বসে পাওয়ার সুযোগ ছিল না।

স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি অ্যাকাডেমি; Image Source: National Army Museum

ভারতীয় বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য তাই প্রথমে ভারতে থাকা কোনো ব্রিটিশ রেজিমেন্টে ঢুকতে হতো তাকে। প্রথম এক বছর ভারতীয় সংস্কৃতি আর ভাষার সাথে পরিচিত হতে হতো, বিশেষ করে উর্দু ছিল তৎকালীন ভারতীয় ফৌজের লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা। ভারতীয় বাহিনীতে যোগ দিতে হলে তাকে অবশ্যই উর্দুতে ন্যূনতম কথা বলার মতো পারদর্শী প্রমাণ করার পরীক্ষা দিতে হতো। তাছাড়া সে ভবিষ্যতে যে রেজিমেন্টে যোগ দেবে, সে অঞ্চলের ভাষাও শেখার সুযোগ করে দেওয়া হতো, যেমন: পশতু। এই সময়ে ইংরেজ অফিসারকে ঠিক করতে হতো সে কোন রেজিমেন্টে যোগ দেবে। রেজিমেন্টের ইংরেজদের মধ্যে আলাদা খাতির বা বন্ডিং থাকতো, যদি সেই নতুন অফিসার তাদের মধ্যে খাপ খাওয়াতে না পারে, তাহলে অন্য যেকোনো কর্পস বা রেজিমেন্টে যাওয়ার সুযোগ ছিল।

ইংরেজদের ভারতীয় বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আরেকটি সুবিধা ছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ট্রুপ কমান্ডার বা প্লাটুন অফিসার হয়ে যেতে পারতো, যেটি ইংল্যান্ডের জন্য বেশ সময়সাপেক্ষ। কারণ ইংরেজরা এমনভাবেই ভারতীয় ফৌজকে সাজিয়েছিল, যাতে কোনো ভারতীয় কোনো ইংরেজদের উপর কর্তৃত্ব না ফলাতে পারে, অর্থাৎ, কখনোই কোনো ভারতীয় অফিসারের অধীনে কোনো ইংরেজ থাকতে পারবে না। এছাড়া ভারতে আসার প্রথমেই ব্রিটিশ রেজিমেন্টে তাকে ভর্তি করার কারণ ছিল যাতে সে বাহিনী পরিচালনা সম্পর্কে ভালোভাবে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। ভারতীয়দের সামনে ইংরেজ অফিসারের ভুল একইসাথে অপমানজনক ও দৃষ্টিকটু মনে করতো ইংরেজরা।

ব্যান্ডসমেন, ইংরেজ অফিসার, ভারতীয় অফিসার, হাবিলদার, সেপাই এবং নায়েকদের পোশাক (বাম থেকে ডানে);
Image Source: The Indian Army – Boris Mollo  

বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপক পরিমাণ ইংরেজ অফিসার মারা যাওয়ায় ভারতীয় রেজিমেন্টগুলো প্রায় অচল হয়ে পড়ে, কারণ ভারতীয়দের ভাষা জানা ইংরেজদের পরিমাণ এমনিতেই কম, ভাষা না জানার কারণে অন্য রেজিমেন্ট থেকে ইংরেজ অফিসারদের হাতেও দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে থেকেই অফিসার বানানোর তোড়জোড় শুরু হয়। তাই ১৯২৩ সাল থেকে ভারতীয়করণ বা Indianization শুরু করা হয়, যার ফলে ভারতীয় অফিসাররা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেতে শুরু করে। তবে এখানেও কথা ছিল, কোনো ভারতীয় যেন কখনোই ইংরেজ অফিসারদের ওপরে উঠতে না পারে, সেজন্য ওসব ইংরেজ অফিসারদের অবসর কিংবা বদলী হওয়ার পর ওসব ফাঁকা স্থানে ভারতীয় অফিসারদেরকে নেওয়া হতো। উলউইচ আর স্যান্ডহার্স্টের রয়্যাল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ভারতীয় অফিসারদের জন্য ২০টি করে কোটা পদ্ধতি চালু করা হলো, তবে ইংরেজ আর ভারতীয় অফিসারদের মধ্যে সংস্কৃতিসহ নানা অমিল থাকায় শেষমেশ ভারতের দেরাদুনেই মিলিটারি অ্যাকাডেমি খুলে ফেলা হলো।

দেরাদুন মিলিটারি অ্যাকাডেমি; Image Source: Art UK

ভারতীয়দেরকে অফিসার হতে হলে ভারতের ভাইসরয়ের কাছ থেকে কমিশন নিতে হতো। তাদেরকে বলা হতো ‘ভারতীয় অফিসার’, কিন্তু ভারতীয়করণ শুরু হওয়ার পর নাম বদলে ভাইসরয় কমিশনড অফিসার (VCO) বলা শুরু হয়। অন্যদিকে, স্যান্ডহার্স্ট থেকে পাশ করা অফিসারদেরকে কিং’স কমিশন ইন্ডিয়ান অফিসার (KCIO) এবং দেরাদুন থেকে পাশ করাদেরকে ইন্ডিয়ান কমিশন্ড অফিসার (ICO) বলা শুরু হয়।

দ্য কিং’স ইন্ডিয়ান অর্ডারলি অফিসার’স (১৯২৪); Image Source: The Indian Army – Boris Mollo

ICO-রা ব্রিটেনের ইংরেজ অফিসারদের সমান বেতন পেলেও ভারতে থাকা ব্রিটিশ অফিসারদের তুলনায় কম বেতন পেত, কারণ হলো সেই বিদেশে অবস্থানকালীন ভাতা। এদিকে পুরনো VCO-দেরকে সরিয়ে সে জায়গায় নব্য ICO-দেরকে নেওয়া শুরু হয়, যদিও এর ফলে পুরনো অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়ে যায়। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই পোড় খাওয়া VCO-দের হাতে পুনরায় দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।

দেরাদুন থেকে খুব কম সংখ্যায় ICO পাশ করে বের হতো, আর এদের হাতে কখনোই ইংরেজ রেজিমেন্টদের দায়িত্ব দেওয়া হতো না, কারণ সেই ব্রিটিশদের জাত্যাভিমান। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর অফিসারদের চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়ে নতুন দুই ক্যাটাগরির অফিসার: ইমার্জেন্সি কমিশনড অফিসার (ECO) এবং ইন্ডিয়ান ইমার্জেন্সি কমিশনড অফিসার (IECO) খুলতে বাধ্য হয় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ।

সপ্তম পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (পর্ব-৭)

This article is in the Bengali language. It is about the Indian Army during the colonial period.

References:
1. ভারতীয় ফৌজের ইতিহাস - সুবোধ ঘোষ - দিব্যপ্রকাশ (২০২০)
2. The Indian Army (1914-1947) - Ian Sumner - Osprey Publishing (2001)
3. The Indian Army - Boris Mollo - New Orchard Editions (1986) 

Related Articles