Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাবাক খোরামদিন: আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পারস্যের জাতীয় বীর

আরব উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খিলাফত পারস্য আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। পরবর্তী ১৪৪ বছর ধরে পারসিয়ানদের শাসন করেছিল আরবরা। ১০ জুলাই ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পশ্চিম ইরানের আরদাবিলের নিকটে বালাল আবাদ নামক গ্রামে একটি ফুটফুটে শিশু জন্মগ্রহণ করে। এই শিশুটিই একসময় আরবদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ একসময় তিনিই হয়ে উঠেন পারস্যের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিদ্রোহী নেতা, যিনি আরবদের পারস্য থেকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে বধ্যপরিকর ছিলেন। তাই তিনি এমন এক চৌকস বিদ্রোহী বাহিনী গড়ে তুলেন, যারা পারস্যের প্রতি ইঞ্চি থেকে আরবদের হটিয়ে দিতে যেকোনো মূল্য দিতে রাজি ছিল। এমনই এক বাহিনীর মুখোমুখি হতে যাচ্ছিল আরবরা। আর যিনি পুরো বিষয়টির নেতৃত্বে ছিলেন তার নাম বাবাক খোরামদিন।

মা বলেন, তুই একদিন অনেক বড় হবি খোকা; Image Source: listverse.com

শৈশবেই পিতা মেরদাস মারা গেলে পুরো পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ছোট্ট বাবাকের উপর। পরিবারে মা আর ছোট দুই ভাইকে খাওয়াতে তাই তিনি রাখাল হিসেবে কাজ শুরু করেন। অন্যদিকে মা মাহরু বিভিন্ন পরিবারের শিশুদের দেখাশুনা এবং চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। আঠারো বছর বয়স না হতেই বাবাক অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়ে নেন। পাশাপাশি সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ থেকে তিনি স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র ‘টাম্বর’ বাজানো শিখতে শুরু করেন। একটা গল্প প্রচলিত আছে যে, একদিন বিকেলে বাবাক গাছতলায় ঘুমিয়ে ছিলেন। এমন সময় তার মা এসে দেখেন তার ছেলের শরীর থেকে কেবল রক্ত ঝরছে। সন্তানের শরীরে হাত দিতেই তার ঘুম ভেঙে যায় এবং সঙ্গে-সঙ্গে শরীরের সকল ক্ষত এবং রক্তক্ষরণ বেমালুম উধাও হয়ে যায়। এই ঘটনা থেকে মা ভবিষ্যৎবাণী করেন,

‘তুই একদিন অনেক বড় হবি, তোর কাঁধে অনেক দায়িত্ব ভর করবে।’

তারও বহুদিন পর এক শীতের দিনে জাভিদান শাহরাক নামক এক ধনী ব্যক্তি জাঞ্জান শহর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। লোকটি খোরামিয়ান সম্প্রদায় নামক একটি পারসিয়ান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। প্রবল তুষারপাতের কারণে তিনি চাইছিলেন আশপাশেই কোথাও রাতটা থেকে যেতে। সৌভাগ্যবশত তিনি বাবাক এর বাড়িতেই কড়া নাড়েন। নিজের অবস্থার কথা জানানোর পর মাহরু আগন্তুককে বরণ করে নেন। অতিথির সবরকমের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হন তিনি।

বাবাকের একটি কল্পিত সিমুলেশন; Image Source: artstation.com

এদিকে বাবাক অথিতির ঘোড়াগুলোর দেখভালে মনোযোগ দেন। বাবাকের ভদ্রতা এবং বুদ্ধিমত্তা দেখে জাভিদান খুশি হন এবং তার মাকে একটি প্রস্তাব দেন। জাভিদানের বড় খামার ছিল, তাই খামারের দেখাশুনার জন্য বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন ছিল খুব। তিনি বাবাককে সঙ্গে নিতে চাইলে মাহরু রাজি হয়ে যান। এরপর বাবাক আগন্তুকের সঙ্গে নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সেখানে গিয়ে বাবাক জাভিদান এর বিদ্রোহী দলের সদস্য হয়ে যান এবং জাভিদানকে গুরু মানতে শুরু করেন। খুব অল্পসময়ের ভেতর বাবাক ‘খোরামদিন’ নামটি নিজের করে নেন, যার অর্থ ‘আনন্দময় বিশ্বাস’। মূলত ‘খোরামদিন’ পারস্যে ইসলামপূর্ব জেরোস্ট্রিয়ানিজম ধর্মকে নির্দেশ করে।

খোরামিয়ান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে বাবাককে সঙ্গে নিয়ে ৮০৭-৮১৭ সাল পর্যন্ত আরবদের বিরুদ্ধে অসংখ্য যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন জাভিদান। এই সময়গুলোতে উত্তর-পশ্চিমাংশে আরবদের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখেন তারা। জাভিদানের পাশাপাশি থেকে বাবাক সমরবিদ্যা, ভূগোল এবং নেতৃত্বের মতো বিষয়গুলো শিখে নেন। একটি যুদ্ধে জাভিদান আহত হলে বাবাককে খোরামিয়ানদের নেতা হিসেবে মনোনীত করেন। কারণ তিনি নিজের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, আর তার চোখে বাবাককেই নিজেদের ভবিষ্যৎ মনে হয়েছিল, যিনি চলমান এই লড়াইকে মুক্তির দিকে ধাবিত করতে পারবেন। বাবাক বুঝতে পারছিলেন, তার মায়ের ভবিষ্যৎবাণী সত্য হতে চলেছে!

আহত জাভিদান বাবাককে খোরামিয়ানদের নেতা হিসেবে মনোনীত করেন; Image Source: latimes.com

বাবাক যখন খোরামিয়ানদের নেতা নির্বাচিত হন, ঠিক সেই সময় বাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধা বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিলেন। তারা আবার একত্রিত হন এবং বাবাক খোরামদিনকে নেতা হিসেবে মেনে নেন। কিছুদিন পর বাবাক বানু খোরামদিনকে বিয়ে করেন। যিনি মূলত জাভিদানের প্রাক্তন স্ত্রী ছিলেন এবং বাহিনীতে ভালো যোদ্ধা হিসেবে নাম ছিল তার। পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুদ্ধ করতে তার কোনো জুড়ি ছিল না। খোরামিয়ানরা নিজেদের পোশাকের সঙ্গে লাল রংকে জড়িয়ে নিয়েছিল। তাই লোকেদের কাছে তারা ‘সর্খ জামেগান’ নামে পরিচিত, যার অর্থ লাল পোশাক।

যে বছর জাভেদান মৃত্যুবরণ করেন সেই বছর থেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত বাবাক নিজ বাহিনীর সৈন্যদের একত্রিত করতে শুরু করেন। আরব খেলাফতের বিরুদ্ধে পারসিয়ানদের সংগঠিত করা ছাড়া কোনো উপায় নেই-এটা বাবাক টের পাচ্ছিলেন। তাই পারস্যের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা কৃষক এবং বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহী নেতাদের একই পতাকার ছায়াতলে নিয়ে আসতে শুরু করেন। বিশেষ করে কৃষকদের অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ দিয়ে যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলেন। তারপর আরবদের ভয় দেখাতে তাদের পারস্যের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেন। এভাবে সবার মাঝে বাবাক খোরামদিন জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেন। তার বাহিনীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছিল। ধারণা করা হয়, একসময় খোরামিয়ানরা ৩ লক্ষ সৈন্যের বিশাল এক বাহিনীতে পরিণত হয়। এই বিশাল সৈন্যবাহিনীকে তিনি পারস্যের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেন এবং আরব অধিকৃত গ্রামগুলো মুক্ত করার নির্দেশ দেন। এভাবে আরবরা বহুদিন ধরে শাসন করা অঞ্চলগুলো হারাতে শুরু করে।

৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে আরব খিলাফত বাবাক এর বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরব সেনাপতি ইয়াহিয়া ইবনে মু’আদকে বাবাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি বাবাককে পরাজিত করতে ব্যর্থ হন। এরপর সেনাপতি মুহাম্মদ ইবনে আবি খালিদকেও বাহিনীসহ প্রেরণ করা হয় খোরামিয়ানদের সঙ্গে লড়তে। কিন্তু তিনিও পরাজিত হন বাবাকের বাহিনীর কাছে। ৮২৪ খ্রিস্টাব্দে আরেক সেনাপতি আহমাদ ইবনে আল জুনায়েদ খোরামিয়ানদের আক্রমণ করেন, কিন্তু তিনিও পরাজিত হন এবং বাবাকের বাহিনীর হাতে বন্দি হন। অনেকগুলো ব্যর্থ আক্রমণের পর ৮২৭ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুদ তুসির নেতৃত্বে আরব বাহিনী খোরামিয়ানদের পরাজিত করতে সমর্থ হয়। কিন্তু বাবাক এবং তার মূল বাহিনী আরবদের নাগালের বাইরে রয়ে যান।

নিজের পরাজয়কে পুঁজি করে বাবাক ৮২৯ খ্রিস্টাব্দে আবার হুমায়ুদ তুসির মুখোমুখি হন। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে হুমায়ুদ তুসি মারা যান এবং আরব বাহিনী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। খোরামিয়ানদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি ছিল বাড পর্বতের ২৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ‘বাবাক দূর্গ’। দূর্গটির চারপাশ ছিল পাহাড় আর নালা দিয়ে বিভক্ত, যা দূর্গটিকে সবার থেকে সুরক্ষিত করে তুলেছিল। দূর্গে কেউ আক্রমণ করলে সামান্য কিছু সৈনিকই বিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার জন্য যথেষ্ট ছিল, তাছাড়া শীতকালে এই দূর্গে আক্রমণ করা অসম্ভব একটি ব্যাপার। এই দূর্গের কৌশলগত অবস্থানের কারণে আরবরা বারবার আক্রমণ করেও কোনো ধরণের সাফল্য পাচ্ছিল না।

বাবাক দুর্গ; Image Source: inspirock.com

৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা মুত্তাসিম নিজের সেরা জেনারেল হায়দার ইবনে কাভুসকে পাঠান বাবাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। তার উপর নির্দেশ ছিল কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধের ফলাফল খোরামিয়ানদের অনুকূলে যাতে না যায়। কাভুস বাবাকের স্বদেশী ছিলেন, সেইসঙ্গে তাদের ভেতর একটি চুক্তিও হয়েছিল বহু বছর আগে। যে চুক্তি অনুযায়ী কাভুস কথা দিয়েছিলেন, আরবদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি বাবাককে সহযোগিতা করবেন। এরপর আরব আর পারস্যের বিদ্রোহী বাহিনীর মাঝে লড়াইয়ের প্রায় ১৮ বছর কেটে গেছে। আরবরা কাভুসকে প্রচুর ধন-সম্পদ দেওয়ার বিনিময়ে খোরামিয়ানদের তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছিল। একসময় তাকে আরব বাহিনীর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। খলিফার মদদপুষ্ট হয়ে কাভুস নিজ বাহিনীকে আরব দূর্গগুলো পুনরুদ্ধার করতে পাঠান। এদিকে খলিফা মুত্তাসিম বাবাকের এক বিশ্বস্ত লোককে বন্দি করতে সক্ষম হন, যাকে টর্চার করে বাবাকের যুদ্ধকৌশল এবং আঞ্চলিক যুদ্ধের সহজ রুটগুলো সম্পর্কে জেনে নেন। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো এমন সময়ে আরবদের হাতে পৌঁছায়, যখন কাভুস নিজে বাবাক দূর্গে অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

এই ঘটনা জানতে পেরে বাবাক দ্রুত বাইজানটাইন সম্রাট থিওফিলাসের কাছে সৈন্য সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু সেই চিঠি সময়মতো সম্রাটের নিকট পৌঁছেনি। তাই বাধ্য হয়ে বাবাক পরিবারের লোকজন এবং অল্পকিছু সৈনিক নিয়ে আর্মেনিয়ায় পালিয়ে যান। এদিকে কাভুস ‘বাবাক দূর্গ’ দখল করে নেন এবং লুন্ঠন চালানোর পর এটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন।

দীর্ঘ ২১ বছর ধরে বাবাক খোরামদিন বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন; Image Source: youtube.com

বাবাক আর্মেনিয়ার রাজপুত্র সাহল ইবনে সোনবাতের হেফাজতে আছেন এটা জানতে পেরে কাভুস রাজপুত্রের কাছে বিপুল উপঢৌকন পাঠান, যাতে বাবাককে তিনি আরবদের হাতে তুলে দেন। রাজপুত্র সম্পদের লোভে বাবাককে কাভুসের হাতে তুলে দেন। বাবাক খোরামদিনকে বন্দি করে আরব খলিফার নিজ শহর সামারায় নিয়ে আসা হয়েছিল এবং ৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে বাবাকের হাত-পা কেটে নেওয়া হয়েছিল। তারপর তার মৃতদেহ সামারা’র শহরময় ঘুরিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

দীর্ঘ ২১ বছর ধরে বাবাক খোরামদিন বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এতগুলো বছর ধরে চলমান লড়াইয়ে আরবদের তিনি নিজের পায়ের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পারস্যের স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে নিজেদের স্বজাতির বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সফলতা আসেনি, কিন্তু তার দীর্ঘসময়ের এই নেতৃত্ব পারস্যকে একটি যোদ্ধাজাতিতে পরিণত করেছিল। দেশের প্রতি এমন ভালোবাসার উদাহরণ পারস্যবাসী কখনো ভুলবে না। নিজেদের বীরকে সম্মান জানাতে ইরানের জনগণ তাই প্রতি বছর ১০ জুলাই ‘বাবাক দূর্গে’র ধ্বংসাবশেষ ঘুরে আসেন। তাকে স্বরণ করার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মাথা তুলে দাঁড়ানোর শিক্ষাই নিয়ে চলে ইরানিরা।

ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This article is about Babak Khorramdin & his fight against Arab dynasty of free Persia.

Necessary sources are hyperlinked in the article.

Featured Image: about-history.com

Related Articles