Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বখত খান: সিপাহী বিদ্রোহের হারিয়ে যাওয়া এক বিল্পবী

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম সিপাহী বিদ্রোহ। এই উপমহাদেশের অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষের রক্ত, ত্যাগ আর সাহসিকতা সে বিদ্রোহের সাথে মিশে আছে নিবিড়ভাবে। যদিও সে যুদ্ধে সিপাহী এবং আমজনতার পরাজয় ইতিহাসের বাস্তবতা, তবুও এই বিদ্রোহ উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি প্রেরণাদায়ক ঘটনা। এই আন্দোলনে যে ক’জন সাহসী মানুষ নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে ইংরেজ শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন বখত খান।

ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে

১৮৫৭ সালের উত্তাল সময় তখন। শত বছরের ইংরেজ শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করতে সিপাহী জনতার প্রতিরোধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই বিদ্রোহের ছোঁয়া লাগল সুদূর মেরুতেও। ইংরেজদের অধীনে কাজ করার পরেও, অসংখ্য ভারতীয় সামরিক কর্তাদের মনে তখন ধিকিধিকি জ্বলছিল মুক্তির স্বপ্ন। এরকমই একজন বখত খান। বিদ্রোহের শুরুতেই চলমান বিদ্রোহের জন্য লড়াই করতে তিনি তার রোহেলা বাহিনীকে প্রস্তুত করেন। অতঃপর মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে সহায়তা করার জন্য, বিশাল বাহিনী নিয়ে মেরুত থেকে যাত্রা করেন বিদ্রোহের কেন্দ্র দিল্লী অভিমুখে। 

সিপাহী বিদ্রোহ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; Image Source: thoughtco.com
সিপাহী বিদ্রোহ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; Image Source: thoughtco.com

দিল্লীতে বখত খান পৌঁছান ১৮৫৭ সালের পহেলা জুলাই। দিল্লী যদিও তখন মুক্তিকামী সিপাহীদের অধিকারে, তবু বিভিন্ন কারণে দিল্লীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা খুবই বিশৃঙ্খল। এর অন্যতম কারণ- বিদ্রোহের সুযোগ দুর্বৃত্তরাও নিয়েছিল। বয়োঃবৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর যদিও উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নানাবিধ কারণেই তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে দিল্লীতে উদয় হলেন বখত খান। রণাঙ্গনে তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কারণেই তার সেই আগমন আশার সঞ্চার করল বিদ্রোহীদের মনে।

বখত খানের পরিচয়

১৭৯৭ সালের কোনো এক দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন বখত খান। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি জন্মেছিলেন রোহিলাখণ্ডের বিজনোরে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, তিনি ছিলেন পশতুন এবং রোহেলা নেতা নাজিব-উদ-দৌলার সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। ইংরেজ বাহিনীর সুবেদার হিসেবে তিনি বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময়, তিনি ইংরেজ অশ্বারোহী বাহিনীতে প্রায় চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞ সেনা কর্মকর্তা।

বখত খান জন্মেছিলেন রোহিলাখন্ডের বিজনোরে; Image Source: myuttarpradesh.net
বখত খান জন্মেছিলেন রোহিলাখণ্ডের বিজনোরে; Image Source: myuttarpradesh.net

ঐতিহাসিকদের এও বিশ্বাস রয়েছে, তাকে এই বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মৌলভী সরফরাজ আলী, যিনি বৃটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে, ইমাম ই মুজাহিদিন নামে সমধিক পরিচিত হয়েছিলেন।

বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের পক্ষে কাজ করা, মুনশি জিয়ান লাল নামক একজন ব্রিটিশ গুপ্তচরের তথ্যমতে, বখত খানের সাথে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে দোসরা জুলাই। সে সময় বখত খান নিজেকে সম্রাটের একই রক্তের মানুষ হিসেবে দাবি করেন। ঐতিহাসিক খাজা হাসান নিজামী উল্লেখ করেছেন, বখত খান মায়ের দিক থেকে অউধের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ও পিতার দিক থেকে গোলাম কাদির রোহেলা পরিবারের সাথে সংযুক্ত ছিলেন।

নেতৃত্বের আসনে

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সময়টাতে বখত খানের আগমন সবার মাঝে আশার আলো নিয়ে এসেছিল। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরও তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। সম্রাট তাকে ‘ফারজান্দ’ বা নিজের সন্তান হিসেবে ডেকে সম্মানিত করেন। তার যোগ্যতার বলেই সামরিক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। তখনও পর্যন্ত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ছেলে মির্জা মুঘল সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে থাকলেও, বখত খান দিল্লীতে আসার পর, তার নেতৃত্ব খর্ব হয়। এর প্রধান কারণ ছিল, মির্জা মুঘল সামরিক দিক থেকে ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ। যা-ই হোক, সম্রাট নিজেই বখত খানকে সাহেব-ই-আলম বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেন।

সম্রাট বখত খানকে আগলে রাখলেও মির্জা মুঘলের সাথে তার সম্পর্ক ভালো যায়নি; Image Source: columbia.edu
সম্রাট বখত খানকে আগলে রাখলেও মির্জা মুঘলের সাথে তার সম্পর্ক ভালো যায়নি; Image Source: columbia.edu

বিদ্রোহে বখত খানের ভূমিকা

বখত খান প্রায় তিন হাজার সৈন্যসহ দিল্লীতে আগমন করার পর সৈন্যদের মনোবল চাঙা হয় এবং দিল্লীর বিশৃঙ্খল অবস্থায় তার মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তির আগমন আশার সৃষ্টি করলেও বাস্তবতা ততটা সহজ ছিল না। প্রাথমিকভাবে সিপাহীরা সফলতা পেলেও, সুশৃঙ্খল বাহিনী বলতে যা বোঝায়, তা গড়ে ওঠেনি।

বখত খান দিল্লীতে পৌঁছেই সময় নষ্ট না করে যুদ্ধে মনোযোগ দেন। ৪ই জুলাই তিনি বৃটিশ বাহিনীর উপর জোরালো হামলা করেন এবং ৯ জুলাই অভিযান চালিয়ে তিস হাজারি অধিকার করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তার প্রাথমিক সাফল্য সিপাহীদের অন্য বিভক্ত দলসমূহের মধ্যে বরং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এমনকি তাকে নিন্দা করে সম্রাটের নামে নকল ঘোষণাও ছড়িয়ে দেওয়া হয়!

তবে বখত খান চেয়েছিলেন সিপাহীদের ঐক্য ও সংহতি ঠিক রাখতে। তার পরামর্শে সিপাহীদের বেশ কিছু সুবিধা প্রদান করার ঘোষণা দেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। যদিও মির্জা মুঘলের সাথে বখত খানের মনোমালিন্যের বিষয়টি ক্রমেই প্রকাশ্যে চলে আসছিল কিন্তু সম্রাট বখত খানকে সবসময়ই আগলে রেখেছিলেন।

বিদ্রোহের পর বিদ্ধস্ত কাশ্মিরি গেট: Image Source: wikimedia.org
বিদ্রোহের পর বিধ্বস্ত কাশ্মিরি গেট: Image Source: wikimedia.org

তিস হাজারি অধিকারের পরেও সাবজি মান্দি, আলিপুর ও মোবারকবাগ অঞ্চলে ইংরেজদের অবস্থান বিদ্যমান ছিল। দিল্লীর উপকণ্ঠে ইংরেজদের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ বিধায়, সম্রাট বখত খানকে এসব অঞ্চল অধিকারের নির্দেশ দেন। বখত খানের একার পক্ষে এই নির্দেশ পালন করা সম্ভব ছিল না। যদিও নিমুচ সিপাহীদের সাহসিকতার জন্য সুনাম ছিল কিন্তু তাদের নেতা গাউস খান ও সিধারি সিং বখত খানের সাথে মোটামুটি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়লে, এসব অভিযান ব্যর্থ হয়।

তবে সিধারি সিং ও মির্জা মুঘল বখত খানের দিকে ইংরেজদের সাথে গোপন আঁতাতের অভিযোগ তোলেন সম্রাটের কানে। তবে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এ অভিযোগ পাত্তা দেননি।

আগস্টের ২৪ তারিখে বখত খান আলিপুর অভিযানে বের হন। নিমুচ সিপাহীরাও একই লক্ষ্যে অভিযানের জন্য বের হন। কিন্তু দুই বাহিনীর মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না। বখত খান যখন কাছাকাছি পৌঁছেন, তখন সেখানে নিমুচ বিগ্রেডও সেখানে পৌঁছে যায়। বখত খান পরামর্শ দেন, পরদিন সকালে যৌথ অভিযান পরিচালনা করতে। কিন্তু তার পরামর্শ অগ্রাহ্য করা হয় এবং নিমুচ বাহিনী সেখানে পরাস্ত হয়। বখত খান আর ঝুঁকি না নিয়ে দিল্লীতে ফেরত আসেন। এদিকে মির্জা মুঘল এই অভিযান ব্যর্থতার পেছনে বখত খানের নিষ্ক্রিয়তাকে অভিযুক্ত করেন।

সিপাহী বিদ্রোহের পর, বিদ্রোহীদের ভাগ্যে নেমে আসে অন্ধকার; Image Source: wikimedia.org
সিপাহী বিদ্রোহের পর, বিদ্রোহীদের ভাগ্যে নেমে আসে অন্ধকার; Image Source: wikimedia.org

যা-ই হোক, এভাবেই ধীরে ধীরে সিপাহীদের অনৈক্য, কোন্দল, অর্থনৈতিক অবস্থার বিপর্যয় সহ নানা কারণে ধীরে ধীরে সিপাহীদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। সেইসাথে ইংরেজদের অবস্থান হতে থাকে শক্তিশালী।

একথা সত্য যে, দিল্লীর সেসময়কার বিশৃঙ্খল অবস্থায়, বখত খান শৃঙ্খলা ফেরাতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছেন। অর্থনৈতিক সমস্যা ও দিল্লীর নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার দিকে তার মনোযোগ ছিল। তবে সিপাহীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অনৈক্য তার মেধা ও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করার সুযোগ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল। মির্জা মুঘল ও নিমুচ সিপাহীদের সাথেও তার সম্পর্ক কখনো স্বাভাবিক হয়নি।

বখত খান সম্রাটের নির্দেশে, নতুন নতুন সামরিক কৌশল গ্রহণ করে এগিয়েছিলেন। সেইসাথে তিনি ইংরেজদের ব্যতিব্যস্ত রাখতে নিয়মিত পালাক্রমে হামলা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে যে কারণেই হোক, তার কিছু অভিযানও ব্যর্থ হলে, তার নেতৃত্ব ও অবস্থান নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়। সম্রাট নিজেও আশাহত হন।

লড়াই থামেনি তার

সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই দিল্লীর পতন মোটামুটি সময়ের অপেক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশদের চর ও পদলেহী অনেকেই তখন সম্রাটকে অনবরত চাপ দিয়ে যাচ্ছিল আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তু বখত খান বয়সের ভারে ন্যুব্জপ্রায় সম্রাটকে বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন, আত্মসমর্পণ না করে দিল্লী ছেড়ে লখনৌর দিকে যাত্রা করতে এবং সেখান থেকেই লড়াই চালিয়ে যেতে। কিন্তু এসময় বাধ সাধে মির্জা ইলাহী বক্স সহ বেশ কয়েকজন। সম্রাটকে তারা সেদিকে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করেন। শেষমেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর তার পরিবার সহ আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেও, বখত খান হাল না ছেড়ে দিল্লী থেকে পিছু হটে লখনৌতে চলে যান। লখনৌর পতন হলে তিনি শাহজাহানপুরে মৌলভী আহমদুল্লাহের বাহিনীর সাথে যোগ দেন।

খুনী দরজা: বখত খান পিছু হটলেও, মির্জা মুঘলকে এখানেই হত্যা করে ইংরেজরা; Image Source: pandareviewz.com
খুনী দরজা: বখত খান পিছু হটলেও, মির্জা মুঘলকে এখানেই হত্যা করে ইংরেজরা; Image Source: pandareviewz.com

এরপরে শাহজাহানপুর ও বেশ কিছু জায়গায় তাদের লড়াই বেশ কিছুদিন যাবত অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে ঠিক কত সালে এবং কখন তার বিদ্রোহী জীবনের অবসান ঘটেছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কারো মতে, তিনি ১৮৫৯ সালের ১৩ই মে, একটি অভিযানে মৃত্যুবরণ করেন। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, তিনি শেষ জীবন সোয়াত কিংবা নেপালে কাটান এবং স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।

যেখানেই যেভাবেই তার জীবনাবসান ঘটুক, সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাসে বখত খান স্বল্প সময়ের জন্য উদয় হয়ে তিনি তার যে সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আমৃ্ত্যু লড়ে যাওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, ইতিহাসে তা একটি অনন্য প্রেরণাদায়ক ঘটনা হয়েই থাকবে।

This is a Bangla Article About General Bakht Khan, a leader of Sepoy Revolt in 1857. Necessary links have been hyperlinked. 

Feartured Image Source: ullashtv.com

 

Related Articles