Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্যাটল অফ কোরাল সি (শেষ পর্ব): যুদ্ধে আসলে কে জিতলো? 

গত তিন পর্ব (পর্ব – ১, পর্ব – ২, পর্ব – ৩) যদি ধারাবাহিকভাবে পড়ে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে, “তারপর কী হলো? যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কে জিতলো?” শেষ পর্বে আপনাদের জানানো হবে ব্যাটল অফ কোরাল সি-র জয়-পরাজয়ের খতিয়ান ও এই যুদ্ধের তাৎপর্য। কেননা যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের প্রথম যুদ্ধের ফলাফল প্যাসিফিক অঞ্চলের ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাবে সেটি যেমন দেখিয়ে দিয়েছিল, তেমনি নতুন যুগের এক নৌ-যুদ্ধের দ্বার উন্মোচন করেছিল। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারভিত্তিক যুদ্ধকৌশল কোরাল সি থেকে আজ পর্যন্ত চালু আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।

জাপানি বিমান হামলা থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে ইউএসএস লেক্সিংটন; Image source : history.navy.mil

৮ মে, ১৯৪২; বেলা একটা থেকে দেড়টার মধ্যে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া সত্ত্বেও ইউএসএস ইয়র্কটাউন এবং লেক্সিংটন যার যার বিমানগুলো ল্যান্ড করাতে সক্ষম হয়। লেক্সিংটনের কিছু বিমান তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত ইয়র্কটাউনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত ফ্লাইট ডেকে ল্যান্ড করতে গিয়ে, জ্বালানী শেষ হওয়ায় সময়মতো ল্যান্ড করতে না পারাসহ অন্যান্য কারণে যুক্তরাষ্ট্র ৫টি ডাইভ বোম্বার, ২টি টর্পেডো বোম্বার ও ১টি ওয়াইল্ডক্যাট ফাইটার বিমান হারায়। জাপানিরাও একই কারণে আরো ৫টি ডাইভ বোম্বার, ২টি জিরো ফাইটার ও ১টি টর্পেডো বোম্বার হারায়। 

আক্রমণ করতে পাঠানো মোট ৬৯টি জাপানি বিমানের মধ্যে ৪৬টি অক্ষতাবস্থায় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুতে ল্যান্ড করে। এসব বিমানের মধ্যে মেরামত করার অযোগ্য হয়ে গেছে বিধায় আরো ৩টি জিরো, ৪টি ডাইভ বোম্বার ও ৫টি টর্পেডো বোম্বার পানিতে ফেলে দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে যুইকাকুর এয়ার গ্রুপের সবগুলো বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। পাইলট ছাড়াও বহু সংখ্যক এয়ার ক্রু (যারা বিমান ওঠা-নামা, রিফুয়েলিং, অস্ত্র লোড করে) এই যুদ্ধে মারা যান। ফলে প্রায় অক্ষত থাকার পরও জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকু পরের মাসে সংঘটিত ‘ব্যাটল অফ মিডওয়ে’তে অংশ নিতে পারেনি। 

পানিতে পড়ে থাকা টেইল নাম্বার EI-306-ধারী এই টর্পেডো বোম্বারটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার শকাকু থেকে এসেছিল; Image source : wikipedia.org

ফ্লেচার ইয়র্কটাউন পাইলটদের থেকে একটি জাপানি ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার রিপোর্ট পান। আবার লেক্সিংটনের পাইলটরা কোনো ক্যারিয়ারই তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে রিপোর্ট দেন। সব মিলিয়ে পাইলটদের দেয়া পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট এবং মার্কিনীদের ইন্টারসেপ্ট করা জাপানিদের প্রোপাগান্ডা রেডিও মেসেজ অনুযায়ী কোনো জাপানি ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি- এমন রিপোর্ট পেয়ে ফ্লেচার পরবর্তী যুদ্ধকৌশল নিয়ে অ্যাডমিরাল ফিচের সাথে আলোচনা করেন।

এদিকে ট্যাংকার জাহাজের ডুবে যাওয়ার ঘটনায় টাস্কফোর্স ১৭ এর সবগুলো যুদ্ধজাহাজের জ্বালানীর সংকট শুরু হয়েছে। এই সমস্যা ছাড়া অ্যাডমিরাল ফ্লেচারের হাতে আরেক দফা যুদ্ধ করার পর্যাপ্ত বিমান ছিল। কিন্তু জাপানিদের এখন আবার খুঁজতে গেলে ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার মতো জ্বালানী থাকবে না। অস্ট্রেলিয়া থেকে অপর ট্যাংকার জাহাজটি কোরাল সাগরে আসতে আরও একদিনের মতো সময় লাগবে। সব মিলিয়ে ভুল রিপোর্ট অনুযায়ী জাপানি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপকে এখনও যুদ্ধ করার মতো শক্তিশালী মনে করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে অ্যাডমিরাল ফ্লেচারের টাস্কফোর্স ১৭। তিনি জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারকে জাপানি ক্যারিয়ারের পজিশন রেডিওতে জানান এবং ল্যান্ড বেজড বোম্বার দিয়ে হামলা করতে অনুরোধ করেন।

কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো- আড়াইটার সময় অ্যাডমিরাল হারা তাকাগিকে রিপোর্ট করেন যে, তার মাত্র ২৪টি জিরো ফাইটার, ৮টি ডাইভ বোম্বার ও ৪টি টর্পেডো বোম্বার অবশিষ্ট আছে। অর্থাৎ তাকাগি এখনও পোর্ট মোর্শবি ইনভেশন ফোর্সকে এয়ার কাভার দেয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু এরই মধ্যে মার্কিনীরা যদি আবার হামলা করে তবে সেটি ঠেকানোর মতো শক্তি তাদের নেই।

ক্ষতিগ্রস্থ ইউএসএস লেক্সিংটনের অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গানপোর্ট দেখছে ক্রুরা; Image source : history.navy.mil

তাছাড়া তারও মূল সমস্যা ছিল জ্বালানী সংকট। চার দিন আগে রিফুয়েলিং করার সময় ইয়র্কটাউনের হামলার খবর শুনে তিনি জ্বালানি নেয়ার কাজ বাদ দিয়ে যুদ্ধে এসেছিলেন। এ কয়দিন ধরে যুদ্ধের ব্যস্ততায় রিফুয়েলিং করার সুযোগ পাননি। তার ক্রুজার ফোর্সের জ্বালানী ৫০% এবং ডেস্ট্রয়ারগুলোর জ্বালানী ২০%-এ নেমে এসেছে। বেলা তিনটার সময় তাকাগি রাবাউলে থাকা ফ্লিট কমান্ডার অ্যাডমিরাল ইনোয়ির কাছে জাপানি পাইলটদের দেয়া ভাষ্য অনুযায়ী দুটো মার্কিন ক্যারিয়ার ডুবিয়ে দেয়ার রিপোর্ট করেন। কিন্তু নিজেদের পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে আর যুদ্ধ চালানো বিপদজনক বিধায় যুদ্ধ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার অনুমতি চান।

এরই মধ্যে অ্যাডমিরাল ইনোয়ির পাঠানো রিকনসিস বিমান অ্যাডমিরাল ক্রেসের ফাঁদ পেতে রাখা অস্ট্রেলিয়ান ক্রুজার ফোর্সকে শনাক্ত করে। ফলে এই মুহূর্তে ক্যারিয়ারগুলোর এয়ার কাভার ছাড়া পোর্ট মোর্শবিতে ইনভেশন ফোর্স পাঠানো আর আত্মহত্যা করা একই কথা। তাই তিনি অ্যাডমিরাল গোটোকে ইনভেশন ফোর্স নিয়ে রাবাউলে ঘাঁটিতে ফেরত যেতে বলেন এবং পোর্ট মোর্শবি অপারেশন ৩ জুলাই পর্যন্ত মূলতবি করেন। তাকাগি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুকে নিয়ে রাবাউলে ফিরে যান এবং শকাকু মেরামত করার জন্য জাপানে ফিরে যায়।

আগুন থেকে বাঁচাতে লেক্সিংটনের ৩৫টি বিমান পিছনে এনে রাখা হয়েছে (বামে) যা শেষ ডুবে ধ্বংস হয় এবং ক্রুরা জাহাজ ত্যাগ করতে সামনে অবস্থান নিয়েছেন Image source : history.navy.mil

সর্বনাশের ষোলকলা

মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইয়র্কটাউন ও লেক্সিংটনের ড্যামেজ কন্ট্রোল টিম যার যার জাহাজের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পৌনে একটার দিকে একটি ইলেকট্রিক মোটর থেকে সামান্য স্পার্ক হয় এবং একটু আগের জাপানি টর্পেডো হামলায় ফুয়েল রিজার্ভার থেকে ছড়ানো গ্যাসোলিনের বাষ্প দিয়ে পুরো জাহাজ ভরে থাকায় সাথে সাথে জাহাজটির মূল কন্ট্রোল স্টেশনে বিস্ফোরণে ফলে আবার আগুন লাগে এবং ২৫ জন ক্রু তৎক্ষণাৎ মারা যায়। বেলা পৌনে তিনটার সময় দ্বিতীয় এবং সাড়ে তিনটার সময় তৃতীয় বিস্ফোরণে জাহাজটির বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব বিধায় বিকাল পাঁচটার সময় জাহাজ ত্যাগ করেন অ্যাডমিরাল ফিচ ও তার ক্রুরা। তাদেরকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে আশেপাশের মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো। 

সন্ধ্যা সাতটার সময় ধীরে ধীরে ডুবতে থাকা জ্বলন্ত জাহাজটির মৃত্যু সহজ করতে ৫টি টর্পেডো মেরে একে ডুবিয়ে দেয় সঙ্গী মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ‘ইউএসএস ফেল্‌প্স’। ৭টা ৫২ মিনিটে ৩৫টি বিমানসহ ইউএসএস লেক্সিংটন পুরোপুরি ডুবে যায়। ২,৯৫১ জন নাবিকের মধ্যে ২১৬ জন মারা যায়।

দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণের মুহূর্তে ইউএসএস লেক্সিংটন (উপরে-বামে) ও আগুন নেভাতে এগিয়ে আসা দুটো ডেস্ট্রয়ার থেকে পানি ছিটানো হচ্ছে (উপরে-ডানে) এবং ডুবে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ইউএসএস লেক্সিংটন (নিচে); Image source : navy.gov.au 

ক্ষতিগ্রস্ত ইয়র্কটাউন তখন মেরামতের জন্য পার্ল হারবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এদিকে জেনারেল ম্যাকআর্থারের বি-১৭ দ্বিতীয় দফা হামলার মুখে ইনভেশন ফোর্স বিকল্প কোর্স ধরে পালিয়ে যায়। তবে অ্যাডমিরাল ক্রেস তখনও ইয়র্কটাউনের চলে যাওয়ার খবর জানতেন না। তার ক্রুজার ফোর্সের জ্বালানী খুবই কমে যাওয়া সত্ত্বেও পেট্রোলিং চালিয়ে যান এই ভয়ে যে যদি আবার ইনভেশন ফোর্স পুনরায় ফিরে আসে। তিনি পরদিন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান।

৮ তারিখ রাত দশটায় ফ্লিট অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতো ভাইস অ্যাডমিরাল ইনোয়িকে নির্দেশ দেন তিনি যেন তাকাগিকে অবশিষ্ট মার্কিন নৌশক্তি খুঁজে বের করে ধ্বংস করার নির্দেশ দেন এবং পোর্ট মর্শবি অপারেশন যেকোনো মূল্যে সমাপ্ত করেন। কিন্তু অ্যাডমিরাল ইনোয়ি এক অর্থে আদেশ অমান্য করেন। ইনভেশন ফোর্সকে ফিরে আসার নির্দেশ বাতিল না করে বরং তাকাগিকে ইয়ামামোতো নির্দেশ জানিয়ে দেন। অ্যাডমিরাল গোটোকে তার ক্রুজার ফোর্স নিয়ে যুইকাকুর সাথে যুক্ত হতে বলা হয়।

ইনোয়ি তাকাগির রিফুয়েলিংয়ের জন্য রাবাউল থেকে অয়েল ট্যাংকার জাহাজ পাঠান। ৯ তারিখ প্রায় সারাদিন ধরে তার বহরের জাহাজগুলো মাঝসাগরে তাদের সবচেয়ে বড় ফ্লিট অয়লার জাহাজ ‘সোহো মারু’ থেকে জ্বালানি গ্রহণ করে। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি প্রথমে কোরাল সাগরের দক্ষিণ-পূর্বে, পরে দক্ষিণ-পশ্চিমে সার্চ অপারেশন চালান। পরদিন ১০ মে, সকালে বিমান দিয়ে টাস্কফোর্স ১৭-কে তন্ন তন্ন করে খোঁজেন তাকাগি। সেদিন দুপুরে ইয়ামামোতোকে মার্কিন নৌবহরের কোরাল সাগর ত্যাগের বিষয়টি রিপোর্ট করেন এবং রাবাউলের ঘাঁটির দিকে যাত্রা করেন। তবে অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতো তাকে জাপানে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। কেননা যুইকাকুর এয়ার গ্রুপ সম্পূর্ণ নতুন করে আবার গড়ে তুলতে হবে। এদিকে ইয়ামামোতোর রেডিও মেসেজগুলোতে আগে থেকেই ইন্টারসেপ্ট করতো মার্কিন গোয়েন্দারা। দুটো ক্যারিয়ারের জাপান ফেরার খবর পেয়ে এর সম্ভাব্য গমন পথে ৮টি মার্কিন সাবমেরিন তাদের জন্য অ্যাম্বুশ পাতে। কিন্তু সেগুলো ফাঁকি দিয়ে জাপানে পৌঁছে যান তাকাগি।

ক্ষতিগ্রস্ত জাপানি ক্যারিয়ার শকাকুর বাইরের অংশ (বামে) এবং মার্কিন ক্যারিয়ার ইয়র্কটাউনের ভেতরের অংশ (ডানে); Image source : history.navy.mil 

১১ তারিখ বিকালে একটি মার্কিন পেট্রোল বিমান কোনোরকমে ভেসে থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত সেই মার্কিন অয়েল ট্যাংকারে বেঁচে থাকা নাবিকদের শনাক্ত করে। কাছাকাছি থাকা অপর ডেস্ট্রয়ার হেনলি গিয়ে পরে ১২৩ জনকে উদ্ধার করে এবং কামানের গোলা মেরে অর্ধ-ডুবন্ত ট্যাংকারকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দেয়। এরই মধ্যে জাপানিরা তাদের অপারেশন আর-ওয়াই শুরু করে।

প্রথম পর্বে বলা হয়েছিল, ১০ মে  Operation Mo অনুযায়ী পোর্ট মর্শবি দখল করার পরপরই ১৫ মে নাউরু ও ওশান আইল্যান্ড দখল করার জন্য Operation RY এবং পরের মাসে ফিজি, সামোয়া ও নিউ ক্যালিডোনিয়া দখল করার জন্য Operation FS এর পরিকল্পনা করেন অ্যাডমিরাল ইনোয়ি। অপারেশন এম-ও এর পর মার্কিনীরা অপারেশন আর-ওয়াই এর পরিকল্পনাতেও জল ঢেলে দেয়।

এই অপারেশনের ফ্ল্যাগশিপ ওকিনোশিমা নামক জাহাজকে ঐ অঞ্চলে আগে থেকেই টহলে থাকা মার্কিন সাবমেরিন এস-৪২ থেকে আচমকা টর্পেডো হামলা করে ডুবিয়ে দেয়। ফলে অ্যাডমিরাল ইনোয়ি ১৭ তারিখ পর্যন্ত নাউরু ও ওশান আইল্যান্ড ইনভেশনও মূলতবি করতে বাধ্য হন। কেননা ওকিনোশিমার কাজ ছিল ঐ দুটো দ্বীপে যাওয়ার পথে সমুদ্রে নেভাল মাইন নিক্ষেপ করে মার্কিনীদের জন্য ফাঁদ পেতে রাখা, যেন ইনভেশন ঠেকাতে কোনো মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এদিকে না আসতে পারে। 

জাপানিরা পোর্ট মর্শবি দখলের জন্য এতটাই মরিয়া ছিল যে জলপথে ব্যর্থ হয়ে স্থলপথে আক্রমণ করে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান আর্মি তাদের ঠেকিয়ে দিয়েছিল। ছবিতে জাপানিদের ঠেকাতে 39th Australian Infantry Battalion দুর্গম অঞ্চল পাড়ি দিচ্ছেন; Image source : wikipedia.org

গোয়েন্দাদের সূত্রে রেডিওতে অপারেশন আর-ওয়াই মূলতবির খবরটি পেয়ে মার্কিন ফ্লিট অ্যাডমিরাল চেস্টার নিমিটজ এবার এক দুর্দান্ত চাল দিলেন। নাউরো ও ওশান আইল্যান্ডে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ জাপানি ইনভেশন ঠেকাতে যাওয়া অ্যাডমিরাল হ্যালসির টাস্কফোর্স ১৬-কে এমন কোর্স ধরে পার্ল হারবারে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন যেন তারা পরদিন সকালে জাপানি স্কাউট বিমানের চোখে ইচ্ছা করে ধরা দেয়। পরিকল্পনা মোতাবেক পরদিন তুলাগি থেকে নিয়মিত রিকনসিস মিশনে আসা একটি সি-প্লেনের চোখে ধরা দেয় অ্যাডমিরাল হ্যালসির দুটো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, যারা ঐ মুহূর্তে সলোমন আইল্যান্ডের ৮২৪ কি.মি. পূর্বে ছিল। এই খবর পাওয়ার পর এবার অ্যাডমিরাল ইনোয়ি অপারেশন আর-ওয়াই পুরোপুরি বাতিলই করে দেন। কেননা কোরাল সি যুদ্ধে জাপানি পাইলটরা বলেছে যে তারা দুটো ক্যারিয়ার ডুবিয়েছে। আবার তাকাগি অবশিষ্ট মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোকে খুঁজে না পেয়ে রিপোর্ট করেছিল যে মার্কিনীরা এই অঞ্চল ছেড়ে চলে গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে দুটো ক্যারিয়ার বহাল তবিয়তেই সাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কিন্তু জাপানিদের কোনো ক্যারিয়ারই এই অঞ্চলে এখন নেই। অথচ এয়ার কাভার ছাড়া এই অপারেশন চালানো প্রায় অসম্ভব।

তাই অপারেশন বাতিল করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না অ্যাডমিরাল ইনোয়ির হাতে। ২৬ মে যুদ্ধ ছাড়াই জাপানিদের ঠেকিয়ে দেয়া অ্যাডমিরাল হ্যালসির দুই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এন্টারপ্রাইজ ও হরনেট পার্ল হারবারে ফিরে আসে। সেদিন ইয়র্কটাউন ও পার্ল হারবারের ড্রাই ডকে নোঙর করে। তাকে আসন্ন মিডওয়ের যুদ্ধের জন্য দ্রুতগতিতে প্রস্তুত করা হয়। 

পার্ল হারবার ড্রাই ডকে ইয়র্কটাউনকে মেরামত করতে আনুমানিক তিন মাস সময় লাগবে বলেছিলেন ইঞ্জিনিয়াররা; Image source : wikipedia.org

সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি 

যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্যারিয়ার ইউএসএস লেক্সিংটন ডুবে যায়। এছাড়া ডেস্ট্রয়ার ও অয়েল ট্যাংকার ডুবে যায়। একটি ফ্লিট ক্যারিয়ার ইয়র্কটাউন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিনিরা ৬৯টি বিমান ও ৬৫৬ জন নাবিক-পাইলট হারায়। জাপানের একটি লাইট ক্যারিয়ার (সহো) ডুবে যায়। এছাড়া ১টি ডেস্ট্রয়ার ও ৩টি মাইন সুইপার ডুবে যায়। এছাড়া তাদের ১টি ফ্লিট ক্যারিয়ার শকাকু, ১টি ডেস্ট্রয়ার, ১টি ট্রান্সপোর্ট শিপ, ১টি ছোট যুদ্ধজাহাজ কোরাল সি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া যুদ্ধ পরবর্তী অপারেশনে মার্কিন সাপ্লাই লাইন ধ্বংস করতে আসা ৫টি জাপানি সাবমেরিনের মধ্যে I-28 নামের একটি সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয় মার্কিন সাবমেরিন Tautog। সব মিলিয়ে জাপানের ১৩,৯০০ টন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৬২,৬০০ টনের জাহাজ ডুবে যায়।

বিমান, পাইলট ও এয়ারক্রু মিলিয়ে সামগ্রিক ক্ষতি হয়েছে জাপানেরই। কেননা উন্নত ট্রেইনিং একাডেমী ও আধুনিক বিমান নির্মাণ ফ্যাক্টরির কারণে যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত ক্ষতি কাঁটিয়ে উঠতে সক্ষম ছিল। Image source: youtube.com

নৌযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ডুবে যাওয়া জাহাজের ডিসপ্লেসমেন্ট দিয়ে নির্ণয় করা হয়, তাই আপাতদৃষ্টিতে এই যুদ্ধে জাপান জয়ী হয়েছে। কিন্তু কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ব্যাটল অফ কোরাল সি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশাল এক জয়। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম কোনো জাপানি ইনভেশন ব্যর্থ করে দিয়েছে তারা। তাছাড়া ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভি যে একদম অজেয় নৌশক্তি নয় তা দেখিয়ে দিয়েছে কোরাল সি। মার্কিনিরা এই যুদ্ধ থেকে পাওয়া শিক্ষা ও আত্মবিশ্বাস কাজে লাগায় পরের মাসে সংঘটিত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌ-যুদ্ধ ‘ব্যাটল অফ মিডওয়ে’-তে। কোরাল সি যুদ্ধের কিছু অসাধারণ কমব্যাট ফুটেজ দেখুন এখানে:

Related Articles