Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বার্লিন এয়ারলিফট: স্নায়ুযুদ্ধের শুরু হয়েছিল যেভাবে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিত্র বাহিনী পরাজয় বরণ করা জার্মানিকে মোট চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে এবং এই অঞ্চল গুলো চলে যায় সোভিয়েত, মার্কিন, ফরাসী এবং ব্রিটিশদের দখলে। জার্মানির রাজধানী বার্লিনের অবস্থান ছিল সোভিয়েতদের দখলকৃত অংশের অনেক ভিতরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বার্লিনকেও আবার ভাগ করা হয় চারটি আলাদা ভাগে। রাশিয়ানরা এই ব্যাপারে খুব একটা খুশি ছিল না।

১৯৪৮ সালের জুন মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরো বার্লিনকে নিজেদের দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিমাঞ্চলে দখলকৃত বার্লিনের সমস্ত মহাসড়ক, পানিপথ এবং রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রাশিয়ানদের বিশ্বাস ছিল, এই অবরোধের কারণে বার্লিনবাসী পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ পাবে না এবং একসময় খাবারের অভাবে বিরক্ত হয়ে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের দখলদারিত্ব থেকে বের হয়ে তারা রাশিয়ার সাথে যোগ দেবে। পশ্চিম বার্লিন থেকে সরে আসার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র সহ মিত্রবাহিনী আকাশপথে খাদ্য সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়। আকাশপথে খাবার সরবরাহের এই প্রচেষ্টা ‘বার্লিন এয়ারলিফট’ নামে পরিচিত, যেটি প্রায় এক বছর সময় ধরে চলে এবং এই সময়ে পশ্চিম বার্লিনে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন টন মালামাল বহন করা হয়।

বিমান থেকে মালামাল নামানোর দৃশ্য; Source: US Air Force

বার্লিন ভাগ হয়েছিল যেভাবে

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিত্রবাহিনী ইয়াল্টা এবং পোস্টডামে শান্তিচুক্তিতে বসে। এই চুক্তি অনুসারে জার্মানিকে মোট চার ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। জার্মানির পূর্বাঞ্চলের দখলদারিত্ব পায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলের দখলদারিত্ব ভাগ করে দেওয়া হয় আমেরিকা এবং ব্রিটেনের মাঝে। ব্রিটেন এবং আমেরিকা পশ্চিমাঞ্চলের অল্প কিছু অংশ ফ্রান্সকে দিতে রাজি হয়। যদিও জার্মানির রাজধানী বার্লিনের পুরো অবস্থানই ছিল সোভিয়েত দখলদারিত্বের অংশ, কিন্তু পুরো জার্মানির মতোই বার্লিনকেও চার ভাগে ভাগ করা হয়। পশ্চিম বার্লিনের দখল পায় যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, আর পূর্বাঞ্চলের দখল পায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই শান্তিচুক্তি পরিচালনা করেছিল কমানদাতুরা নামে একটি এজেন্সি।

এই ভাগাভাগি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন দুবার জার্মান আক্রমণের স্বীকার হয়েছিল, তাই জার্মানিকে পুনর্গঠন করার কোনো ইচ্ছাই সোভিয়েতের ছিল না। অন্যদিকে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সে কার্যকলাপ ছিল তার উল্টো। জার্মানিকে পুনর্গঠন করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন তাদের দুই অঞ্চলকে একত্রিত করে ‘বিজোনিয়া’ নাম দেয় এবং পরবর্তীতে ফ্রান্সও যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাদের সাথে। ১৯৪৮ সালে তিন পশ্চিমা মিত্র মিলে তাদের দখল করা অঞ্চলগুলোর জন্য ডয়েচমার্ক নামে নতুন মুদ্রা চালু করে। সোভিয়েতরা ভয় করে, নতুন মুদ্রা চালু হওয়ার ফলে অসম্ভব মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত পূর্ব জার্মানির পুরনো মুদ্রার মান হ্রাস পাবে। পশ্চিমা মিত্রদের এই পদক্ষেপ ছিল রাশিয়ার কফিনে শেষ পেরেক মারার মতো।

বার্লিনের বাসিন্দারা অপেক্ষা করছে কার্গো বিমানের অবতরনের জন্য; Source: Walter Sanders—Time Life Pictures/Getty Images

অবরোধের শুরু

রাশিয়ানরা একটি সমন্বিত পশ্চিম বার্লিনের সম্ভাবনায় বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত অঞ্চলের মাঝে একটি সমন্বিত পুঁজিবাদী শহরের অবস্থানের সম্ভাবনা রাশিয়াকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। পশ্চিমা মিত্রদের এই একতা ঠেকাতে রাশিয়া তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের কমানদাতুরা চুক্তি থেকে সরিয়ে নেয় এবং পশ্চিম বার্লিনের উপর অবরোধ জারি করে। সোভিয়েত বলে যে, পশ্চিম জার্মানি যদি একটি দেশ হতে চায় তাহলে পূর্ব জার্মানির ১০০ মাইল ভিতরে অবস্থিত বার্লিন কোনোভাবেই তার রাজধানী হতে পারবে না।

১৯৪৮ সালে জুনের ১৫ তারিখ পশ্চিম বার্লিনের সাথে পশ্চিম জার্মানির যোগাযোগের একমাত্র স্থল মাধ্যম মহাসড়কটি সংস্কারের নাম করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। একইসাথে রেল যোগাযোগ এবং খালগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর বার্লিন ছেড়ে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। মার্কিন সামরিক প্রধান বলেন, “বার্লিন ছাড়লে ইউরোপে আমাদের অবস্থান হুমকির মুখে পড়বে আর কমিনিউজম পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়বে।” প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুম্যানও গলা মিলিয়ে একই সুরে বলেন, “আমরা অবশ্যই বার্লিনে অবস্থান করবো, কথা এখানেই শেষ”। সে অবস্থায় সোভিয়েতের অবরোধের বিপরীতে মিলিটারি আক্রমণ করাও ভাল পন্থা হবে না। আর সোভিয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ নিউক্লিয়ার যুদ্ধে রূপ নেওয়ারও ভয় আছে। তাই অবরোধ সমস্যার সমাধানের নতুন পন্থা খুঁজতে থাকে পশ্চিমা মিত্রবাহিনী।

একটি C-54 বিমান নামছে বার্লিন টেম্পেলএইচপি এয়ারপোর্টে; Source: US Air Force

এয়ারলিফটের শুরু

অবরোধ শুরু হলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সামনে দুটি পথ খোলা আছে তখন- হয় বার্লিন থেকে সরে আসা অথবা যুদ্ধ ঘোষণা। কিন্তু ট্রুম্যানের মাথায় আরেকটি বুদ্ধি আসলো। অবরোধ শুরু হওয়ার কিছু মাস আগে রাশিয়া একবার বার্লিনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন মিত্রবাহিনী বিমান দিয়েই তাদের সৈন্যবাহিনী বার্লিনে পাঠিয়েছিল। ট্রুম্যান মার্কিন জেনারেলদেরকে ডেকে বললেন, একইভাবে পুরো বার্লিনে খাবার সরবরাহ করা যাবে কিনা। বিমানে করে পাঠালে রাশিয়ানরা সেটিকে বাধা দিতে পারবে না। কারণ, বিমান থামানোর একটিই উপায়, সেটি হচ্ছে বিমানে গুলি করা। আর গুলি করলে সেটি যুদ্ধ ঘোষণার মধ্যেই পড়ে। কিন্তু মার্কিন জেনারেলরা এই আইডিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে অসম্ভব কাজ বলে অভিহিত করে। অন্যদিকে ব্রিটিশ নেভি বলে যে, তারা এটি করতে পারবে। তারা হিসেব করে বের করে যে, বার্লিনকে পতনের হাত থেকে বাঁচাতে প্রতিদিন ৪,০০০ টন খাবার এবং জ্বালানির দরকার হবে। আর তখনকার ছোট C-47 বিমানগুলোতে এই পরিমাণ মালামাল বহন করতে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১,৩০০টি ফ্লাইটের দরকার হবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই এই পরিমাণ মালামাল বহনের ক্ষমতা ছিল। ট্রুম্যানের চাপের মুখে মার্কিন জেনারেলরা চেষ্টা করতে সম্মত হয়।

জুনের ২৬ তারিখে এয়ারলিফটের প্রথম ফ্লাইট শুরু হয়। যদিও রাশিয়ানরা গুলি করে প্লেন নামানোর হুমকি দেয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত এন্টি-প্লেন বন্দুকগুলো নীরবই থাকে। ফ্লাইট ভালোভাবে বার্লিনে পৌঁছালেও যুক্তরাষ্ট্রের তখন একসাথে এতগুলো প্লেন ছিলো না, আবার বিমান কর্মীও যথেষ্ট ছিল না। সাহায্যের জন্য সুদূর গুয়াম থেকেও বিমান ডেকে আনা হয়, কিন্তু তা-ও যথেষ্ট ছিল না। প্রথম দুই সপ্তাহে মিত্রবাহিনী প্রতিদিন শুধুমাত্র ১,০০০ টন খাবার সরবরাহ করতে সক্ষম হয়, যেটি ছিল চাহিদার তুলনায় মাত্র চার ভাগের এক ভাগ।

মালামাল নামানো হচ্ছে বিমান থেকে; Source: Wikimedia Commons

আমেরিকান বিমান যেখান থেকে উড্ডয়ন করছিল সেটি ছিল একটি ঘাসের মাঠ। বিমান উঠানামার মাঝের সময়েই এটিকে বারবার ঠিক করতে হতো। বিমানগুলো যেখানে নামছিল, তার সামনে ছিল বিশাল বড় এক এপার্টমেন্ট, যেটি ছিল বিমানের ল্যান্ড গিয়ারের মাত্র ১৭ ফুট নিচে। অন্যদিকে জ্বালানি কাজের ব্যবহারের জন্য বিমানগুলি পূর্ণ ছিল কয়লা আর ফুলের শুকনা গুড়ো দিয়ে, যেগুলো ছিল খুবই দাহ্য পদার্থ। আবার সোভিয়েত সৈন্যরা সব সময় বিমানের দিকে বন্দুক তাক করতে রাখত বিমানের পাইলটকে চাপে রাখার জন্য। সবমিলিয়ে দিনশেষে বিমানকর্মী এবং বিমানগুলো পরিশ্রান্ত হয়ে যেত।

যদিও বিমানগুলো পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করতে পারছিল না, কিন্তু পাইলটদের এই সাহসিকতা সবার মাঝে নিয়ে এসেছিল এক উত্তেজনা। পুরো ইউরোপবাসী যুদ্ধের দুঃখ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বার্লিনকে উপবাসের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। বার্লিনের লোকেরা যে পাইলটদেরকে ঘৃণা করত তাদের শহরে বোমা ফেলার জন্য, তারাই পাইলটদের বিয়ার দিয়ে তৃষ্ণা মেটাল।

অবস্থার উন্নতি ঘটাতে ওয়াশিংটন জার্মানিতে ডেকে পাঠাল জেনারেল উইলিয়াম টার্নারকে, যিনি বিখ্যাত ছিলেন যুদ্ধে তার কৌশল প্রয়োগের জন্য। জেনারেল টার্নার হিমালয়ের উপর দিয়ে এর আগে সুদূর চীনে মালামাল পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তার খ্যাতি ছিল পুরো আমেরিকা জুড়েই।

উইলিয়াম এসেই প্রথমে একটি সময়সূচী ঠিক করলেন। প্রতি তিন মিনিট বিরতিতে বিমান উঠানামা করবে আর আকাশে বিমান উড়বে ৫টি ভিন্ন ভিন্ন পথে, যাতে করে বেশি বিমান একসাথে চলাচল করতে পারে। ছোট C-47 বিমানের পরিবর্তে আনা হলো বড় কার্গো বিমান আর মালামাল এবং রানওয়ে ঠিক করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হল জার্মানির স্থানীয় লোকজনকে। নতুন বিমান ইঞ্জিনিয়ারদের ডেকে আনা হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে এবং বিমান রক্ষণাবেক্ষণের বইকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জার্মান ইঞ্জিনিয়ারদেরও নিয়োগ দেয়া হল। মাত্র ৩ বছর আগেই যারা একে অপরের দিকে গুলি ছুঁড়ছিল, তারাই একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ শুরু করল।

ফলাফলও আসল কিছুদিনের মাঝেই, আগস্টের ১২ তারিখে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র বার্লিনে তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করতে সক্ষম হলো। সেদিন মোট ৪,৫০০ টন খাবার এবং জ্বালানি সরবরাহ পেয়েছিল জার্মানবাসী।

অবরোধ শেষ হওয়ার রাস্তায় নেমে আসে বার্লিনের মানুষ; Source: Getty Images

অবরোধের সমাপ্তি

পরবর্তীতে শীত আসলে প্রথমে কিছুটা সমস্যা হলেও উইলিয়াম টার্নারের কৌশল আর বিমানকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে খাবার সরবরাহ অব্যাহত থাকে। বার্লিনবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলার যে কৌশল সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়েছিল, সেটি পুরোপুরি ভেস্তে যায়। উল্টো মানবিক কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশংসা কুড়াতে থাকে বিশ্বব্যাপী।

১৯৪৯ সালের শেষের দিকে এটি পরিস্কার হয়ে যায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পনা কোনো কাজে আসেনি। তারা বার্লিনবাসীকে পশ্চিমা মিত্রদের বিপক্ষে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারেনি এবং অপরদিকে পশ্চিম জার্মানির এক হওয়াও বন্ধ করতে পারেনি। ১৯৪৯ সালের মে মাসের ১২ তারিখে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অবরোধ তুলে নেয় আর মহাসড়ক, রেল এবং পানিপথ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। তারপরেও মিত্রবাহিনীর কার্গো বিমান চলতে থাকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, যদি রাশিয়া আবার অবরোধ দিয়ে দেয় এই ভয়ে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবরোধে রাশিয়ানদের দীর্ঘমেয়াদী অনেক ক্ষতি হয়েছে। পুরো বিশ্ব সোভিয়েতকে নিষ্ঠুর হিসেবে আখ্যায়িত করে আর বাকি ইউরোপ রাশিয়ার বিপক্ষে একজোট হয়ে যায়। সেখানে থেকে সৃষ্টি হয় ন্যাটো (NATO), যেটির কার্যক্রম আজও অব্যাহত রয়েছে।

ফিচার ফটো: nicolasbouliane.com

Related Articles