Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভাসানী যখন ইউরোপে: পাকিস্তানে দুবার নিষিদ্ধ এক বইয়ের কথা

মওলানা ভাসানীর আজীবন সাথী একটি মাত্র স্যুটকেস। দৈর্ঘ্য ষোল ইঞ্চি। সম্পদ বলতে তার মধ্যে থাকে একটি গামছা, একটি লুঙ্গি, একটি খদ্দরের পাঞ্জাবি, মাথার একটি টুপি, কিছুটা তামাক পাতা আর চুনের একটা ডিবা। এ নিয়েই তিনি পূর্ব বাংলার শহরে-গ্রামে সফর করেন এবং এই নিয়েই তিনি গেছেন ইউরোপ সফরে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের সমূলে উৎপাটন করে ক্ষমতায় আসে যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের তিন কাণ্ডারি হিসেবে পরিচিত ছিলেন মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেরে বাংলা হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আর লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে মওলানা ভাসানী গেলেন ইউরোপে, বার্লিনে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতির চেয়ারে বসতে হবে এই দাওয়াত পেয়ে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনের যুক্তফ্রন্টের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন মওলানা ভাসানী; Image source: www.thedailystar.net

ইউরোপে ভাসানীর সল্প সময়ের যাত্রার ঘটনাবহুল দিনগুলো নিয়ে লেখা বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’। পাকিস্তানে গণতন্ত্র আর সুশাসনের নামে দেশটি যে কতিপয় ব্যক্তির মুনাফা উপার্জনের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে এই বিষয়টিই এই বইয়ের মুখ্য বিষয়। সারা বইজুড়ে পাকিস্তানের তৎকালীন সরকারের স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। ইলিয়াস ছিলেন ইউরোপে ভাসানীর সফরসঙ্গী। তাই ইউরোপের দিনগুলোতে ভাসানীকে কাছে থেকে দেখা, তার দর্শন আর পাকিস্তান নিয়ে তার চিন্তাই হয়ে উঠেছে এই বইয়ের উপজীব্য।

দুবার নিষিদ্ধ হয়েছে এই বই;  Image source: www.prothoma.com

এই বইকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার দুবার নিষিদ্ধ করে। আইয়ুব খানের সময় ১৯৫৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের জন্য লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে জরিমানাসহ সাজা দেয়। ১৯৬৫ সালে আবার নিষিদ্ধ করা হয় এই বই। কিন্তু কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে বইয়ের মূল উপজীব্য নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

বইয়ের মূল উপজীব্য 

সাতচল্লিশে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সরকার চেয়েছিলেন ভাসানী। যেখানে তার দেশের কৃষক, শ্রমিক আর মজুরেরা দুইবেলা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতা আর দেশের সব সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে থাকে দেশের ধনীদের হাতে, ইংরেজদের রেখে যাওয়া প্রভুত্বের চাবুক হাতে নিয়ে শোষণ শুরু হয় সাধারণ মানুষের উপর। পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে তোলা হয় অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। এর প্রতিবাদে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে গণজাগরণের নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী। পাকিস্তানের ক্ষমতা আকড়ে থাকা মুসলিম লিগ নেতাদের চোখে ভীষণ অপরাধ করেছেন ভাসানী। তাই পাকিস্তানের ঝাণ্ডাধারীরা তাই প্রভাব খাটিয়ে ইউরোপের যাত্রার পথে পথে এই নেতাকে হেনস্থা করার শপথ নিলেন, তার এনং তার সহযাত্রীদের উপর নজরদারী করার জন্য নিয়োগ করা হয় গোয়েন্দা। ইউরোপের দূতাবাসগুলোতেও পৌঁছে যায় সংকেত, আটঘাট বেঁধে তারাও নেমে যায় কাজে।

লন্ডনে পৌঁছেও তাই দূতাবাস থেকে কোনো সহায়তা পেলেন না, বরং তারা যেন প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলেন সহায়তা করবেন না বলে। পূর্ব বাংলার নদী-নালা আর সরল সহজ মানুষ থেকে অনেকদূরে ইউরোপের অচেনা দেশে হুট করেই তার দেখা হয়ে যায় পরিচিতদের সাথে। শ্রমিক নেতা আফতাব আলী তাকে নিয়ে যান তসদ্দক আহমদের কাছে। তসদ্দক আহমদের মাধ্যমে মওলানা ভাসানীর লন্ডনে আসার খবর ছড়িয়ে যায় চারদিকে।

ভাসানী বাংলার সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল ছিলেন এই জননেতা; Image source: Saiq’a Chowdhury

জার্মানির ভিসা পাওয়া গেল না, তবে লন্ডন থেকে তার লিখিত বক্তৃতা পাঠানো হলো শান্তি সম্মেলনে। লন্ডন আসার পর চারদিক থেকে অসংখ্য দাওয়াত আসা শুরু হয়েছিল, সবাই ভাসানীর সাথে কথা বলতে চায়, দেশের অবস্থা জানতে চায়। মওলানা ভাসানীর পক্ষে সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

এরই মধ্যে লন্ডনে বসে ভাসানী খবর পেলেন চক্রান্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভাসানী লন্ডনে বসেই সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন, নানা দেশের সাংবাদিকেরা ভাসানীর কাছে প্রশ্নবাণ ছুঁড়লেন। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই ক্ষমতা পশ্চিমে কেন্দ্রীভূত করে রাখার যে প্রবণতা সেটিই তুলে ধরলেন তিনি সারা বিশ্বের সামনে। পাশাপাশি পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাঙালীর চাওয়া-পাওয়া কী তা-ও তুলে ধরলেন। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের মানুষকে পূর্ব পাকিস্তানের দাবী দাওয়া নিয়ে ভুল বোঝানোর প্রবণতাকে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির সাথেই তুলনা দিয়েছিলেন ভাসানী। পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক আর ভৌগলিক দূরত্ব আছে। এটি কাটিয়ে যাতে সাধারণ মানুষ একত্র হয়ে যাতে অল্প কিছু ক্ষমতাবানের গদি নড়াতে না পারে সেই ব্যাপারটিকে প্রথম তিনিই সামনে তুলে ধরেন।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা; Image source: study-research.net

পাকিস্তানে শুরু হয়েছে ধরপাকড়, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়ে রাখা হয়। মওলানা ভাসানী তখন দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন। কিন্তু বাকি সবাই তাকে যেতে বারবার নিষেধ করছেন। বাংলার মানুষের পক্ষে যে ন্যূনতম আওয়াজটি ছিল, দেশে গেলে সেটিও বন্ধ করে দিবে পাকিস্তান সরকার। তারপরেও তিনি দেশে যাবেন বলে সবকিছু যখন ঠিকঠাক করছেন তখনই সোহরাওয়ার্দীর বার্তা। জুরিখের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সোহরাওয়ার্দী, তিনি সুস্থ হয়ে ভাসানীর সাথে দেখা করতে না আসা পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করেন সেই অনুরোধ জানালেন ভাসানীকে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী; Image source: commons.wikimedia.org

গভর্নর গোলাম মোহাম্মদ আর কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার চক্রান্তের জাল বিছানো ছিল হাসপাতাল পর্যন্ত। সেখানে সোহরাওয়ার্দীকে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল তাদের অধীনে মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে। সুস্থ হয়ে সোহরাওয়ার্দী এসেছিলেন ভাসানীর সাথে পরামর্শ করতে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-ভরসা ধুলিস্যাত করে সোহরাওয়ার্দী চাইলেন আইনমন্ত্রী হতে। সেখানে গিয়ে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করে দেশকে পথে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু মওলানার দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। মন্ত্রীসভায় যোগ দিলে একদিকে তার সংগঠন আওয়ামী লিগকে উপেক্ষা করা হবে, অন্যদিকে মুসলিম লিগ চক্রের ফাঁদে জড়িয়ে যাবেন। ভাসানী ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, ব্যবহার করে সোহরাওয়ার্দীকে ছুঁড়ে ফেলতেও দ্বিধা করবে না তারা।

দেশে গিয়ে সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রীর পদ নিলেন, আওয়ামী লিগকে বাঁচাতে তাই দেশে ফিরে যেত হল ভাসানীকে। যাওয়ার আগে ইউরোপে ছড়িয়ে গেছেন শান্তির বাণী, যেখানেই গেছেন মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপজুড়ে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে দার্শনিক আর জ্ঞানী গুণী মানুষদের সাথে আলোচনা করেছেন।

দেশে তাকে প্রকাশ্য গুলি করে হত্যা করা হবে এমন হুমকি ধামকিও পাকিস্তানের খবরের কাগজে প্রকাশ পেয়েছিল। খ্যাতনামা ব্রিটিশ আর ফরাসি আইনজীবীরা অনুরোধ করেন জীবননাশের এই প্রকাশ্য হুমকির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য। কিন্তু মওলানা ভাসানীর পাকিস্তানের প্রশাসনের দৌড় জানা ছিল, দেশের মাটিতে তাকে জেলে বন্দী করে রাখা যেতে পারে, হেনস্থা করা যেতে পারে, তাকে হত্যা করা হবে এই ব্যাপারটি যে অবাস্তব তিনি তা জানতেন।

দেশের ফেরার আগে লেবার পার্টির সম্মেলনে বিশেষ অথিতি হিসেবে যোগ দিলেন, সেখানে পেলেন অভূতপূর্ব সম্মান। পুরো ব্রিটেনের যেখানেই গেছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পেয়েছেন শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। অন্যদিকে দেশে চলছে মানুষের বাকস্বাধীনতার উপরে আঘাত। ভাসানীর হাতে গড়া পত্রিকা ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকা বন্ধের সরকারি আদেশ। মনে আঘাত নিয়ে ভাসানী সিদ্ধান্ত নিলেন বিদেশের মাটিতে আর নয়, দেশে ফিরে গিয়ে আওয়ামী লিগের হাল, দেশের রাজনীতির লাঙ্গল জোয়ালটি আবার তার কাঁধেই তুলে নিতে হবে।

তবে নিষিদ্ধ কেন ঘোষণা করা হয়েছিল?

আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা সামরিক সরকার নিজেদের ছায়া দেখেও মাঝেমধ্যেই পিলে চমকে যেত। রাজনীতি সচেতন মানুষের মত প্রকাশের যত মাধ্যম আছে সব একে একে দখল করে নেওয়ার এক জঘন্য পাঁয়তারা শুরু হয়েছিল তখন দেশজুড়ে। পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ বইটি পৌঁছে গেলে মানুষ এই শাসকদের ছলাকলা ধরে ফেলতে সক্ষম হবে মনে করেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এই বইটি।

ভাসানীর লন্ডনে থাকাকালীন সময়েই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভাকে কমিউনিস্ট, ভারতের দালাল ইত্যাদি নানা উপায়ে দোষারোপ করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে এক নোংরা রাজনীতির সূত্রপাত হয় পাকিস্তানে। সেগুলোর যে ভিত্তি নেই বরং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে দেশ চালাতেই হক সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে এই ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন ভাসানী, সারা বিশ্বেও সেটিই প্রচার করেছেন তিনি। 

পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে তৎকালীন অনেক নেতার মুখোশ খুলে দেওয়া হয়েছিল এই বইয়ে। আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর দালালীর বিবরণও পাওয়া যাবে সবিস্তারে। পশ্চিম পাকিস্তানি অনেক নেতার পাশাপাশি বাঙালী নেতা মোহাম্মদ আলী বগুড়া কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরও কম সমালোচনা করা হয়নি বইয়ে, তাই স্বভাবতই সামরিক সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতাশালী অনেকেই চায়নি এই তথ্যগুলো মানুষের সামনে চলে আসুক।

‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ বইয়ের লেখক, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস; Image source: goodreads.com

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সংগ্রাম যে তাদের উপর শোষণের কারণে শুরু হয়েছে, এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে সর্বপ্রথম কথা শুরু করেছিলেন ভাসানী। এই বইয়ে সেই বিষয়গুলোও বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। তাই এই বইয়ের অনুবাদও ছিল বিপজ্জনক। কারণ এটি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিলে বাংলার আপামর জনসাধারণের প্রতি জনমত তৈরি হওয়া শুরু হবে, এমন শঙ্কা থেকেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’, এর লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে শাস্তিও দেওয়া হয়।

This article is about Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani's Europe tour and the fall of 1954 United Front cabinet. This article also contain a review of Book named  in Bangla 'Bhasani Jokhon Europe e'.

তথ্যসূত্র: ভাসানী যখন ইউরোপে; খোন্দকার ইলিয়াস মোহাম্মদ; প্রথমা প্রকাশন

Featured Image Source: thedailystar.net

Related Articles