Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে দামী ৬ গুপ্তধন

গুপ্তধন কথাটি শুনলে মনে হয় শুধুমাত্র গল্পের মাঝেই এর অস্তিত্ব রয়েছে। অথচ কালের পরিক্রমায় অনেক মূল্যবান জিনিস হারিয়ে গেছে অথবা সমাহিত আছে ভূপৃষ্ঠের নীচে। একদিন হঠাৎ করে কোনো গুপ্তধনের মানচিত্র খুঁজে পাবো আর ইন্ডিয়ানা জোন্স বা ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর মতো অভিযানে যাবো- এই স্বপ্ন কিশোর বয়সে আমাদের সবার মাঝেই কম বেশি ছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এমন কিছু গুপ্তধন আধুনিক যুগে খুঁজে পাওয়া গেছে যা বহন করে ইতিহাসের সাক্ষী, ইতিহাসের পাশাপাশি তাদের মূল্য নেহায়েত কম নয়।

১) ইংল্যান্ডের কিউয়ারডেলে খুঁজে পাওয়া ভাইকিংদের সম্পদ

সময়কাল ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ। রিবেল নদীর তীরে ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ নির্মাণের সময় একদল শ্রমিক হঠাৎ একটি সীসার তৈরি বাক্স খুঁজে পায়। বাক্সটি খুলে তারা হতবাক। এই মামুলি চেহারার বাক্সে তারা খুঁজে পায় প্রায় ৮,৬০০ পদের নানান জিনিসপত্র, যার মধ্যে ছিল রূপার গয়না, মুদ্রা সহ রূপার নানা তৈজসপত্র। এটি ছিল ভাইকিং রাজ্যের চিহ্ন বহনকারী সবচেয়ে বড় রত্ন ভাণ্ডার। এই ভাণ্ডারে খুঁজে পাওয়া রত্ন সব যে ভাইকিংদের ছিল তা নয়, এর মধ্যে এমন অনেক জিনিসও খুঁজে পাওয়া গেছে যার সাথে অতীতের স্ক্যান্ডিনেভিয়া, ইতালি এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের যোগসূত্র আছে বলে ধারণা করা হয়। শেষপর্যন্ত এই গুপ্তধন রানী ভিক্টোরিয়াকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় যার কিছু অংশ এখনও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে। তবে যারা এই ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছিল তারাও কিন্তু খালি হাতে ফেরেনি, একটি দুটি মুদ্রা তারা নিজেরাও রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। মূল্য আনুমানিক ৩.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

কিউয়ারডেলে খুঁজে পাওয়া সম্পদ; source: worldhistory.biz

২) ভেনাস ডি মিলো

বাহুহীন এই বিখ্যাত পাথরের মূর্তিটি প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল কালের অতল গহ্বরে। ভেনাস ডি মিলো প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্যের অন্যতম বিখ্যাত রচনাগুলোর একটি। ১৩০ এবং ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝে নির্মিত হয়েছিল এই মূর্তিটি। গ্রীকদের চোখে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতিকে চিত্রিত করে ভেনাস। ১৮২০ সালের ৮ এপ্রিল যোরগস কেন্ট্রটাস নামক ব্যক্তি মিলো দ্বীপের (বর্তমান ত্রিপিতি গ্রামে) ধ্বংসস্তূপে মূর্তিটি খুঁজে পান। পরবর্তীতে অষ্টাদশ লুইসকে উপহার হিসেবে দেওয়া হলে তিনি মূর্তিটির তাৎপর্য বুঝতে পারেন এবং ১৮২১ সালে ল্যুভর মিউজিয়ামে মূর্তিটি দান করেন।

মূর্তিটি এখনও ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামে রাখা আছে দর্শনার্থীদের জন্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ভেনাসের ছিন্ন বাহুর দেখা মেলেনি। অনেকে আবার ধারণা করেন মূর্তিটি যেহেতু মিলো দ্বীপে পাওয়া গেছে, তাই হয়তো ভেনাস আফ্রোদিতি নয় বরং সমুদ্রের দেবী এম্ফ্রিটাইট হচ্ছে তার আসল পরিচয়। এটির মূল্যমান কোথাও কোথাও ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু এমন অসাধারণ শিল্পকর্মকে শুধু অর্থ দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। এর সাথে জড়িত আছে ইতিহাসের নানান অধ্যায়।

ভেনাস ডি মিলো; Image Source: theartist.me

১৭৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর সম্রাট নেপোলিয়ন শিল্পকলার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। ইতালি থেকে তার অভিযানের সময় লুণ্ঠন করেন ‘ভেনাস ডি মেদিচি’ নামক অপর একটি মূর্তি। কিন্তু ১৮১৫ সালে ওয়াটার লু’র যুদ্ধে তিনি পরাজিত হলে নির্বাসনে পাঠানো হয় তাকে এবং ফ্রান্স ভেনাস ডি মেদিচিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে মেদিচিকে হারানোর ব্যাপারটি তাদের জন্য ছিল লজ্জার। তাই পরে যখন ভেনাস ডি মিলোকে খুঁজে পাওয়া যায়, তখন জাতীয় অপমান ঘোচানোর জন্য এই মূর্তিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে ফরাসিরা। ভেনাস ডি মিলোকে তার ল্যুভর অভিষেকের পরে এই সুযোগটিকে তারা খুব ভালোভাবেই কাজে লাগায় এবং ভেনাস ডি মিলোকে মেদিচির চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং মূল্যবান বলে প্রচার করতে থাকে। ফরাসিরা প্রচারণার ব্যাপারে সবসময়ই এগিয়ে। তাই এই প্রচারণাও বৃথা যায়নি। বরং পৃথিবীর অন্যতম সেরা শিল্পকর্ম হিসেবে ভেনাসকে আখ্যা দিয়েছে অনেক গুণী শিল্পী।

৩) রোমানদের প্রাচীন শহর পম্পেই

ইতালির নেপলস শহরের কাছে অবস্থিত হাজার বছরের পুরানো ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। ভিসুভিয়াসের সবচেয়ে বিখ্যাত অগ্নুৎপাত হয়েছিল ৭৯ খ্রিস্টপূর্বে। ভিসুভিয়াসের আগুনে পম্পেই শহরটি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। প্রায় ২,০০০ মানুষ মারা যায় এবং শহরটি বছরের পর বছর পরিত্যক্ত ছিল। পম্পেই ধ্বংসের ইতিহাস জানা যায় প্লিনি নামক এক ব্যক্তির লেখা এক চিঠি থেকে যেখানে তিনি তুলে ধরেন কীভাবে তার চাচা পম্পেই নগরীর মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারান।

শিল্পীর চোখে ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত; source: nationalgeographic.com

অগ্ন্যুৎপাতের ঠিক ১,৫০০ বছর পর প্রাথমিকভাবে আবিষ্কৃত হয় এই নগরী। কিন্তু ১৭৪৮ সালে একদল অনুসন্ধানকারী পুনরায় খুঁজে পায় পম্পেই নগরীকে। ধুলার এক পুরু আস্তরণের নিচে হাজার বছর ধরে প্রায় অক্ষত ছিল পম্পেই। ধূলা-বালির নিচে চাপা পড়ে থাকা ভবন, হস্তনির্মিত বস্তু ও খুঁজে পাওয়া অধিবাসীদের কঙ্কালগুলো প্রাচীনকালের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে।

পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ; source: nationalgeographic.com

প্রায় ২৫০ বছর ধরে পম্পেই পৃথিবীর অন্যতম ভ্রমণতীর্থ এবং ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ ইতালি ঘুরতে যায় পম্পেই নগরীকে কাছ থেকে দেখার জন্য।

৪) ইসরায়েলে কায়সায়েরা ন্যাশনাল পার্কে খুঁজে পাওয়া স্বর্ণমুদ্রা

কয়েকজন স্কুবা ডুবুরি যখন এই পার্কের কাছে সমুদ্রপৃষ্ঠ নিয়ে গবেষণা করছিল তখন তাদের মধ্যে একজন একটি স্বর্ণমুদ্রা খুঁজে পায়। প্রথমে মনে করেছিল হয়তো কোনো শিশুর খেলার সামগ্রী হবে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন গায়ে খোদাই করা চিহ্ন খুঁজে পায় তখন বুঝতে পারেন এই মুদ্রা মামুলি কিছু নয়, বরং নিশ্চয়ই কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। পরবর্তীতে খবর পেয়ে ইসরায়েলের পুরাতত্ত্ব কর্তৃপক্ষ এসে মেটাল ডিটেক্টর বা ধাতু শনাক্তকারী যন্ত্র দিয়ে প্রায় ২,০০০ মুদ্রা খুঁজে পায়। মুদ্রাগুলো ঠিক কোন সময়কালের তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তবে ধারণা করা হয় এগুলো ১০ থেকে ১২ শতকের মাঝে তৈরি করা হয়েছিল।

কায়সায়েরায় খুঁজে পাওয়া স্বর্ণমুদ্রা; source: nationalgeographic.com

৫) পোল্যান্ডের স্রোদা লাস্কায় (Środa Śląska) খুঁজে পাওয়া ধন-রত্ন

১৮৮৫ সালে পোল্যান্ডের স্রোদা লাস্কায় একটি ভবন মেরামতের সময় একটি কলস উদ্ধার করা হয় যার ভিতরে পাওয়া যায় ১৪ শতকের বেশ কিছু রৌপ্যমুদ্রা। কয়েক বছর পড়ে যখন পাশের আরেকটি ভবনে কাজ ধরা হয় তখন প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা খুঁজে পাওয়া যায় যার মধ্যে ড্রাগনের মাথা খচিত একটি আংটিও ছিল।

৬) তিল্লা টিপে খুঁজে পাওয়া জাঁকজমকপূর্ণ ধনভাণ্ডার

তিল্লা টিপ বা তিলা তপা (আক্ষরিকভাবে ‘গোল্ডেন হিল’ বা ‘গোল্ডেন মাউনটেন’) উত্তর আফগানিস্তান প্রদেশের জোজজানের শাবানগানের নিকট একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত-আফগান কর্তৃক যখন জায়গাটি খনন করা হয় তখন সোনা, রূপা, আইভরি দিয়ে তৈরি প্রায় ২০,৬০০ অলংকার, কয়েন এবং নানা ধরনের জিনিসপত্র সংগ্রহ করা হয়, যা ৬টি সমাধি (৫টি মহিলার ও এক পুরুষের) থেকে পাওয়া যায়। সোভিয়েত আগ্রাসনের ঠিক এক বছর আগে ১৯৭৮ সালে এই রত্ন ভাণ্ডারটি খনন করা হয়। এই খনন কাজটি পরিচালনা করেছিলেন বিশিষ্ট গ্রীক-রাশিয়ান বংশোদ্ভূত প্রত্নতত্ত্ববিদ ভিক্টর সারিয়ান্দি।

তার মতে, সমাধিতে পাওয়া লাশগুলো এশিয়ান বেদুইনদের। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের দিকে ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল ছিল চীন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মাঝে এবং এই অঞ্চল ব্যবহার করে বহু ব্যবসায়ী, সুফী-সাধকেরা নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তিনি বলেন- খুঁজে পাওয়া এই সমাধিগুলো ২য় খ্রিস্টপূর্বেরই হবে। ৫ জন মহিলার সমাধির মধ্যে একজনের সমাধিতে একটি মুকুট পাওয়া যায়, সাথে পাওয়া অন্যান্য জিনিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি রোমান মুদ্রা যাতে রাজা টিবেরিয়াসের মাথা খচিত ছিল এবং অপর একটিতে খচিত ছিল গৌতম বুদ্ধের কাল্পনিক মূর্তি।

source: balkhandshambhala.blogspot.com

১৯৮৮ সালে সোভিয়েতদের আফগানিস্তান থেকে উৎখাতের পর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যাকট্রিয়ার স্বর্ণমুদ্রা আফগানিস্তানের জাতীয় জাদুঘরে নিরাপদ নয়। তাই তিনি এই ভাণ্ডার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। পরে ১৯৯৩ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলাকালে মিসাইল এসে আঘাত হানে মিউজিয়ামে এবং সেই সময় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যাকট্রিয়ার সম্পদ লুটপাট হয়ে যায়। যদিও আশার ব্যাপার, পরে ২০০৩ সালে দেশটির নতুন সরকার ঘোষণা দেয় ব্যাকট্রিয়ার সম্পদ এখনও নিরাপদ এবং অক্ষত আছে এবং এতদিন তা সেন্ট্রাল ব্যাংকের কোষাগারে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

পরবর্তীতে কাবুলের নতুন জাদুঘরে তা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তবে দীর্ঘদিনের চলা যুদ্ধে লাখ লাখ প্রাণ হারানো আফগানিস্তান দেশটির জন্য এই অমূল্য রত্নভান্ডার অক্ষত থাকার ঘটনাটি জনগণের জন্য কতখানিই বা সুখকর হতে পারে?

ফিচার ইমেজঃ thebaconstation.com

Related Articles