Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্ল্যাক ডালিয়া হত্যাকাণ্ড: যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া জাগানো অমীমাংসিত এক রহস্য

সবেমাত্র বছর দুই হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমেরিকার মানুষ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। ঝড়ের পরে সবকিছু যেমন শান্ত, নিস্তরঙ্গ থাকে, তখন নিত্যদিনের জীবনও সেভাবে চলছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ জানুয়ারিতে ঘটা এক হত্যাকাণ্ড পুরো আমেরিকাকে যেন নাড়িয়ে দিল। এটি পরবর্তীতে ঐতিহাসিকদের কাছে স্বীকৃত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে সাড়া জাগানো অপরাধ হিসেবে, যার রহস্যভেদ আজ অবধি করা যায়নি পুরোপুরিভাবে।

যখন তিনি লস এঞ্জেলসের সোয়াঙ্কি বাল্টিমোর হোটেলে উঠেছিলেন খুব অল্প কয়েক জন মানুষই খেয়াল করেছিল কালো কোঁকড়া চুলের এই রমণীকে। কিন্তু তার প্রাণহীন ধড়খানা যখন মাঠের মধ্যে পাওয়া গেল তখন তিনি পুরো দেশের ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে উঠলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সকালবেলা বেটি বারসিঙ্গার নামের এক মহিলা তার ছোট মেয়েকে নিয়ে লেইমার্ক পার্কে হাঁটতে বেরোলে মাঠের মধ্যে দু’খণ্ড অবস্থায় একটি ম্যানিকুইন দেখতে পান।

কিছুক্ষণ খেয়াল করে দেখার পর ভদ্রমহিলা টের পেলেন যে এটি আসলে কোনো ম্যানিকুইন নয়। একটি খণ্ডিত লাশ! মারাত্মকভাবে চমকে গিয়ে ত্বরিৎ পুলিশকে ফোন দেন তিনি। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠায়। তারপর জানা গেল মৃত ব্যক্তি এক তরুণী যার দেহ কোমর থেকে দুই খণ্ড করে কেটে ফেলা হয়েছে। ফেলে দেওয়ার আগে শরীরের সমস্ত রক্ত বের করে খালি করা হয়। বেশ কিছু অঙ্গ সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং শরীরের নাড়িভূঁড়ি বের করে ফেলা হয়েছে। মাঠে ফেলে যাওয়ার আগে মেয়েটির শরীর ভালোভাবে ধুয়ে পরিস্কার করা হয়েছে। আরো একটা ব্যাপার হলো মেয়েটির ঠোঁটের পাশ থেকে কান অবধি দু’দিকেই কেটে ফেলা হয়েছে। একে ‘Glasgow Smile’ বলা হয়। ব্যাটম্যান সিনেমার জোকারের যেমন কাটা ছিল তেমন।

এলিজাবেথের দ্বিখন্ডিত লাশ, পুলিশ এসে পরে লাশ ঢেকে দেয়; Source: Getty

এলিজাবেথের গালের দু’পাশ কেটে ফেলা হয়, যা ‘Glasgow Smile’ নামে পরিচিত; Source: FBI

বিদঘুটে এই হত্যাকাণ্ডের পর স্বভাবতই মিডিয়ায় শুরু হয় হইচই। লস এঞ্জেলস পুলিশের সাবেক সার্জেন্ট এবং ঐতিহাসিক গ্লেন মার্টিনের মতে, “খুনটি ছিল নৃশংস এবং ধর্মীয় আচার পালনের মতো কিছু সূক্ষ্ম বিষয়ে ভরা।” সব মিলিয়ে প্রায় জনা পঞ্চাশেক সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, নারী পুরুষ মিলিয়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার স্বীকারোক্তিও দেয় খুনের দায় স্বীকার করে, কিন্তু এসব স্বীকারোক্তি খুনের রহস্যের কোনো সুরাহা তো করেইনি, উপরন্তু রহস্যের জট আরো পাকিয়েছে। মার্টিনের মতে,“এই খুনের সাথে হলিউডের গ্ল্যামার জগতেরও একটি যোগসূত্র ছিল নিহত তরুণী হলিউডেই থাকতো এবং অভিনেত্রী হওয়ারও স্বপ্নও ছিল।”

কে এই ব্ল্যাক ডালিয়া?

এলিজাবেথ শর্টের ইচ্ছে ছিল হলিউড অভিনেত্রী হওয়া; Source: Louise Baranoski

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। আসল নাম এলিজাবেথ শর্ট। ‘৩০ এর দশকের অর্থনৈতিক মন্দায় তার বাবা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তিনি পরিবারকে ত্যাগ করেন। মা ও বোনদের সাথে বসবাস করতেন। স্কুলে প্রথম দিকে গেলেও পরে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে লস এঞ্জেলসের হলিউডে পাড়ি জমান অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকা এই তরুণী। প্রাথমিকভাবে তিনি রেঁস্তোরায় পরিবেশিকার চাকরি নেন। কাজের পাশাপাশি হলিউড পাড়ায় ঢুঁ মেরে রূপালী পর্দায় সামিল হওয়াই ছিল তার ইচ্ছে।

কী ঘটেছিল আসলে ?

কী যে ঘটেছিল সেটাই তো মূল সমস্যা। তবে তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ের সূত্রগুলো থেকে সম্ভাব্য ব্যাপার হিসেবে কিছু কাহিনী দাঁড় করানো যায়। এলিজাবেথকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ৯ জানুয়ারি। বাল্টিমোর হোটেলে তার প্রেমিক রবার্ট তাকে নামিয়ে দিয়ে যায়, যেখানে তিনি কয়েক দিনের জন্যে উঠেছিলেন। এই হোটেলেরই আধা মাইল দূরের এক মাঠে সপ্তাহখানেক পরে তাকে পাওয়া যায়।

জানুয়ারির ২৪ তারিখে লস এঞ্জেলস এক্সামিনার পত্রিকার সম্পাদকের কাছে একটি ফোন কল আসে, ফোনের অপর প্রান্তের কণ্ঠ জানায় যে তিনিই আসল খুনি। ‘প্রমাণ’ হিসেবে তিনি ডাকযোগে একটি খাম পাঠান যার ভেতরে ছিল এলিজাবেথের জন্ম সনদ, কার্ড, ছবি এবং মার্ক হেনসেন নামক এক ব্যক্তির ডায়েরি।

খুনী খামে ভরে এলিজাবেথের কিছু কাগজপত্র পাঠায় নিজের খুনের ‘প্রমাণ’ হিসেবে; Source: Getty

খাম ও ভেতরের জিনিসগুলো পেট্রোল দিয়ে ভালোভাবে মুছে পরিষ্কার করা ছিল, ফলে কোনো আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। পুলিশ এই মার্ক হেনসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে, তিনি এলিজাবেথকে চিনতেন এবং কিছুদিন ধরে তার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। মার্ক হেনসেন হলিউডে একটি নাইট ক্লাবের মালিক। তদন্তে জানা যায়, তিনি এলিজাবেথের কাছ থেকে কয়েকবার যৌন সঙ্গমের প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। পুলিশ প্রথমে তাকেই সন্দেহভাজন ধরে নিয়ে তদন্ত শুরু করে।

কিন্তু তদন্তে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে পুলিশ উদ্ধারকৃত ডায়েরিতে নাম আছে এমন ব্যক্তিদেরও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। পরে সব মিলিয়ে ৭৫০ জন তদন্তকারী পুরো লস এঞ্জেলস চষে ফেলে তদন্ত আর প্রমাণ সংগ্রহের এক তুঘলকি অভিযানে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল মেলেনি।

এলিজাবেথের রক্তমাখা কাপড়চোপড় পাওয়া যায় শহরের এক ড্রেনে; Source: Getty

তদন্তে এটুকুই জানা যায় যে, তাকে সম্ভবত শহর থেকে দূরের কোনো জায়গায় হত্যা করা হয়েছে। তাকে যেভাবে কেটে দু’টুকরো করা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায় খুনী সম্ভবত কোনো সার্জারি চিকিৎসক বা সার্জারি সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। এ ধারণা থেকে ঘটনাস্থলের নিকটের একটি মেডিকেল কলেজেও তল্লাশি ও মেডিকেল ছাত্রদের উপর তদন্ত করা হয়, এতেও কোনো ফল মেলেনি।

জানুয়ারির ২৬ তারিখে খুনী পত্রিকায় আরেকটি চিঠি দিয়ে আত্মসমর্পণ করবে বলে জানায়। চিঠি অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে পুলিশ অপেক্ষা করলেও খুনি আসেনি। বরং পরে আরেকটি চিঠি দিয়ে জানায় “মত বদলে ফেলেছি, ডালিয়াকে খুন করাই সঠিক ছিল।”

সম্ভাব্য খুনী নিয়ে প্রায় শতাব্দী ধরে মানুষের ঘাঁটাঘাটি

পুলিশের কাছে অসংখ্য সন্দেহভাজন তো ছিলই, এর পরে খুনিকে ধরতে পৌরসভার এক কর্তা ১০ হাজার ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করলে শুরু হয় আরেক নতুন নাটক। এরপরে অসংখ্য মানুষ থানায় এসে নিজেকে খুনী বলে দাবি করতে থাকে, যার প্রত্যেকটিই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। গত প্রায় আধা শতাব্দী ধরে অসংখ্য গবেষক, লেখক, সাংবাদিক প্রতিনিয়ত এ নিয়ে নানা ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। লেখা হয়েছে প্রচুর বই। লেখকদের মধ্যে আবার সম্ভাব্য খুনীদের সন্তানেরাও আছে।

একটি বিষয়ে তদন্তকারীরা নিশ্চিত। খুনী একজন ‘মেডিকেল ম্যান’, এর উপর ভিত্তি করে টাইম সাময়িকী একজন আর্মি করপোরালকে শীর্ষ সন্দেহভাজন বলেছে। ১৯৯১ সালে জ্যানিস নামক এক মহিলা দাবি করেন যে তার বাবা জর্জ নোল্টন ছিল ডালিয়ার খুনী, এ নিয়ে তিনি একটি বইও লিখেন। লেজলি ডিলান নামক একজন ব্যক্তি লস এঞ্জেলস পুলিশের সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিক উইলিয়ামের ছেলে দাবি করেছেন তার বাবা ডিলানকে প্রায় হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছিলেন। কিন্তু লস এঞ্জেলস পুলিশের এক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে তিনি বেঁচে যায়।

অন্যতম সন্দেহভাজন লেজলি ডিলান; Source: AP

এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হয় ডাক্তার জর্জ হোডেলের নাম। তিনি লস এঞ্জেলসের বাসিন্দা। তার কাছে এলিজাবেথ চিকিৎসার জন্যে গিয়েছিল বলে জানা যায়। এ-ও জানা যায় যে এলিজাবেথের সাথে জর্জ হোডলের সম্পর্ক ছিল। জর্জ হোডেলের বিরুদ্ধে আগে থেকেই শ্লীলতাহানী ও নিজের সহকারীকে খুনের অভিযোগ তদন্তাধীন ছিল। কিন্তু গভীর জলের মাছ এই ডাক্তার ছিলেন নিষিদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তার উপর ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে যোগসাজশ। জর্জের ছেলে স্টিভ হোডেল বড় হয়ে পরবর্তীতে পুলিশের গোয়েন্দা হয়েছিল। তিনি তার ১৫ বছরের ব্যক্তিগত তদন্তের পর একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে তিনি দাবী করেন তার বাবা ডাক্তার জর্জ হোডেলই মূল খুনী।

এখনো পর্যন্ত ড. জর্জ হোডেলের বিরুদ্ধেই বেশি প্রমাণ পাওয়া যায়; Source: alchetron

সব মিলিয়ে ৬০ জন ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তি দিয়েছিল, যার মধ্যে লস এঞ্জেলস আদালত ২৫ জনকে সম্ভাব্য খুনীর তালিকায় রেখেছে। এদের মধ্যে অনেকেই রয়েছে যারা ডাক্তার অথবা চিকিৎসা বিষয়ক কাজে জড়িত, কেউবা আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্য।

মিডিয়ার ন্যাক্কারজনক ভূমিকা

শুরু থেকেই হয়তো মনে প্রশ্ন জাগছে মেয়েটির নাম বলা হচ্ছে এলিজাবেথ শর্ট, তাহলে ব্ল্যাক ডালিয়া নামটি কীভাবে এলো? সে সময় পত্রপত্রিকায় একধরনের রেওয়াজ ছিল, কোনো অপরাধের কাহিনীর রমরমা কোনো নামকরণ করা। সে সময় কেবল মুক্তি পেয়েছে ভেরোনিকা লেক অভিনীত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র The Blue Dahlia, এলিজাবেথের ছিল কোঁকড়া কালো চুল, সিনেমার সাথে মিল রেখে লস এঞ্জেলস হেরাল্ড পত্রিকা তাই কেসটির নাম দেয় ব্ল্যাক ডালিয়া কেস।

এতটুকু হলেও চলতো, এরপর থেকেই পত্রিকাগুলো বিক্রি বাড়ানোর জন্যে মুখরোচক সব কল্পিত কাহিনী তৈরী করে প্রচার করতে থাকে। যেমন এলিজাবেথ যৌনকর্মী ছিলেন, হলিউডের অনেকের সাথে তিনি প্রেম করে বেড়াতেন ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এগুলো সবই ছিল মনগড়া যা প্রায় বছরের পর বছর প্রকাশিত হতে থাকে। এমনকি মৃত্যুর পর পত্রিকা থেকে তার মাকে “আপনার মেয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে” এই মিথ্যা সংবাদ দিয়ে লস এঞ্জেলসে ডেকে আনা হয় তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্যে।

টাইম সাময়িকীয় মতে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত অমিমাংসিত অপরাধের একটি। এ ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে অসংখ্য উপন্যাস, টিভি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র। সাড়া জাগানো LA Confidential চলচ্চিত্রের পরিচালক ২০০৬ সালে এই ঘটনা নিয়ে তৈরী করেন The Black Dahlia চলচ্চিত্র। ভিডিওতে দেখুন সিনেমার ট্রেইলার।

বলা বাহুল্য, হলিউডের লাস্যময় জগতে প্রবেশ করতে এসে এলিজাবেথের মতো অনেক মেয়েই গত শতাব্দীতে কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। সেসব মিডিয়াতে প্রচার পায় না। অনেকেই তাই বলে থাকেন, এলিজাবেথের খুনী আর কেউ নয়, হলিউডই তাকে হত্যা করেছে।

ফিচার ছবি- letterboxd

Related Articles