Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্লাডি মেরি: আয়নায় আবির্ভূত রক্তপিয়াসী এক নারী শাসক

ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে ‘স্লাম্বার পার্টি’ হল ছেলেমেয়েদের বড় হয়ে ওঠার একটি ধাপ। বাবা-মায়ের অনুমতিতে তারা বন্ধুদের সাথে পুরনো কোনো ফাঁকা বাড়িতে সমবেত হয়। তারপর সারারাত ধরে চলে আনন্দ, উল্লাস। আপাতদৃষ্টিতে এটি যতটা সাধারণ মনে হয়, তার ফলাফল সবসময় ততটা নিরীহভাবে শেষ হয় না। বয়ঃসন্ধির কৌতূহলে তারা এমন কিছু খেলা বা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, যার ভয়াবহতা সম্পর্কে তারাও অবগত থাকে না। পশ্চিমা এই দেশগুলোতে ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক গেম’ খুবই পরিচিত একটি খেলা। বিশেষ করে তরুণ সমাজে এই খেলার প্রচলন অনেক। এই খেলার নিয়মানুসারে অন্ধকার ঘরে মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে মৃত কোনো ব্যক্তির আত্মাকে আহ্বান করা হয়ে থাকে। ১৯৭৮ সালের দিকে ‘স্লাম্বার পার্টিতে’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এসব ব্ল্যাক ম্যাজিক গেম, যার মধ্যে ‘সামনিং অফ ব্লাডি মেরি‘ অন্যতম।

‘স্লাম্বার পার্টি’; Source:MTV UK

তখনকার সময়ে আমেরিকায় প্রচলিত ছিল মধ্যরাতে কোনো অন্ধকার ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে আয়নার সামনে তিনবার ‘ব্লাডি মেরি’ উচ্চারণ করলে আয়নায় নিজের চেহারার বদলে ভেসে ওঠে এক বিকৃত নারীর অবয়ব, যার চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। অনেকসময় সে স্বাভাবিকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার অনেকসময় সামনে থাকা ব্যক্তির মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে এই অশরীরী আত্মা। এই আত্মার উপস্থিতির পর কেউ যদি বলে “আই স্টোল ইওর বেবি”, তখন সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রচলিত আছে, ‘ব্লাডি মেরি’র চ্যালেঞ্জ গ্রহণের পর অনেককেই খুঁজে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়, কেউবা হারিয়ে গেছে চিরতরে।

আয়নায় অশরীরি আত্মার আবির্ভাব; Source:magic899.fm

পশ্চিমায় অনেক নারীই দাবি করেন তারা আয়নায় অশরীরি আত্মার এই ব্লাডি মেরিকে দেখেছেন। যদিও এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে আয়নার এই অশরীরী আত্মার পেছনের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের যেতে হবে ১৫৫৩ সালে, যখন ইংল্যান্ডে রানী মেরির শাসনকাল চলছিল।

ব্লাডি মেরির আসল নাম মেরি টিউডর। ইংল্যান্ডের রাজা অস্টম হেনরি ও রানী ক্যাথেরিন অফ আরাগনের একমাত্র কন্যা মেরির জন্ম ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি। অনেকের মতে, হেনরি ছিলেন ইংল্যান্ডের উদ্ধারকর্তা বীর যোদ্ধা, আবার অনেকের কাছে হেনরি কেবল এক স্বৈরাচারী রাজার নাম। তিনি ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রবর্তক, তাই ক্যাথেলিক ধর্মানুসারীদের কাছে তিনি ছিলেন ভীষণভাবে নিন্দিত।

টিউডর মেরি; Source:Twitter

১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে যখন মেরি মাত্র ১৭ বছর বয়সী তরুণী, তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। হেনরি ক্যাথেরিনকে একটি পুরাতন দুর্গে নির্বাসিত করেন। ফলে তখন থেকেই পিতা ও পিতার ধর্মের উপর আক্রোশ জন্মে মেরির হৃদয়ে। এরপর হেনরি অ্যানি বোলেনকে বিয়ে করেন এবং এলিজাবেথ নামে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। মাতৃহীনা মেরি পিতার অবহেলায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বড় হতে থাকেন। কিন্তু ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দেই পরকীয়া ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অ্যানি বোলেনের শিরচ্ছেদের আদেশ দেন রাজা হেনরি। হেনরি মোট ছয়টি বিয়ে করেছিলেন। তার তৃতীয় স্ত্রী জেন সেইমুর এডওয়ার্ডের (রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড) জন্ম দেন।

রাজা হেনরি, পুত্র এডওয়ার্ড ও রানী সেইমুর; Source:EnglishHistory.net

দুর্ভাগ্যবশত, ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা অষ্টম হেনরি মারা গেলে তার ৯ বছরের পুত্র এডওয়ার্ড সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দেই এডওয়ার্ড মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লেডি জেন গ্রে নামে তার এক আত্মীয়াকে শাসক হিসাবে ঘোষণা করে যান। লেডি জেন গ্রে সিংহাসনে বসেই ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন এমন জনমত সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মাত্র ৯ দিন শাসনকালেই তাকে সিংহাসনচ্যুত করা হয়। ৯ দিনের রানী লেডি গ্রেকে সরিয়ে সিংহাসনে বসেন ৩৭ বছর বয়সী মেরি। ক্ষমতাপ্রাপ্তির পরেই তিনি লেডি গ্রের শিরচ্ছেদের নির্দেশ দেন। দীর্ঘদিনের প্রতিশোধ স্পৃহায় তিনি ইংল্যান্ডে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেন। পিতার প্রতিষ্ঠিত প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম পরিবর্তন করে তিনি ক্যাথেলিক ধর্ম প্রবর্তনে ক্যাথেলিক গির্জার কর্তৃত্ব পুনরায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। এছাড়া হেনরি নিষিদ্ধ ম্যাস (ক্যাথেলিক ব্রত) পালনের রীতি শুরু করেন।

৯ বছর বয়সে এডয়ার্ড সিংহাসনে বসেন; Source: wikipidea.org

১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্পেনের রাজা ফিলিপ ক্যাথলিক ধর্মের প্রবর্তনে রাষ্ট্রে ক্যাথলিক ধর্মবিরোধীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন। ফলে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মেরি ফিলিপকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। নির্মম উপায়ে ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম নির্মূল করাই ছিল এই বিয়ের উদ্দেশ্য। ইংল্যান্ডনিবাসী পূর্বেই অনুমান করতে পেরেছিল ফিলিপের সাথে মেরির বিয়ে তাদের উপর ভয়ানক হত্যাযজ্ঞ শুরু হবে, তাই তারা এই বিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। পরবর্তীতে তাদের অনুমান সঠিক হয়। ফিলিপের সহযোগিতায় মেরি প্রোটেস্ট্যান্ট বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমন করতে শুরু করেন। অমানবিক অত্যাচার থেকে উদ্ধার পেতে ইংল্যান্ডবাসী মেরির বিরুদ্ধে গিয়ে এলিজাবেথকে তাদের রানী হিসাবে পেতে চাইল। তাদের এই প্রতিবাদে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মেরি।

স্পেনের রাজা ফিলিপ ও রানী মেরি; Source:flicker.com

ফিলিপ ইংল্যান্ডেরও ইনকুইজিশন ব্যবস্থা চালু করতে উৎসাহিত করেন মেরিকে। ক্যাথলিক ধর্মবিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রবর্তন করেন তিনি। আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন তিন শতাধিক প্রোটেস্ট্যান্টকে। তার এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডে সমস্ত ইংল্যান্ডনিবাসী স্তব্ধ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একে ‘Marian Persecutions‘ বলে অবহিত করা হয়।

মেরির এই রক্তপিয়াসী অমানবিক হত্যাযজ্ঞের ফলেই তিনি ‘ব্লাডি মেরি’ হিসাবে কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। আইনত তখন প্রোটেস্ট্যান্টদের শিরচ্ছেদে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রীতি ছিল। কিন্তু ক্যাথলিক ধর্মানুসারিদের শাস্তি হিসাবে পুড়িয়ে মেরে ফেলার নিয়ম ছিল। তাই ক্যাথলিক ধর্মবিরোধীদের ভেতর আতঙ্কের সৃষ্টি করতে ফিলিপ রানী মেরিকে প্রোটেস্ট্যান্টদের পুড়িয়ে হত্যার পরামর্শ দেন।

প্রোটেস্ট্যানদের পুড়িয়ে হত্যা; Source:alamy.com

ফিলিপ মেরিকে বিয়ে করলেও তার আকর্ষণ ছিল মেরির সৎ বোন এলিজাবেথের প্রতি। এছাড়া প্রাসাদের অন্যান্য নারীর প্রতিও পরবর্তীতে ঐতিহাসিকগণ তার আকর্ষণের প্রমাণ পান। মেরি মৃত্যুর পূর্বে তার কোনো উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেননি। জানা যায়, তিনি দু’বার গর্ভধারণ করলেও সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হননি। প্রসবের সময় সন্তানের অস্তিত্ব গর্ভেই মিলিয়ে যায়। অনেকের ধারণা, রক্তপিয়াসী এই নারীর গর্ভে শয়তান বাসা বাঁধে। ফলে তিনি মাতৃত্বের স্বাদ পেতে অক্ষম হন।

এই ঘটনার পর মেরিকে ফেলে ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে ফিরে যান ফিলিপ। ফলে হতাশা আর ব্যর্থতার গ্লানি মেরিকে ঘিরে ফেলে। সে বছরই নভেম্বর মাসে মেরির মৃতদেহ পাওয়া যায় লন্ডনের সেন্ট জেমস প্রাসাদে। তার মৃত্যুর বছরেই এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন এবং তার শাসনামলে ইংল্যান্ডে পুনরায় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসে।

হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ আয়না নিয়ে অনেক ভীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হয়ে আসছে। অনেকের ধারণা, আয়না মৃত মানুষর আত্মাকে ধারণ করে রাখে। ফলে কখনো কখনো সেখানে নিজের বদলে অন্য কারো প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে, হতেই পারে সেটা জীবিত বা মৃত কোনো মানুষের। প্রাচীনকালের রাজাদের দীর্ঘকায় আয়না সম্পর্কে প্রচলিত আছে, আত্মা যদি কোনো ঘরে প্রবেশ করে তবে আয়নাকে তারা ভুলবশত বেরিয়ে আসার পথ ভাবে। আর একবার আয়নায় প্রবেশের পর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে পরবর্তীতে মানুষ তাকেই দেখে।

আয়নায় ব্লাডি মেরীর অস্তিত্ব সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, রক্তপিয়াসী পরাজিত শাসক আর মাতৃত্বের সাধ পূরণে ব্যর্থ মেরীর অতৃপ্ত আত্মাকে ডাকলে সে আয়নায় তাকে দেখা দেয় আর মৃত্যুর পরেও তার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে সামনের মানুষের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে থাকে। আয়নার এই প্রচলিত ভীতিকর ঘটনাগুলো যুগের পর যুগ বহু সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক আর সিনেমার পরিচালকদের রচনার মাধ্যমে প্রচলন হয়ে এসেছে। তবে সাইকোলজিস্ট এবং সায়েন্টিস্টদের গবেষণা মতে, মৃদু আলোয় বা মোমবাতির আলোয় মানুষের মস্তিষ্কে একধরনের ভ্রমের সৃষ্টি হয়। আর সেসময় দীর্ঘক্ষণ আয়নায় তাকিয়ে থাকলে মানুষ কল্পনায় যা দেখতে চায়, বাস্তবেও তেমন ভয়ংকর কিছুই সে দেখে বলে ধারণা করে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত উত্তেজনা, ভয় কিংবা হার্ট অ্যাটাকে অনেকের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।

সত্যিই আয়নায় এই অশরীরী আত্মা ব্লাডি মেরির উপস্থিতি আছে কিনা এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে অনেক। কারণ আজ পর্যন্ত যারা বলেছেন যে তারা ব্লাডি মেরিকে দেখেছেন তারা কেউই তার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। আর তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে বিজ্ঞানের নানাবিধ যুক্তি মানুষের এই ভয়কেও নির্মূল করতে অনেকাংশেই সফল হয়েছে।

Related Articles