Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বোর্ন এন্ড শেফার্ড: বিশ্বের প্রাচীনতম ফটো স্টুডিও

২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল কলকাতার এক ফটো স্টুডিও বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায় মন্দা, আর্থিক দুরাবস্থা আর সরকারের সাথে স্টুডিওর জমি নিয়ে ঝামেলার কারণে। ব্রিটিশ উপনিবেশের যুগের জীর্ণ ভবনটির এদিক সেদিকে আগাছাগুলোও যেন সেই দৈন্য দশারই জানান দিচ্ছিল। বন্ধ হওয়ার ঘোষণা আসার পরই সারা ভারত তো বটেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভেতর সাড়া পড়ে যায়। সংবাদ মাধ্যম স্টুডিওর কর্তাব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোন দিতে লাগলেন সমবেদনা জানাতে। যদিও সেই ২০ তারিখের আগের ১০ বছর কেউই তাদের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডে বোর্ন এন্ড শেপার্ডের ভবন; Source: indianeagle

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ফটোগ্রাফিক স্টুডিও ‘বোর্ন এন্ড শেফার্ড’ এর কথা। ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ফটো স্টুডিওকে সাধারণত বিশ্বের অন্যতম পুরনো স্টুডিও বলা হলেও সত্যজিৎ রায় তার ফেলুদা সিরিজের ‘গোরস্তানে সাবধান’ গল্পে এটিকে উল্লেখ করেছেন ‘বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীন’ ফটো স্টুডিও হিসেবে।

স্টুডিও ভবনের প্রবেশ পথ; Source: Subham Dutta

কলকাতার এই ফটো স্টুডিও সেই সময় হয়ে উঠেছিলো কার্যত ভারতে ব্রিটিশ সরকারের দাপ্তরিক ফটোগ্রাফার, সমস্ত ব্রিটিশ গভর্নর, ভাইসরয়, রাজা মহারাজা সবার ছবি তো তোলা হতোই। এমন অবস্থা হয়েছিলো যে, ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছে এমন সমস্ত ব্রিটিশদের ছবিই সেখানে সংরক্ষিত ছিলো!

১৮৭৫ সালে বোর্ন এন্ড শেফার্ডের তোলা প্রিন্স অব ওয়েলসের (বন্দুক হাতে) বাঘ শিকারের ছবি; Source: Library of Congress

ইংল্যান্ড থেকে বিভিন্ন সময়ে আগত অনেক ফটোগ্রাফার এই স্টুডিওর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। প্রায় দেড়শ বছর ধরে ফটোগ্রাফি সেবা দিয়ে আসতে আসতে বোর্ন এন্ড শেফার্ডে হাজার হাজার ছবি ও ছবির নেগেটিভ জমা হয়ে সেটা পরিণত হয়েছিলো ভারতের সবচেয়ে বড় ফটোগ্রাফিক আর্কাইভে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় শুধু ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলেও না হয় হতো। ১৯৯১ সালের এক অগ্নিকান্ডে এই মহামূল্য আর্কাইভের প্রায় অধিকাংশ নেগেটিভ পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। সাথে নিয়ে যায় আমাদের ভারতীয় এই অঞ্চলের অনেক ঐতিহাসিক ছবি, আর অমূল্য ইতিহাস। মূলত এই অগ্নিকান্ডই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়, এরপর থেকেই স্টুডিওর অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে।

শুরুর ইতিহাস

নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বোর্ন এন্ড শেফার্ড ব্রিটিশদের তৈরী একটা প্রতিষ্ঠান। যদিও এর মালিকানা বহুবার হাত বদল হতে হতে শেষমেশ ভারতীয়দের হাতে এসে পৌঁছে ছিলো। বোর্ন এন্ড শেফার্ড স্টুডিও স্থাপিত হয়েছিলো ১৮৬৩ সালে স্যামুয়েল বোর্ন এবং উইলিয়াম হাওয়ার্ড, এই দুই ফটোগ্রাফারের উদ্যোগে। যার মধ্যে স্যামুয়েল ছিলেন ইংল্যান্ড থেকে আগত এক শখের কিন্তু খুবই উচ্চাকাঙ্খী এক ফটোগ্রাফার। অন্য দিকে উইলিয়াম তত দিনে পুরোপুরি পেশাদার, তার খোদ কলকাতায় তার নিজস্ব একটি স্টুডিও ছিলো। দু’জন মিলে চালু করলেন ‘হাওয়ার্ড এন্ড বোর্ন’ নামের স্টুডিওটি।

স্যামুয়েল বোর্ন ও চার্লস শেপার্ড; Source: indiabooks

কিন্তু তার পরের বছরই অর্থাৎ ১৮৬৪ সালে এরা আবার চার্লস শেফার্ড নামক একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ফটোগ্রাফারের সাথে যোগাদান করেন। ফলে প্রতিষ্ঠানের নতুন নাম দাঁড়ায় ‘হাওয়ার্ড, বোর্ন এন্ড শেফার্ড’। এই নামেই প্রতিষ্ঠানটি ১৮৬৫ থেকে ‘৬৮ পর্যন্ত ব্যবসা করে। কিন্তু এরপর হাওয়ার্ড পার্টনারশিপ থেকে বেরিয়ে গেলে তখন প্রতিষ্ঠানের নাম দাঁড়ায় ‘বোর্ন এন্ড শেফার্ড’, যা পরবর্তী ১৩৮ বছর পর্যন্ত চালু ছিলো।

ফটোগ্রাফিক যাত্রা

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বোর্ন এন্ড শেফার্ড ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ব্রিটিশদের যাবতীয় কার্যকলাপ, অনুষ্ঠান, রাজকার্য ইত্যাদি কাভার করতে থাকে। ফলে এক পর্যায়ে তারা অনানুষ্ঠানিকভাবেই ভারতে ব্রিটিশ সরকারের দাপ্তরিক ফটোগ্রাফারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

১৯১১ সালে বোর্ন এন্ড শেফার্ডের তোলা দিল্লী দরবার অনুষ্ঠানের ছবি; Source: indianeagle

বোর্ন এন্ড শেফার্ড তাদের পোট্রেটের জন্যে বিখ্যাত ছিল। ফলে তৎকালীন ভারতে ব্রিটিশদের আসা প্রায় সকলেই তাদের স্টুডিওতে গিয়ে নিজেদের পোট্রেট করাতেন। বড় বড় বিখ্যাত ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, কবি সাহিত্যিক তো বটেই, বোর্ন এন্ড শেফার্ডে গিয়ে নিজের একটি পোট্রেট ছবি করিয়ে নেওয়াকে তৎকালীন সময়ে রীতিমতো একটা আভিজাত্য হিসেবে গণ্য করা হতো। ফলে এই তালিকায় নাম পাওয়া যায় নোবেল বিজয়ী ইংরেজ সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং, আধ্যাত্নিক শ্রী রামকৃষ্ণ থেকে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত।

নোবেল বিজয়ী ইংরেজ সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং এবং উদয়পুরের মহারাজ সাজ্জান সিং; Source: indianeagle

সাধারণ মানুষ, বিখ্যাত ব্যক্তিদের পোট্রেট, সরকারি নানা কাজ, নানা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ ইত্যাদি ক্যামেরার ফিল্মে ধরতে ধরতে বোর্ন এন্ড শেফার্ড হয়ে ওঠে বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সংরক্ষক। চার্লস শেপার্ড ভারতীয় এ অঞ্চলে প্রচুর ভ্রমণ করেছিলেন, আর তুলেছিলেন ভারতীয় স্থাপত্য, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ছবি। তার তোলা সেসব ছবি তৎকালীন ভারতের প্রতিচ্ছবি যা এখন বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থার উপজীব্য বিষয়, যেমন ন্যাশনাল পোট্রেট গ্যালারি, স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউট ইত্যাদি।

কলকাতার গঙ্গা ঘাট; Source: indianeagle

দার্জিলিংয়ে হিমালয়ান রেলওয়ের লুপ; Source: MAP

শেফার্ডের ছিলেন খুবই দক্ষ একজন আলোকচিত্রী। তিনি Wet plate collodion process নামক পদ্ধতিতে কাজ করতেন। এটা এমন একটি ফটোগ্রাফিক পদ্ধতি যেটার জন্যে ছবি তোলার সাথে সাথে তাৎক্ষণিকভাবে রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ফেলতে হয়। এজন্য সাথে কয়েকজন ক্রু এবং ক্যারাভ্যানের মতো ভ্রাম্যমাণ ডার্করুমে নিয়ে ঘুরতে হতো। এটা ছিলো ছিলো খুবই কষ্টসাধ্য কিন্তু এ প্রক্রিয়ার ছবিগুলো হতো খুবই উচ্চমান সম্পন্ন। ফলে বোর্ন এন্ড শেফার্ডের ছবিগুলো কারিগরীভাবে অনেক খুঁটিনাটিতে ভরা এবং শিল্পমানের দিক থেকেও চমৎকার।

১৮৬৬ সালে স্যামুয়েলের তোলা ব্যানারসের মন্দির; Source: MAP

বোর্ন এন্ড শেফার্ড কলকাতার নিউমার্কেট এলাকার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডের একটা ঔপনিবেশিক আমলের পুরনো ভবনে অবস্থিত। শুরু থেকেই এটি এই ভবনেই ছিলো। শুরু থেকেই এটি ইউরোপীয়দের হাতে থাকলেও দেশভাগ ও রাজনৈতিক কারণে সর্বশেষ ইউরোপীয় মালিক আর্থার ম্যাসেলহোয়াইট নিলামে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেন। ১৯৬৪ সালে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার ঠিক ১০০ বছর পরে নিলামে এটির মালিক হন আজমির ও জয়ন্ত গান্ধী নামক দুই ফটোগ্রাফার।  জয়ন্ত গান্ধীই এই প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ অধিকারী ছিলেন, তার হাতেই শেষ শাটার নামে এই চমৎকার ফটোস্টুডিওর।

১৯০৩ সালে তোলা একটা ভাসমান বাংলো; Source: smithsonian Institution

শেষের যখন শুরু

গত শতাব্দীর ‘৭০ আর ‘৮০র দশক ছিলো বোর্ন এন্ড শেফার্ডের স্বর্ণযুগ। স্টুডিওতে সার্বক্ষণিক ৩০ জন ফটোগ্রাফার প্রতিদিন ব্যস্ত সময় কাটাতেন প্রচুর ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নিয়ে। ডিজিটাল ফটোগ্রাফির যুগে বোর্ন এন্ড শেফার্ডের কদর যে কমে যেতই শেষমেশ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৯৯১ সালের দুর্ঘটনাই এই প্রতিষ্ঠানের কোমর ভেঙ্গে দেয়।

পুরনো দিনের ক্যামেরার যত্নে ব্যস্ত এক কর্মী; Source: deccanherald

সুরেন্দ্রনাথ রোডের এই ভবনেই ছিলো ১৮৬৩ সাল থেকে তোলা হাজার হাজার নেগেটিভ ছবির এর আর্কাইভ। ১৯৯১ সালে ভবনে আগুন লেগে গেলে এর অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়। সেসময় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতির পরিমাণ জানতে লোক পাঠিয়েছিলেন, জয়ন্ত বলেন

“১৯৯১ সালে আগুন লাগলে মুখ্যমন্ত্রী লোক পাঠিয়েছিলেন ক্ষতির পরিমাণ জানতে, সেটাই ছিলো শেষবার যখন কেউ আমাদের খোঁজ নিয়েছিলো।”

১৯৯১ সালের এই দুর্ঘটনা কাটিয়ে ওঠার অনেক চেষ্টা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন করে স্টুডিও সংস্কার করা হয়। আগুনে পুড়ে যাওয়া আর্কাইভে পুড়ে যাওয়া ফিল্মগুলো ঘষামাজা করে ঠিক করার চেষ্টাও করা হয়েছে। যদিও সেসব প্রচেষ্টা তেমন কাজে দেয়নি। ‘৯০ এর দশকের পর ফটোগ্রাফি ডিজিটাল হতে থাকলে বোর্ন এন্ড শেফার্ডও তাদের ব্যবসার ধরনে পরিবর্তন আনে টিকে থাকতে। শুধু ছবি তোলা ও প্রিন্ট বাদেও নানা ডিজিটাল ফটোগ্রাফিক জিনিসও বিক্রি করা হয়। কিন্তু বোর্ন এন্ড শেফার্ডের মূল শক্তিই ছিলো তাদের পোট্রেট ফটোগ্রাফি ও ফাইন আর্ট প্রিন্টিং। যা আজকের অনলাইনের যুগে খুব কম মানুষই করে থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে।

জয়ন্ত এখন স্টুডিও সামগ্রীগুলো আঁকড়ে পড়ে আছেন; Source: indianeagle

বোর্ন এন্ড শেফার্ডের কফিনে শেষ পেরেকটি লাগে এক আইনগত ঝামেলায়। স্টুডিওর পুরনো ভবনটি যেটা আবার হেরিটেজ ভবন হিসেবে তালিকভুক্ত, সেটার মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিলো ‘লাইফ ইন্সুরেন্স করপোরেশন (LIC)’ এর সাথে। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা আইনী মামলায় হেরে গেলে জয়ন গান্ধী বাধ্যই হন ১৭৬ বছরের প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করতে।

জয়ন্ত গান্ধীর ফোনে এখনো বেজে চলে ইন্টারভিউ দেয়ার অনুরোধে, কিংবা স্টুডিও আবার চালুর জন্যে সাহায্য করার প্রস্তাব। কিন্তু জয়ন্তর কথা, কঠিন বাস্তবের ছবিই তুলে আনে-

“আমি বুঝি হঠাৎই অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন, কিন্তু আসলে দূর থেকে সংহতি জানানো এক জিনিস আর বাস্তব পরিস্থিতি সামাল দেয়া আরেক জিনিস।”  

ফিচার ছবি-qz

Related Articles