পৃথিবীর ইতিহাসে চীনা সভ্যতার বয়স বেশ প্রাচীন। এর সাংস্কৃতিক অর্জনও অঢেল। তবে সাংস্কৃতিক অর্জন বেশি হলে জনসাধারণ বা শাসকের মধ্যে অনেক সময় আত্মতৃপ্তি এসে পড়ে। ফলে নতুন ও অভিনব অগ্রগতি আর অন্য সংস্কৃতির অর্জন বোঝার ক্ষেত্রে মিথ্যে অহংকার আসতে পারে। তখন সমাজ বা দেশ একরকম স্থবির হয়ে পড়ে। উনিশ শতকে চীনের মতো বিশাল ও প্রাচীন সভ্যতার দেশের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছিলো। তার মূল্যও একেবারে কম দিতে হয়নি। ১৮৯৮ সালে শুরু হওয়া 'বক্সার বিদ্রোহ' শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হবার পরও চীন সাম্রাজ্য এমন মূল্য দিতে বাধ্য হয়েছিলো।
১৮৩৯ সালে ঘটিত প্রথম আফিম যুদ্ধে চীন ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয়। ফলে ইংল্যান্ডের পাশাপাশি ফ্রান্স, রাশিয়া ও জাপানের মতো শক্তির জন্যও চীনের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। সেনা ও নৌবাহিনীর দুর্বলতার কারণে চিং রাজবংশ অপমানজনক চুক্তি করতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে ১৮৪২ সালের নানকিং চুক্তি, ১৮৫৮ সালের আইগুন ও তিয়েন্তসিন চুক্তি, ১৮৬০ এর পিকিং কনভেনশন ও ১৮৯৫ সালের শিমোনোসেকি চুক্তি অন্যতম। প্রাচীন ও এককালের সমৃদ্ধ চীন তার স্বর্ণযুগ হারিয়ে ফেলেছিলো।
এসব চুক্তির ফলে চীন তার তৎকালীন রাজধানী পিকিংয়ের অনেক এলাকা বৈদেশিক শক্তিগুলোর হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ইউরোপীয় শক্তির প্রত্যক্ষ মদদে বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারি অবাধে ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক শক্তি বাড়িয়ে তুলতে থাকে। মিশনারিগুলোর প্রচারিত ধর্ম চীনের সংস্কৃতির জন্য একেবারেই নতুন ও বিপজ্জনক হিসেবে দেখা দিয়েছিলো। কেননা চীনারা তাদের দেশকে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যকার রাজ্য মনে করত। চীনা রাজবংশ তাদের কাছে স্বর্গের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মানিত ছিলো। এছাড়া ইউরোপীয় খ্রিস্টান পাদ্রীরা চীনের স্থানীয় তাও, কনফুশীয় ও চ্যান বৌদ্ধ ধর্মমতকে কুসংস্কার ও শয়তানের ধোঁকা বলে প্রচার চালাতো। বহু চীনা নাগরিককে লোভ ও ভয়ের মাধ্যমে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট মতের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছিলো। অপমানজনক চুক্তির কারণে চীনা প্রশাসন মিশনারিদের ধর্ম প্রচারে কোনোরকম বাধা দিতে অপারগ ছিলো। উপরন্তু বিদেশী দখলকৃত এলাকাগুলোতে চিং সাম্রাজ্যের সরকারি কোনো হুকুম ও ফরমান চালানো যেত না।
১৮৯৭ সালে শ্যাংডং প্রদেশে উপর্যুপরি বন্যা ও পরের বছর খরার ফলে প্রয়োজনীয় ফসল ফলানো যায়নি। ফলে দেখা দেয় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। চিং রাজ্যের রাজধানীতে অনাহারী দরিদ্র মানুষের ভিড় লেগেই ছিলো। অন্যদিকে বিদেশীদের দখলকৃত এলাকাগুলোতে চীনের স্থানীয় মানুষের প্রতি উপেক্ষা ও ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ মানুষ তাদের সব রকম দুরবস্থার জন্য আগ্রাসী বিদেশী শক্তির দখলদারিত্ব ও তাদের মিশনারিগুলোর কর্মকাণ্ডকে দায়ী করতে থাকে।
অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে চীনে বেশ কয়েকটি গোপন সংগঠন গড়ে ওঠে। এসব সংগঠন বিভিন্ন মার্শাল আর্ট কেন্দ্রীক ছোট-বড় দল উপদল নিয়ে গঠিত ছিলো। অনেক ধর্মীয় ও লৌকিক প্রথা চর্চার কারণে বহু চীনা জনগণের কাছে এদের একরকম গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিলো। এর মধ্যে ‘বাইলিয়াংজাও’ বা হোয়াইট লোটাস ক্ল্যান, ‘দাদাও হুই’ বা বিগ সোর্ড সোসাইটি এবং ‘য়িহেতুয়ান’ বা মিলিশিয়া ইউনাইটেড ইন রাইটিয়াসনেস উল্লেখযোগ্য।
১৮৯৭ সালের ১ নভেম্বর ‘দাদাও হুই’ সংগঠনের একদল সশস্ত্র সদস্য শ্যাংডং প্রদেশে জার্মান মিশনারি ‘সোসাইটি অব দ্য ডিভাইন ওয়ার্ড’ এর দুই ক্যাথলিক পাদ্রী ফ্রাঞ্জ জেভার নেইস এবং রিচার্ড হেনলেকে হত্যা করে। এই সংবাদ শুনে জার্মান কায়জার দ্বিতীয় উইলহেম তার সেনাবাহিনীর ইস্ট এশিয়া স্কোয়াড্রনকে জিয়াওঝোউ উপসাগর দখল করতে নির্দেশ দেন। জার্মানির এই নির্দেশে অন্যান্য ইউরোপীয় ও বড় শক্তি ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জাপান নিজেদের প্রভাব বলয় সুরক্ষা করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
শ্যাংডংয়ে লিউয়ানতুন গ্রামে একটি প্রাচীন রাজপ্রাসাদ মিশনারিরা ক্যাথলিক চার্চ বানিয়ে তাদের প্রচারণা চালাচ্ছিলো। ১৮৯৮ সালের অক্টোবরে ‘য়িহেতুয়ান’ সংগঠনের সদস্যরা গ্রামটির খ্রিস্টান ও বিদেশী সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালায়। উল্লেখ্য, এই সংগঠন মার্শাল আর্টের বেশ কিছু স্টাইল, বিভিন্ন অস্ত্র চালনা ও গোপন ধর্মীয় রিচুয়াল চর্চা করত। চীনের মার্শাল আর্ট তখন অবধি পশ্চিমে ‘চাইনিজ বক্সিং’ নামে পরিচিত ছিলো। এই বক্সিং থেকেই পরে ‘বক্সার বিদ্রোহ’ নাম খ্যাত হয়ে উঠেছিলো।
বিদেশী মিশনারি ও দেশী খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণে বিদেশী শক্তিগুলো সচেতন হয়ে উঠলো। শ্যাংডং প্রদেশে জার্মান অবস্থান প্রতিরক্ষার জন্য নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াতে লাগলো। এবার শুধু বিদ্রোহী ‘বক্সার’রা নয়, রাজ্যের প্রশাসনও দেশে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ ও সম্ভাব্য বিভাজন নিয়ে সচেতন হয়ে উঠলো। চীনের কিছু প্রগতিশীল সরকারি কর্মকর্তা প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের সহায়তায় দেশের কিছু সংস্কার আনার চেষ্টা করছিলেন। চিং সাম্রাজ্যের ১১তম সম্রাট গুয়াংশু এতে সমর্থন দিচ্ছিলেন। কিন্তু সম্রাজ্ঞী দাওজের চিচি এই পদক্ষেপে সরাসরি বিরোধিতা করেন। তিনি সম্রাট গুয়াংশুকে গৃহবন্দী করে রাখেন।
প্রাথমিকভাবে বিদ্রোহ শুরু হবার সময়ে চীনা রাজপরিবার বক্সার বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করছিলো। কিন্তু ১৯০০ সালের শুরু দিকে সম্রাজ্ঞী দাওজের চিচি’র অবস্থান পরিষ্কারভাবে বিদ্রোহীদের দিকেই দেখা যাচ্ছিলো। তিনি বিদ্রোহীদের পক্ষে সরকারি আদেশ জারি করেছিলেন। ১৯০০ সালের মাঝামাঝি বিদ্রোহের তীব্রতা বেড়ে গেলো। বক্সারদের কর্মকাণ্ড শুধু শ্যাংডং অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলো না। বেইজিংয়ের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো। বিদেশি মিশনারি ও দেশি খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ বেড়ে যেতে লাগলো। ৩০ মে ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ ক্লদ ম্যাক্সওয়েল ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি দল চীনে অবস্থিত বিদেশি সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য আবেদন করলেন। পরের দিনই বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের নৌবাহিনীর ৪৩৫টি ট্রুপস বিদেশি মিশনগুলো রক্ষা করার কাজে এলো।
বক্সারদের আক্রমণের তীব্রতা বেড়েই যাচ্ছিলো। ৫ জুন তিয়ানজিন রেললাইন উপড়ে ফেলা হলো। ১১ জুন জাপানি মিশনের সেক্রেটারি সুগিয়ামা আকিরা বিদ্রোহীদের আক্রমণে নিহত হলেন। এদিনই বক্সারদের একজন জার্মান মিশনের সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর জবাবে বক্সাররা বেইজিংয়ে বহু খ্রিস্টান চার্চ পুড়িয়ে দেয় এবং বহু বিদেশিকে হত্যা করে। জার্মানি ও আমেরিকান এলাকার বিদেশি সৈন্যরা গুলি ছুঁড়ে বক্সার বিদ্রোহী ছাড়াও বেশ কিছু সাধারণ চীনা নাগরিককেও হত্যা করে।
পরিস্থিতি আরো বেশি ভয়ানক হয়ে উঠছিলো। ব্রিটিশ ভাইস এডমিরাল এডওয়ার্ড সেমুরের নেতৃত্বে ২,০০০ সৈন্যের একটি সশস্ত্র দল ১০ জুন দাগু অঞ্চল থেকে বেইজিংয়ে এলো।
এদিকে রাজপরিবারে নাটকীয় ঘটনা ঘটছিলো। বিদেশীদের প্রতি উদার যুবরাজ চিংকে সরিয়ে অন্য যুবরাজ দুয়ান ক্ষমতায় সক্রিয় হলেন। তিনি ছিলেন কট্টর ইউরোপ-বিরোধী। তিনি চিং সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীকে বিদেশিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। অনিবার্য সংঘর্ষ ও রক্তপাত এড়ানো গেলো না।
ব্রিটেন ও জার্মানির নেতৃত্বে সম্মিলিত শক্তি চিং সম্রাজ্ঞীকে আত্মসমর্পণের আহবান জানালো। সম্রাজ্ঞী চিচি তার মন্ত্রীবর্গের সামনে বিদেশীদের বিরুদ্ধে পুরোপুরি যুদ্ধ ঘোষণার পক্ষে মত দিলেন। ১৫ জুন চিং সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী বেইহে নদীতে বিদেশী রণতরীর বিরুদ্ধে মাইন বোমা রাখলো। ২১ জুন সম্রাজ্ঞী চিচি বিদেশিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন। তার সেনাবাহিনীর পদস্থ অনেক অফিসার যুদ্ধের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেছিলেন। এদের অনেকে জার্মান ও ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ আর সেনা অফিসারদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। অনেকে রাজপরিবারের অনুগত সেজে বক্সার বিদ্রোহীদের হত্যা করেছিলেন।
ফলাফল খুব বেশি বিচিত্র ছিলো না। বক্সার বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত করুণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলো। চিং সম্রাজ্ঞীর ঘোষণা করা যুদ্ধেও বিদেশি শক্তির কাছে চীন পরাজিত হয়।
বিদ্রোহ শুরুর সময় ও মাঝামাঝি বিদ্রোহী বক্সারদের হাতে ৪৮টি ক্যাথলিক মিশনারি, ১৮২টি প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারি ও প্রায় ১৮,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিলো। বিদেশি শক্তিগুলোও বিজয়ী হয়ে থেমে ছিলো না। বিশেষ করে জার্মান সৈন্যরা সংঘর্ষ সমাপ্ত হবার পরও পুরো বেইজিং জুড়ে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও লুটপাটে মেতে উঠেছিলো। বহু সরকারি অফিসার ও বক্সার বিদ্রোহীকে জার্মান ও ব্রিটিশ বাহিনী প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।
উনিশ শতকের শুরু ও মাঝামাঝি সময়ে বিদেশী শক্তির সশস্ত্র উপস্থিতিতে সাবধান হবার ফলে মেইজি সংস্কারের দ্বারা জাপান আধুনিক উপায়ে শক্তিশালী হয়েছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ব্রিটেন ও জাপানের কাছে পরাজয় সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দুর্বল রাষ্ট্রযন্ত্রের কারণে চীন পিছিয়ে ছিলো। ফলে বক্সার বিদ্রোহের জনরোষ কাজে লাগিয়ে চীনা সাম্রাজ্য বিদেশী আগ্রাসন বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের ঘোষিত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছে তাদের।
This Bangla article is about the Boxer rebellion of early 20th century of Imperial China.
References:
01. Timeline of the Boxer Rebellion - Thought Co
02. Boxer Rebellion - History
03. Rebels: The Boxer Rebellion - Facing History