Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লজ্জা এড়াতে যেভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিচ্ছিলো ব্রিটিশ পুরুষেরা

১৯১৪ সালের আগস্টে শুরু হয় ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ। বর্তমানে আমরা এটিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে জানলেও, তখন এটিকে ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ বলে ডাকা হতো। কে জানতো, পুরো পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয়া একটি যুদ্ধ শেষ হবার দুই যুগ পরেই আরেকটি মহাযুদ্ধ এসে দেখা দেবে! তবে আজ সে কথা কথা থাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যেহেতু শুরু করেছি, চলুন সেদিকেই আগাই।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ব্রিটিশ সরকার তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুরো রাজ্যের মানুষকে যুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানায়। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েই ব্রিটিশরা ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধে যোগ দিতে থাকে। কিন্তু বেসামরিক সকল নাগরিককে কীভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হতো, তা নিয়েই আজকের এই লেখা।

দেশের জন্য যুদ্ধ করার আহ্বান; Image source: BBC/Bitesize

সে সময়টাতে ব্রিটেনের যুদ্ধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলেন লর্ড কিচেনার। ব্রিটেনের বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর তিনি বুঝতে পারলেন, তার যে পরিমাণ সামরিক শক্তি আছে, তা দিয়ে বিশ্বযুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তার দরকার বিপুল পরিমাণে সৈন্যসামন্ত। এজন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বোঝালেন, এই বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিয়োগের জন্য সর্বসাধারণকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।

সরকারও সায় দিলেন কিচেনারের প্রস্তাবে। ৫৪ মিলিয়ন পোস্টার ছাপানো হলো পুরো ব্রিটেন জুড়ে। ব্রিটেনের সকল রাজ্যে পাঠানো হয় মোট ৮ মিলিয়ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এই ঘোষণায় মানুষ এতই সাড়া দিতে থাকে যে, ভাগে ভাগে এদের সকলের সাক্ষাৎকার নিতে বসতে হয় মোট ১২ হাজারবার। আর নিয়োগের পর যারা বেসামরিক জীবন ছেড়ে সামরিক জীবনে যোগদান করেছে, তাদের জন্য বক্তৃতা দিতে হয় মোট ২০ হাজারবার। ঘোষণার প্রথম সপ্তাহেই ঘন্টায় ১০০ জন করে লোক যুদ্ধে যোগ দিতে থাকে। দিন শেষে তা মোট হয়ে দাঁড়াতো ৩০০০ এর আশেপাশে। আর আগস্ট থেকে ১৯১৪ এর শেষ পর্যন্ত মোট ১১ লক্ষ ৮৬ হাজার ৩৩৭ জন বেসামরিক সদস্য যুদ্ধে যোগদান করেন।

যুদ্ধে যোগদানের জন্য বানানো পোস্টার; Image source: BBC/Bitesize

সংখ্যাগুলো বেশ অদ্ভুত মনে হতেই পারে। একটি যুদ্ধে নিজেদের বিলিয়ে দেয়ার জন্য এত মানুষ এভাবে সাড়া দেবে, তা ভাবাটাও কঠিন। একটু খতিয়ে দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯১৪ সালে দেশ জুড়ে যুদ্ধে যোগদানের আহ্বান আসার পর সবাই চাচ্ছিলো যুদ্ধের শরীক হতে। এখনকার মতোই সেই সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারা ছিলো অনন্য এক মর্যাদা। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের এত বেসামরিক নাগরিকের যুদ্ধে যোগদানের আগ্রহ দেখানোর পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করে। ব্রিটেন সরকার চাচ্ছিলো, একজন নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাসদস্য যাতে তার পরিচিত এবং যুদ্ধে যাওয়ার যোগ্য, এমন সবাইকে সেনাবাহিনীতে নিয়ে আসে। এতে তারা একে অপরের খোঁজ খবর সহজেই রাখতে পারবে।

ল্যাঙ্কাশায়ার নামের ছোট একটি শহর থেকে একসাথে ৭০০ জন যুবক যুদ্ধে যোগ দেন। শহরের রাস্তা ধরে যখন তারা মার্চ করে যাচ্ছিলেন, তখন দুই পাশ থেকে ১৫,০০০ শহরবাসী তাদের সাহস যোগাচ্ছিলেন। একজনের দেখাদেখি আরেকজন যুদ্ধে যোগদান করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এর বিপরীত ঘটনাও আছে। 

সবাই তো আর যুদ্ধে যোগ দিতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। অনেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে কিংবা নিজেকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখার দায় দেখিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের কপালে জুটেছিলো ‘পাখির সাদা পালক’। এটি একটি সাংকেতিক প্রতীক, যার মানে হলো ‘তুমি ভীতু’! যারা যুদ্ধে যোগ দিতো না বা চলাচলে যুদ্ধের পোশাক থাকতো না, তাদের সবাইকে জনসম্মুখে এই সাদা পালক ধরিয়ে দেয়া হতো। এই লজ্জা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য হলেও অনেকে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছিলেন।

১৯১৪ সালে যখন স্বেচ্ছায় দেশের জন্য যুদ্ধে যোগ দেবার আহ্বান জানানো হয়, তখন বাছাইয়ের সময় অনেকে বাদ পড়েছিলেন। কীভাবে বাছাই হতো, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। কিন্তু ১৯১৬ সালে আগের ঘোষণা বদলে দেয়া হয়। যুদ্ধের ভয়াবহতা এতই বেড়ে যায় যে, লাখে লাখে সৈনিকরা যুদ্ধে শহীদ হচ্ছিলেন। তাদের শূন্য জায়গা পূরণের জন্য নতুন করে সৈন্য নিয়োগের দরকার ছিলো। অবশ্য প্রতিদিনই ব্রিটেনে নতুন সৈন্য নিয়োগ হচ্ছিলো। ১৯১৬ সালে ঘোষণা করা হয়, ব্রিটেনের সকল শ্রেণীর পুরুষকেই যুদ্ধে যোগদান করতে হবে। এটি কোনো আহ্বান ছিলো না; সরাসরি নির্দেশ!

কোনো পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ থাকলেই তাকে যুদ্ধে যেতে হবে। ফেলে যাওয়া সৈন্যদের শূন্যস্থান পূরণে এটি ছাড়া আর কোনো গতি ছিলো না ব্রিটিশ সরকারের। তাই তখন নিজের অনিচ্ছা থাকলেও একপ্রকারে বাধ্য হয়েই সবাই যুদ্ধে যোগ দিচ্ছিলেন। আর যাদের অভিযোগ ছিলো যুদ্ধে মানুষ হত্যার মতো কাজ করতে পারবে না, তাদেরকে দেয়া হয় যুদ্ধে মাঠের বাইরের কাজগুলো, যেমন- যুদ্ধের সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়া, আহতদের সেবা করা ইত্যাদি।

তবে ১৯১৪ থেকে শুরু করে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত যেসকল ব্রিটিশ বেসামরিক জনগণ যুদ্ধে যোগ দেন, তাদের সবাইকে ৮টি ধাপ পার হয়ে আসতে হতো। এবার দেখে নেয়া যাক সেই ধাপগুলো।

. নিয়োগ অফিসের সামনে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে যাওয়া

যেহেতু যুদ্ধের শুরুতেই সবাইকে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়ে বলা হয়েছে এবং প্রায় সকল নাগরিক যুদ্ধে যোগদানের মতো মহান সম্মান আশা করছিলেন, তাই সৈন্য নিয়োগের অফিসগুলোতে ভিড় লেগে গিয়েছিলো। ব্রিটেনের সকল সরকারি অফিসকে সৈন্য নিয়োগের অফিসে রূপান্তর করে ফেলা হয়। এতে করে সৈন্য নিয়োগের কাজ অনেক গতি পাচ্ছিলো। তাই কেউ যুদ্ধে নিয়োগের আশা করলে সেই ভিড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেতো। অনেকের ক্ষেত্রে কয়েকদিন ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও বেশিরভাগ মানুষই ধৈর্য্য ধরে সেই ভিড়ে অবস্থান করতেন। যুদ্ধের সৈন্য হওয়া বলে কথা!

প্রথম ধাপ ছিলো ভিড় সামলানো; Image source: BBC/Bitesize

. কয়েক ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া

একজন নাগরিককে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হলে তাকে বেশ কিছু পরীক্ষা পার হয়ে আসতে হবে। বয়সসীমা এবং জাতীয়তার মিল থাকার পর তাকে পার হতে হবে বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষার। ন্যূনতম শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা না থাকলে একজন সেনা কখনোই যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত হতে পারতেন না।

চলছে মেডিকেল পরীক্ষা; Image source: IWM (Q 30067)

. শপথ পাঠ করা

প্রাথমিক সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর একজন সেনাকে নিয়োগের আগে শপথবাক্য পাঠ করতে হয়। বাইবেল কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে হাত রেখে তারা ব্রিটিশ রাজার আনুগত্য স্বীকার করে নিতো। তবে তখন সৈনিক নিয়োগের অনেক চাপ থাকায় একজন একজন করে শপথ বাক্য পাঠ করানো সম্ভব ছিলো না। তাই সবসময় বড় কয়েকটি দলে শপথ পাঠ করানো হতো।

. কোনো একটি সেনাদলে যোগ দেয়া

লর্ড কিচেনার সেনাসদস্যদের যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের আলাদা আলাদা দলে ভাগ করে দিতেন। সামর্থ্য এবং বিশেষ দক্ষতার ভিত্তিতে তিনি দল তৈরি করতেন। একজন সেনাসদস্য শপথবাক্য পাঠ করার পর তাকে যোগ দিতে হবে কোনো একটি দলে। সেখান থেকেই তার সৈনিক হিসেবে প্রাথমিক যাত্রা শুরু।

ট্রেনিং ক্যাম্পে সৈন্যদের জীবনটা ছিলো অন্যরকম; Image source: BBC/Bitesize

. ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দান করা

সদ্য যোগ দেয়া সৈনিকদের মাঝে কেউ শিক্ষক, কেউ কৃষক, কেউ ছাত্র, কেউ গাড়িচালক। সাধারণ জীবনযাপন ছেড়ে সবাই এসেছে একসাথে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য। ঘর-বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে এসেছে যুদ্ধের কৌশল শেখার জন্য। কারো জন্য এটিই ছিলো তাদের জীবনে প্রথমবার ঘর থেকে বাইরে থাকার অভিজ্ঞতা। সেনাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই জীবনে তারা শিখেছিলো নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং সেই সাথে যুদ্ধের নানা কৌশল।

. অস্ত্র চালনা শেখা

যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য অন্যতম একটি অংশ হলো ঠিকমতো অস্ত্র পরিচালনা করতে পারা। কিন্তু এত বিশাল সংখ্যক সেনাকে প্রস্তুতির পরিমাণমতো অস্ত্রের যোগান দিতে অপারগ ছিলো ব্রিটিশ সরকার। অস্ত্র ছাড়াও সকলের জন্য সেনা পোশাক দিতেও হিমশিম খাচ্ছিলো তারা। তারপরও এত প্রতিবন্ধকতার মাঝে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সৈন্যরা শিখেছিলো অস্ত্র পরিচালনাসহ যুদ্ধের নানা কৌশল।

সকল প্রতিকূলতার মাঝেও চলতো অস্ত্র প্রশিক্ষণ; Image source: IWM (Q 53286)

. নেতৃত্ব দিতে শেখা

যুদ্ধের মাঝে যে কাউকেই নিজ কাঁধে নেতৃত্ব তুলে নেয়া লাগতে পারে। তাই যুদ্ধের আগে ট্রেনিং ক্যাম্পে সৈনিকদের শেখানো হয়, কীভাবে বিপদের মাঝে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কীভাবে সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে রেখে পথ তৈরি করে নিতে হয়। এসবই যুদ্ধের মাঠে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে যোদ্ধাদের সহায়তা করে।

. ঘর ও পরিবারকে বিদায় বলা

দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতির পর সৈনিকরা এবার প্রস্তুত যুদ্ধে যোগদানের জন্য। এই প্রস্তুতি তাদের প্রত্যেককে সাহসী যোদ্ধা করে তুলেছে। তাই সবাই নিজ নিজ পরিবারকে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে চলে যায় যুদ্ধের ময়দানে। কপাল ভালো হলে হয়তো যুদ্ধের পর আবার ফিরেও আসতে পারে।

এই ৮টি ধাপে ব্রিটিশ সরকার তাদের নাগরিকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলত। বলা যায় অধিকাংশ ব্রিটিশ নাগরিকই দেশ রক্ষায় নিজেদের বিলিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত ছিল।

This is a Bengali article which describes the recruitment process of British people during WW1.  All the references are hyperlinked inside the article. 

Featured Image: BBC

Related Articles