Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশ: স্বর্ণের সন্ধানে ক্যালিফোর্নিয়ায় জনস্রোত

স্বর্ণের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এর উৎপাদন যেহেতু সীমিত, তাই এর মূল্যও অনেক বেশি। আগের যুগে রাজপরিবারের সদস্যরা স্বর্ণের তৈরি অলংকার পরিধান করতেন, স্বর্ণমুদ্রার মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন করা হতো। এখনও নারীদের কাছে স্বর্ণালংকার পরম আকাঙ্ক্ষিত। সময়ের ব্যবধানে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, কিন্তু অন্যান্য কারণে এখনও স্বর্ণের চাহিদা আকাশছোঁয়া। অল্প পরিমাণ স্বর্ণেরও বেশ ভালো দাম থাকার কারণে আগের দিনগুলোতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দোকানে নিয়মিত চুরি-ডাকাতির খবর গণমাধ্যমে স্থান পেত, যদিও বর্তমানে উচ্চমাত্রার প্রযুক্তির কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক এগিয়ে যাওয়ায় এই ধরনের ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। স্বর্ণ এমন একটি ধাতু, যাকে ‘মূল্যবান’ হিসেবে গণ্য করা হয় পুরো বিশ্বজুড়ে।

Bxjvklb
স্বর্ণের প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই; image source: thoughtco.com

ধরুন, আপনি কোথাও শুনতে পেলেন, অমুক জায়গায় মাটি খুঁড়লেই স্বর্ণ পাওয়া যাচ্ছে। আপনি জানেন, ছোট এক টুকরো স্বর্ণ আপনার জীবন বদলে দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবে আপনি সেই জায়গায় গিয়ে স্বর্ণ খোঁজার প্রতি প্রলুব্ধ হবেন। আপনার ভাগ্য যদি ভালো থাকে, তাহলে আপনি স্বর্ণ পেয়েও যেতে পারেন। খানিকটা পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বর্ণপ্রাপ্তির পর যদি জীবনের বাকি সময় কোনো কাজ ছাড়াই বসে কাটিয়ে দেয়া যায়, তাহলে আপনি একটু ঝুঁকি নিতে কখনোই পিছপা হবেন না। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতেও একসময় এ ধরনের ‘মাটি খুঁড়ে স্বর্ণ পাওয়া’র গল্প ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। প্রথমদিকে সবাই ভেবেছিল, মানুষকে বোকা বানানোর জন্য বোধহয় এসব প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়টা এত গুরুত্বের সাথে দেখা হয় যে, স্বর্ণপ্রাপ্তি নিয়ে রীতিমতো মার্কিন আইনসভায় আলোচনা শুরু হয়। এরপর আমেরিকা বিভিন্ন প্রদেশ তো বটেই, চিলি, কলম্বো, এমনকি চীন থেকেও ভাগ্যসন্ধানী মানুষেরা ক্যালিফোর্নিয়ায় পাড়ি জমাতে শুরু করে। এ ঘটনাকেই ‘ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

Ugogohovk
স্বর্ণের দাম যেহেতু অনেক বেশি, তাই স্বাভাবিকভাবে স্বর্ণের জন্য মানুষ যুগে যুগে অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করেছে;
image source: takepart.com

জার্মান বংশোদ্ভূত সুইস নাগরিক জন সুটার আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্র্যামেন্তো নামক জায়গায় কলোনি স্থাপন করেছিলেন। তার কলোনিতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল কাঠ। তাই তিনি জেমস উইলসন মার্শাল নামের একজন ব্যক্তির শরণাপন্ন হন। মার্শাল পরামর্শ দেন, বাষ্পচালিত একটি স’ মিল তৈরি করতে হবে। ধনী ব্যক্তি জন সুটারের কাছ থেকে স’ মিল তৈরির অনুমোদন পাওয়ার পর মার্শাল একটি আদর্শ স’ মিল নির্মাণের কাজে নেমে পড়েন। ক্যালিফোর্নিয়ায় যেখানে উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছিল, তার আশেপাশের শত শত স্থানীয় সহজসরল রেড-ইন্ডিয়ান জাতিসত্ত্বার অন্তর্গত ব্যক্তিকে শ্রমিক বানিয়ে নির্মাণকাজ পরিচালনা করা হয়েছিল। নির্মাণকাজ তদারকির সময়ে জেমস মার্শাল নদীর তীরে একটি স্বর্ণের টুকরা খুঁজে পান। পরবর্তীতে স্বর্ণের টুকরা পাওয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এটা স্বর্ণ!” ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রথম স্বর্ণের সন্ধানপ্রাপ্তিত গল্পটা এমনই।

ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্র্যামেন্তো শহরে যখন জেমস উইলসন মার্শাল স্বর্ণের টুকরা খুঁজে পান, তখনও সেখানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও মেক্সিকোর মধ্যে যুদ্ধ চলছে। আমেরিকা সবদিক থেকেই মেক্সিকান সামরিক বাহিনীর তুলনায় এগিয়ে ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধে মেক্সিকানরা পরাজিত হয়। এরপর গুয়াদালিউপ হিদালগো চুক্তি অনুযায়ী মেক্সিকানরা অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ মেক্সিকো, নেভাডা এবং টেক্সাসের কিছু বিতর্কিত অঞ্চল আমেরিকার কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বর্ণ পাওয়া গেলেও বিবদমান আমেরিকা কিংবা মেক্সিকো– দু’পক্ষের কেউই আসলে স্বর্ণপ্রাপ্তির বিষয়ে জানত না। যদি জানত, তাহলে হয়তো মেক্সিকানরাও এই প্রদেশের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেত, এবং বিপরীতভাবে আমেরিকাও এই বিশাল সম্ভাবনাময় প্রদেশ দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠত। এভাবে হয়তো মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধ আরেকটু দীর্ঘায়িত হতো, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যেত।

Gdufkglv
জন সুটারের কারখানার কাজ করতে গিয়েই সর্বপ্রথম স্বর্ণ পাওয়া গিয়েছিল; image source: srs.fs.usda.gov

উপনিবেশের মালিক জন সুটার এবং তার অধীনে কাজ করা জেমস মার্শাল দুজনই চেয়েছিলেন বিষয়টি গোপন রাখতে। কিন্তু শ্রমিকদের মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। ১৮৪৮ সালের মার্চ মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি স্থানীয় গণমাধ্যমে স্বর্ণপ্রাপ্তির বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তখনও ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষের কাছে এটি ছিল নিছক ‘গুজব’। কয়েকদিন পর স্যাম ব্রানান নামের এক ব্যক্তি কৌতূহলী হয়ে মার্শালের সেই স’ মিলে যান এবং স্বর্ণের খোঁজ চালান। সৌভাগ্যক্রমে তিনি স্বর্ণের একটি টুকরো পেয়েও যান। তিনি যখন বাড়ি ফিরছিলেন, পথিমধ্যে স্বর্ণের টুকরাটি তিনি রাস্তার সবাইকে দেখাচ্ছিলেন। স্যাম ব্রানানের এই ঘটনায় পুরো ক্যালিফোর্নিয়ায় হৈচৈ শুরু হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার সামরিক গভর্নর রিচার্ড ম্যাসন স্ক্র্যামেন্টো শহরে স্বর্ণ পাওয়ার ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। পরে এই তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে আমেরিকার আইনসভায়ও আলোচনা হয়। এভাবে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বর্ণপ্রাপ্তির ঘটনা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

সবার আগে ক্যালিফোর্নিয়ার আশেপাশের মার্কিন প্রদেশগুলো থেকে মানুষজন আসতে শুরু করে। ওরেগন, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকো, চিলি ও পেরু থেকে অসংখ্য মানুষ ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মানুষ এত বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল যে অর্থ ধার করে, সারাজীবনের সঞ্চয় খরচ করে কিংবা নিজের একমাত্র ভিটামাটি বন্ধক রেখে হলেও ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার বন্দোবস্ত করে। বাচ্চাদের সামলানো ও নিজেদের কৃষিক্ষেত্রের ভার মহিলাদের ঘাড়ে চাপিয়ে পুরুষেরা ভাগ্য পরীক্ষার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ ও সান ফ্রান্সিসকো থেকে এত বেশি পুরুষ ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছিল যে সেখানে পড়ে থাকা কৃষিজমিগুলোতে আখ চাষের জন্য চীন ও জাপান থেকে কৃষিশ্রমিক ভাড়া করে আনতে হয়। ১৮৪৮ সালের মার্চে যেখানে ক্যালিফোর্নিয়ায় বাইরে থেকে আসা মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র একশো, সেখানে ১৮৪৯ সালের শেষের দিকে বাইরে থেকে আসা মানুষের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখে! এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় যে আমেরিকায় এই গোল্ড রাশ কী পরিমাণ সাড়া ফেলেছিল।

Ufigkbm
শিল্পীর তুলিতে ‘ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশ’; image source: thoughtco.com

১৮৫২ সালে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়েছিল। মাটি ও পাহাড় খননের জন্য ‘হাইড্রোলিক মাইনিং’ এর মতো নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হওয়ায় খনন কাজের গতি বৃদ্ধি পায়। তবে হুট করে অসংখ্য মানুষের আগমন এবং অপরিকল্পিত খননের জন্য বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। খনিতে যারা কাজ করত, তাদেরকে রাখা হতো ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে। এসব জায়গার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করতে গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া-প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছিল। পতিতাবৃত্তি, চুরি-ডাকাতির মতো সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৮৫০ এর দশকে প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থের সমপরিমাণ স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে স্বর্ণ উত্তোলনের পরিমাণ কমে যেতে থাকে। অপরিকল্পিত খননের জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার বেশ কিছু নদী ও এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল, তা বিলীন হয়ে যেতে শুরু করে। হাজার হাজার খনি শ্রমিকের খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা মেটাতে সান ফ্রান্সিসকোতে বিভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠে এবং কৃষির আধুনিকায়ন হয়। সবমিলিয়ে ‘ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশ’ ছিল উনিশ শতকে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যময় ঘটনাগুলোর একটি।

Related Articles