Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রোম সাম্রাজ্যের উত্থান (পর্ব-৩৯): ক্ষমতার পালাবদল-ডিক্টেটর সিজার

৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

সিজার তার নিজের শক্তি খতিয়ে দেখলেন। তার সাথে ৫,০০০ সৈন্য, বাকি দুই লিজিওন আল্পসের ওপারে। তার কোনো নৌবাহিনী নেই, রসদপত্রের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে একমাত্র গলের উপর। সিজারের সহকারী লিবেনাসও নানা কারণে অসন্তুষ্ট, সে সুযোগ পেলেই অপ্টিমেটদের দলে যোগ দেবে।

ধারে-ভারে পম্পেই অনেক এগিয়ে। তার সাথে রোমে তিনটি লিজিওন। হিস্পানিয়া আর মেসিডোনিয়াতে তার বিশাল বাহিনী, এশিয়া আর আফ্রিকার রোমান শাসকেরা সম্পূর্ণভাবে পম্পেইয়ের প্রতি অনুগত। রোমান নৌবাহিনীও পম্পেইয়ের নিয়ন্ত্রণে।

১০ জানুয়ারি।

সিসাল্পাইন গল থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে এলো এক ছোট রোমান সেনাদল। রুবিকন নদী, যা ইটালি আর গলের সীমানা নির্দেশ করছে, এর ধারে জড়ো হলো তারা। সিজার জানতেন রুবিকন পার হওয়া মানে রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। ক্ষণিকের জন্য সিজার ইতস্তত করলেন, পরক্ষণে সব দ্বিধা ঝেড়ে উচ্চারণ করলেন সেই বিখ্যাত বাক্য “Alea iacta est” (The die is cast/গুটি চালা হয়ে গেছে)। তিনি রুবিকন পার হয়ে গেলেন। আল্পস পার হয়ে তার অন্যান্য সেনারাও তার সাথে মিলিত হলো।  

রুবিকন অতিক্রম করছে রোমান সেনাদল; Image Source: etc.usf.edu

 

ইতালির বিভিন্ন শহর সিজারের সামনে দরজা উন্মুক্ত করে দিল। অ্যারিমিনিয়াম কোন প্রতিরোধ ছাড়াই তার হাতে চলে এলো। সিজার মার্ক অ্যান্টনির সাথে কিছু সেনা দিয়ে ভিয়া ক্যাসিয়ার দিকে পাঠালেন, সেখানে তিনি অ্যারেটিয়াম দখল করে রোমের দিকে ফিরলেন। সিজার দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে আরো বেশ কিছু শহর অধিকার করেন। সিজারের সমর্থকেরা ২,০০০ সেনার এক বাহিনী গঠন করে উত্তর ইতালির অনেক এলাকা জয় করে নেয়। দখলকৃত প্রতিটি শহরেই সিজার অত্যন্ত নমনীয় আচরণ করেন এবং যথেচ্ছ লুটপাট থেকে বিরত থাকেন। 

পম্পেইয়ের অনেক পুরোনো সেনা পুনরায় যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানাল। তারা শান্তিতে তাদের জমিতে চাষবাস করছিল, এবং অনেকেই ভুলে যায়নি সিজারের জমি পুনর্বন্টনের ফলে তাদের আজকের সমৃদ্ধি। পম্পেই সিনেটকে জানালেন সাকুল্যে ৩০,০০০ সেনা হয়তো তিনি সিজারের বিপক্ষে নামাতে পারবেন। সিনেট আতঙ্কিত হয়ে রোম ছেড়ে পম্পেইসহ তারা ব্রুন্দিসিয়ামের দিকে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে জাহাজে করে তারা চলে গেল এপিরাসে। সিজার ধাওয়া করেও তাদের ধরতে ব্যর্থ হন। তিনি রোমে ফিরে এসে এসে কোষাগার ভেঙ্গে সেনাদলের অর্থ সংস্থান করলেন। শহরে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হলো। এদিকে কাটো ছিলেন সিসিলিতে। সিজারের সমর্থক কিউরিও তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন। তারা সার্ডিনিয়াও দখল করে নেন। এরপর কিউরিও আফ্রিকার দিকে রওনা হলেন।

হিস্পানিয়া অভিযান

সিজার দ্রুত হিস্পানিয়াতে অভিযান চালাতে মনস্থ করলেন। সেখানে পম্পেইয়ের বাহিনীর নেতা আফ্রানিয়াস, পেট্রেয়ুস আর ভারো। উত্তর হিস্পানিয়াতে প্রায় ৩৫০০০ সেনা নিয়ে আফ্রানিয়াস আর পেট্রেয়ুস ইলার্দা নগরীতে একত্র হলেন, দক্ষিণে ছিলেন ভারো। সিজার পিরেনিজ পার হয়ে যান। যাত্রাপথে পম্পেইয়ের সমর্থক মেসালিয়া শহরে কিছু সেনা রেখে তিনি অবরোধ জারি করেন। এরপর  ঝড়ের গতিতে হিস্পানিয়া প্রবেশ করে আফ্রানিয়াস আর পেট্রেয়ুসকে ঘিরে ফেলেন। তারা সিজারকে ফাঁকি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে অগাস্টের ২ তারিখ তারা আত্মসমর্পণ করলেন। সিজার সেনাদল ভেঙে দিয়ে দুই কম্যান্ডারকে ছেড়ে দেন, তারা পম্পেইয়ের কাছে চলে যায়।

ইলার্দার যুদ্ধ; Image Source: simonturney.com

 

সিজার এবার রোমের দিকে ফিরতি পথ ধরলেন। পথিমধ্যে তিনি মেসালিয়ার অবরোধ সম্পূর্ণ করেন। শহরের পতনের পর ৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শরতে সিজার রোমে ফিরে এলেন।

মাসালিয়ার অবরোধ; © The Creative Assembly / SEGA

 

সিজার সামনে প্রথম কাজ ছিল পরের বছরের জন্য নিজেকে কন্সাল নিযুক্ত করা। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের এখতিয়ার একমাত্র দায়িত্বরত কন্সালদের, যারা পম্পেইয়ের সাথে পালিয়ে গেছে। সিজারের সামনে তাই আইনগত চ্যালেঞ্জ দেখা দিল। লেপিডাস তাকে পরামর্শ দিলেন ডিক্টেটরের অফিস পুনরুজ্জীবিত করে সেই ক্ষমতাবলে নির্বাচন দেয়ার। সিজার তা-ই করলেন। পরের বছরের জন্য কন্সাল হলেন তিনি নিজে আর আরেক পপুলেয়ার, ইসারিকাস। এরপর সিজার আইন করে সুলার প্রস্ক্রিপশনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সমস্ত বংশধরদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেন এবং পম্পেই কর্তৃক বহিষ্কৃত অনেক লোককে রোমে ডেকে পাঠালেন।তিনি ডিক্টেটরের পদও ছেড়ে দেন। সব কাজ শেষ করে সিজার সিদ্ধান্ত নিলেন পম্পেইয়ের মোকাবেলা করার।

এদিকে আফ্রিকাতে সিজারের সমর্থকেরা বিপর্যয়ের মুখে পড়ল। প্রথমে উটিকার কাছে তারা বিপক্ষ দলকে পরাজিত করলেও নুমিডিয়ার রাজা জুবা পম্পেইয়ের পক্ষ নিলে পাশার ছল উল্টে যায়। বাগ্রাডেস নদীর যুদ্ধে জুবা কিউরিওকে হত্যা করেন। এরপর কয়েক বছর আফ্রিকা ছিল অপ্টিমেটদের নিয়ন্ত্রণে। 

গ্রিসে সিজার (৪৯-৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

এদিকে গ্রিসে পম্পেই ৭,০০০ অশ্বারোহীসহ প্রায় পঞ্চাশ হাজারের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে ফেলেছে।সিরিয়া থেকে আরো সহায়তার আসছে। তার অধীনস্থ বিবুলাস জাহাজ নিয়ে অ্যাড্রিয়াটিকে পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে তার শক্তি সিজারের থেকে অনেক বেশি।

ব্রুন্দিসিয়ামে এসে সিজার সমস্যার মুখোমুখি হলেন। তার হাতে সম্পূর্ণ সেনাদল একবারে পরিবহনের জন্য উপযুক্ত সংখ্যক জাহাজ নেই। তদুপরি বিবুলাসের কারণে নিরাপদে সাগর পাড়ি দেবার নিশ্চয়তা শূন্যের কোঠায়। এমন পরিস্থিতিতে আশীর্বাদ হয়ে এল ঝড়। ঝড়ের সিজার মধ্যে সাগর পাড়ি দেবার চেষ্টা করবেন না ভেবে বিবুলাস নোঙর ফেলে বসেছিলেন, সেই সুযোগে ৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ১৫,০০০ সেনা নিয়ে সিজার এপিরাসের তীরে এসে পৌঁছলেন, বাকিদের রেখে আসলেন মার্ক অ্যান্টনির দায়িত্বে। সেখান থেকে দ্রুত তিনি অ্যাপোলোনিয়া দখল করে নেন। এদিকে তার জাহাজ ফিরতি পথে বিবুলাসের সামনে পড়লে তিনি অনেকগুলো ধ্বংস করে দেন। ফলে অ্যান্টনি ব্রুন্দিসিয়ামে আটকা পড়ে গেলেন।

সিজারের কাছে দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালানোর মতো যথেষ্ট রসদ ছিল না, তাই তিনি বন্দরনগরী ডিরাকিয়াম অধিকার করতে চাইলেন। সেখানে ঘাঁটি করতে পারলে রসদ যোগানো যাবে, আর সাগরের দিকে যাতায়াতের রাস্তা সহজ হবে। পম্পেই ছিলেন মেসিডোনিয়াতে। সিজারের মতলব বুঝে তিনি উল্কার বেগে ডিরাকিয়ামে এসে শহরে অবস্থান নিলেন। সুযোগ ফস্কে যাওয়ায় সিজার সেই বছর আর কিছু করলেন না।

এদিকে বিবুলাসের মৃত্যু হলে পম্পেইয়ের নৌবহরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই ফাঁকে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যান্টনি বাকি সেনাদের নিয়ে সিজারের সাথে একত্রিত হন। তারা ডিরাকিয়ামের কাছে সাগরপাড়ে পম্পেইকে অবরোধ করলেন। এখানে বেশ কয়েকবার লড়াই হয়। শেষ পর্যন্ত সিজার পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। তিনি পূর্বদিকে যাত্রা করেন। সেখানে তার অফিসার ক্যালভিনাসের নেতৃত্বে ছোট একটি সেনাদল সিরিয়া থেকে অপ্টিমেট সিপিও মেটেলাসের সাথে আগত পম্পেইয়ের সেনাদের সামনে পড়ে যাবার আশঙ্কা ছিল। সিজার ক্যালভিনাসকে নিয়ে থেসালির দিকে চলে গেলেন।

ডিরাকিয়ামের সিজ; Image Source: mikeanderson.biz

এই সময় পম্পেই চাইলে রোমে ফিরে গিয়ে ক্ষমতা নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি জানতেন সিজারের সাথে একটা এস্পার ওস্পার করতেই হবে, এখানেই তিনি তা করার ফয়সালা করলেন। তিনি থেসালির ফার্সালাস শহরের কাছে এসে ক্যাম্প করলেন। সিজার ছিলেন কাছেই।

সিজারের রসদপত্র ফুরিয়ে আসছিল। পম্পেই চাইলে অবরোধ জারি করে সিজারকে পরাজিত করতে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কম্যান্ডের সিদ্ধান্ত একা তার হাতে ছিল না। পালিয়ে আসা অনেক রোমান সিনেটর এ বিষয়ে নাক গলাতেন। তাদের চাপাচাপিতে পম্পেই সরাসরি লড়াইয়ে যেতে বাধ্য হন।

ব্যাটল অফ ফার্সালাস

সিজারের সৈন্য মাত্র ২২,০০০, যা পম্পেইয়ের অর্ধেকের কম। তদুপরি তার অশ্বারোহী দলে মাত্র ১,০০০ সেনা, যেখানে পম্পেই কম্যান্ড করছিলেন ৭,০০০ ঘোড়সওয়ারের বিরাট দল। পম্পেই ক্যাম্প করেছিলেন সিজারে থেকে উচ্চভূমিতে, ফলে অবস্থানগতভাবেও তার সেনারা সুবিধা পাচ্ছিল। সাত-পাঁচ ভেবে সিজার সিদ্ধান্ত নিলেন এখানে যুদ্ধ করা যাবে না, পম্পেইকে উস্কে দিয়ে তার অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে হবে। তাহলেই কেবল মোটামুটি সমানে সমান লড়াই চালান যাবে।

পম্পেই ও সিজারের অবস্থান; Image Source: emersonkent.com

 

যে-ই ভাবা সেই কাজ। পম্পেই সেনাদের রনবিন্যাসে সাজাতে সাজাতে লক্ষ্য করলেন সিজার শিবির গুটিয়ে সরে যাবার আয়োজন করছেন। তিনি সিজারকে পালাতে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কাজেই তিনি বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলেন। সিজার দেখতে পেলেন তার উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়েছে। পম্পেই উচু স্থান থেকে সমতলে নেমে এসেছেন। তিনি দ্রুত তার সেনাদের সন্নিবেশ করেন। বামবাহুতে অ্যান্টনি, মাঝে ক্যালভিনাস আর ডানে সিজার নিজে পম্পেইয়ের মুখোমুখি হলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পম্পেই তার অশ্বারোহী সেনার আধিক্য কাজে লাগাতে চাইবেন। সিজার তাই মধ্য ও বামবাহুর থেকে ৩,০০০ অভিজ্ঞ পদাতিক এনে ডানবাহুতে নিজের ঘোড়সওয়ারদের পেছনে মোতায়েন করেন।

শিঙ্গা বেজে উঠলে সিজারের পদাতিকেরা পম্পেইয়ের দিকে তেড়ে গেল। তারা বর্শা ছুঁড়ে মেরেই খোলা তরবারি হাতে অপ্টিমেটদের সেনাদলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে সিজারের প্রাক্তন অফিসার লিবেনাস ছিল পম্পেইয়ের সাথে। তার অধীনে অশ্বারোহীরা সিজারের ডান বাহুতে আক্রমণ চালাল। সিজার তাদের টেনে নিয়ে এলেন পেছন দিকে থাকা ৩,০০০ সেনার সামনে। এখান থেকে তীব্র পাল্টা আক্রমনে পম্পেইয়ের অশ্বারোহী বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সিজার এর সুবিধা নিয়ে অগ্রসর হলেন যাতে পম্পেইয়ের সেনাদলের মধ্যভাগ আর বামবাহুকে পেছন থেকে ঘিরে ফেলা যায়।

ফার্সালাসের যুদ্ধ; Image Source: weaponsandwarfare.com

 

পম্পেইয়ের প্রচন্ড চাপ সত্ত্বেও অ্যান্টনি আর ক্যালভিনাস নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। পম্পেইয়ের বামবাহুর পতনের পর সিজার সেদিক থেকে আঘাত করতে থাকলে একপর্যায়ে শত্রুবাহিনী হতোদ্যম হয়ে পড়ে। পম্পেই প্রথমে নিজের তাঁবুতে চলে যান। সেখান থেকে তিনি পালালেন উপকূলে, সেখান থেকে জাহাজ ধরেন ইজিপ্টের পথে। এদিকে সিজার পম্পেইয়ের সম্পূর্ণ বাহিনীকে পরাস্ত করেন। বেঁচে যাওয়া বেশিরভাগ সেনাকেই ক্ষমা করে দেয়া হলো, এমনকি বন্দি অপ্টিমেট সিনেটরদেরকেও। এদের একজন ছিলেন মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস (Marcus Junius Brutus)।   

পম্পেইয়ের মৃত্যু    

পম্পেই আশা করেছিলেন ইজিপ্টের শাসক ত্রয়োদশ টলেমি উত্তর আফ্রিকাতে নতুন করে সেনাদল গড়ে তুলতে সহায়তা করবেন। কিন্তু পরাজিত জেনারেলের সাথে গাঁটছড়া বাধা টলেমি বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেননি। ফলে পম্পেইকে হত্যা করা হলো। এককালের শ্রেষ্ঠ রোমান জেনারেলের জীবনাবসান হলো বিদেশ বিভূঁইয়ে, সেসব মানুষের হাতে যাদের তিনি বন্ধু মনে করেছিলেন। তার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে সংরক্ষণ করা হয়।

ক্লিওপেট্রা ও সিজার  

২ অক্টোবর, ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

ফার্সালাস থেকে বিজয়ী সিজার ইজিপ্টে এসে নামলেন। বলা হয়, পম্পেইয়ের মাথা তার সামনে প্রদর্শন করা হলে তিনি তার এককালের মিত্রর এই দুর্দশায় অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলেন এবং তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।

সিজার আলেক্সান্ড্রিয়ার রাজপ্রাসাদে উঠলেন। ইজিপ্টে তখন চলছিল গৃহবিবাদ। সাম্রাজ্যের ক্ষমতার দাবিতে একদিকে টলেমি, অন্যদিকে তার বোন সপ্তম ক্লিওপেট্রা। বলা হয়, সিজারের সাথে দেখা করতে ক্লিওপেট্রা গোল করে পাকানো কার্পেটের ভেতরে ঢুকে প্রাসাদে প্রবেশ করেন। যেভাবেই হোক না কেন সিজার ক্লিওপেট্রার পক্ষ নেন। টলেমি ক্ষুব্ধ হয়ে তার সেনাদের নিয়ে প্রাসাদ অবরোধ করলেন। সিজারের সাথে অল্প কিছু সৈন্য মাত্র, ফলে তিনি ও ক্লিওপেট্রা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। বলা হয়, এ সময় সিজার আর ক্লিওপেট্রার মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নয় মাস পর ক্লিওপেট্রার গর্ভে জন্ম হয় এক ছেলে সন্তান, যার নাম রাখা হয় সিজারিওন।

ব্যাটল অফ দ্য নাইল; Image Source: turningpointsoftheancientworld.com

এদিকে ছয় মাস পর ৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মার্চে পার্গামন থেকে মিথ্রিডেটস মিত্রবাহিনীর সহায়তা নিয়ে উপস্থিত হলে ব্যাটল অফ দ্য নাইলে রোমানরা টলেমিকে পরাজিত করে। টলেমি নদীতে ডুবে মারা যান।

শত্রুদের পরিপূর্ণ দমন

সিজার ৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের জন্য ডিক্টেটরের দায়িত্ব নেন। কিছু কিছু এলাকাতে তখনো অপ্টিমেটরা বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল। তবে প্রথমে তিনি এশিয়া মাইনরের দিকে যাত্রা করেন। সেখানে পন্টাসের বর্তমান শাসক ফার্নাসেস তার বাবা মিথ্রিডেটসের আমলের অনেক এলাকা রোমে গৃহযুদ্ধের সুযোগে ফিরিয়ে নিয়েছিল।এখানে যেলা শহরের কাছে সিজারের বাহিনী দ্রুত তাকে পরাস্ত করে। বিজয়ের দ্রুততা দেখে সিজার নাকি বলে উঠেছিলেন “Veni, Vidi, Vici” (এলাম, দেখলাম, জয় করলাম)। এরপর সিজার রোমে ফিরে এসে পরের বছরের জন্য নিজেকে কন্সাল নিযুক্ত করেন।

সিজারের পন্টাস অভিযান; Image Source: weaponsandwarfare.com

৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ডিসেম্বরে সিজার আফ্রিকাতে অবতরণ করেন। তার সাথে ছিল অল্প কিছু সেনা। আফ্রিকাতে অপ্টিমেটরা বড় এক সেনাদল জোগাড় করেছিল। তাদের নেতা ছিলেন সিপিও আর মূল জেনারেল লিবেনাস। পরের বছরের শুরুতে রাস্পিনা শহরের কাছে লিবেনাসের অধীনে অপ্টিমেট বাহিনী সিজারের সেনাদলকে পরাস্ত করে পিছু হটিয়ে দেয়। জুবা এই লড়াইয়ে লিবেনাসকে সহায়তা করেন। পরাজিত হলেও সিজার তার সেনাদল মোটামুটি অক্ষত রাখতে পেরেছিলেন। মৌরিতানিয়ার রাজা বোকাস আর তার রোমান জেনারেল সিটিয়াস সিজারের পক্ষ নেন। ক্যাটিলিনারিয়ান ষড়যন্ত্রের জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি রোম থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। বোকাস নুমিডিয়াতে আক্রমণ করেন, আর সিজার ইতালি থেকে আরো সেনা নিয়ে এসে বন্দরনগরী থ্যাপ্সাস অবরোধ করেন। সিপিও তাকে বাধা দিতে এসে রক্তক্ষয়ী এক লড়াইয়ে হেরে যান। এর সাথেই আফ্রিকাতে অপ্টিমেটদের প্রাধান্যের সমাপ্তি হয়। কাটো, যিনি উটিকার তত্ত্বাবধান করছিলেন, আত্মহত্যা করেন। অনেক অপ্টিমেট সমর্থক, এমনকি জুবাও তাকে অনুসরণ করেন। বাকিরা বন্দি হন, তাদের অনেককেই প্রাণদণ্ড দেয়া হল।    

থ্যাপ্সাসের সংঘর্ষ; Image Source: maryannbernal.blogspot.com

আফ্রিকা থেকে রোমে ফিরে এসেও বেশি দিন সিজার শান্তিতে থাকতে পারলেন না। লিবেনাস পালিয়ে হিস্পানিয়া চলে গিয়েছিলেন। সেখানে পম্পেইয়ের দুই ছেলের সাথে মিলে তিনি অবশিষ্ট অপ্টিমেটদের সংগঠিত করেন। শত্রুদের নির্মূল করতে ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষে সিজার হিস্পানিয়াতে এসে পৌঁছলেন। তার সাথে মৌরিতানিয়ান মিত্ররাও ছিল। ছোটখাট কিছু সংঘর্ষ শেষে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মুন্ডার প্রান্তরে দুই দল মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধকে সিজার বর্ণনা করেছেন তার জীবনের কঠিনতম লড়াই বলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লড়াই চলার পরেও কোনো ফলাফল না দেখে সিজার নিজেই ময়দানে নেমে পড়েন। দশম লিজিওনের অশ্বারোহীদের নিয়ে তিনি অপ্টিমেটদের বামবাহুকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হন। পম্পেইয়ের বড় ছেলে, পম্পিয়াস তখন অন্য বাহু থেকে অতিরিক্ত সেনা সেদিকে সরিয়ে আনলে তাদের ডানবাহু দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে মৌরিতানিয়ানরা সেদিক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। লিবেনাস পরিস্থিতি দেখে দ্রুত নতুন করে সেনাবিন্যাস করতে চাইলে সেনাদলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হল। অপ্টিমেটদের প্রতিরোধ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। লিবেনাস যুদ্ধের মাঠেই নিহত হন, পম্পিয়াস পালিয়ে যেতে পারলেও কিছুদিন পর তাকেও হত্যা করা হয়। পম্পেইয়ের ছোট ছেলে, সেক্সটাস নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হলো।

মুন্ডার লড়াই; Image Source: artstation.com

 

একনায়ক সিজার

জুলাই, ৪৬ থেকে মার্চ ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। দুই বছর সিজার রোমের একক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে তিনি আজীবনের জন্য ডিক্টেটরের ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে সিজার সম্রাট, বা ইম্পেরাতোর উপাধি নিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তার পদ ছিল ডিক্টেটর।

সিজার বুঝতে পেরেছিলেন রিপাবলিকান শাসনব্যবস্থা মেয়াদোউত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তিনি সুলা আর পম্পেইয়ের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। তারা দুজনেই একক ক্ষমতা প্রয়োগ না করে বার বার সিনেটের মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন, কিন্তু তা রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ করতে পারেনি। সুতরাং সিজার নিজের হাতে ধীরে ধীরে সমস্থ ক্ষমতা জড়ো করতে লাগলেন। সিনেটের সংখ্যা বাড়িয়ে ৯০০ করা হলো, যেখানে সিজারের বহু সমর্থককে বসানো হয়। সিজারের কথাই ছিল আইন, সিনেটের একমাত্র কাজ ছিল বাহ্যিকভাবে একে বৈধতা দেয়া। সিজার প্রচুর আইনগত ও সামাজিক সংস্কার করলেন। তার অধীনে কাজ করা সেনাদের বিভিন্ন প্রদেশে পুনর্বাসন করা হলো। ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৬৫ দিনের ক্যালেন্ডার চালু করা হয়। বিভিন্ন প্রদেশের আইনে সামঞ্জস্য আনার ব্যবস্থা নেয়া হয়। সিজার ধীরে ধীরে রোমকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সম্রাটকেন্দ্রিক শাসনের দিকে।   

দ্য আইদেস অফ মার্চ    

সিজারের একচ্ছত্র ক্ষমতায় অনেক প্রভাবশালী রোমান শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে তার পুরোনো অনেক সমর্থকও ছিল। তারা মনে করেছিল সিজার বিজয়ী হবার পর প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজাবেন। কিন্তু তার কাজকর্ম দেখে তারা বুঝতে পারলো সেরকম কোনো ইচ্ছাই তার নেই। তিনি চাইছেন রোমকে একক ব্যক্তির অধীনে পরিচালিত করতে।  ক্যাসিয়াস নামে পম্পেইয়ের প্রাক্তন এক সমর্থককে ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার প্রিটর নিয়োগ দেন। ক্যাসিয়াস সিজারকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকেন। তিনি প্রায় ৬০ জনের মতো সিনেটরকে দলে টেনে নেন। এদের মধ্যে ছিলেন ব্রুটাস, যিনি ফার্সালাসের পর সিজারের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। সিজারের দুই সমর্থক ট্রেবোনিয়াস আর ডেসিমাসও এই দলে ছিলেন। তারা ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১৫ মার্চ প্ল্যান বাস্তবায়নের তারিখ ঠিক করে। এই দিন রোমান ক্যালেন্ডারে আইদেস অফ মার্চ নামে পরিচিত ছিল। এদিন রোমানরা অনেক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করত। ১৫ মার্চ ঋণ পরিশোধের চূড়ান্ত সময়সীমাও ধরা হত। সিজার তখন ব্যস্ত পার্থিয়াতে হামলা করার পরিকল্পনা নিয়ে। তাদের হাতে ক্রাসুসের শোচনীয় পরাজয় রোমান গর্বে বিশাল আঘাত ছিল। সিজার এর প্রতিবিধান করতে চাচ্ছিলেন। তার প্রাণের উপর হামলা হতে পারে বলে তাকে সাবধান করা হলেও তিনি পাত্তা দেননি।

সিজারের মৃত্যু; Image Source: vox.com

১৫ মার্চ, ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

রোমের প্রদেশগুলোতে সিজারকে রাজা উপাধি দেয়ার আইন নিয়ে আলোচনার জন্য সিনেটের অধিবেশন বসেছে। নিয়ম অনুযায়ী সিজার ছিলেন নিরস্ত্র, কোনো দেহরক্ষিও তার সাথে ছিল না। ভরা মজলিশে তিনি বক্তব্য দেয়ার জন্যে দাঁড়ালেন। মুহূর্তেই চক্রান্তকারী সিনেটরেরা তাকে ঘিরে ফেলে। পোশাকের তলা থেকে লুকানো ছুরি বের করে তারা সিজারকে উপুর্যুপুরি আঘাত করে। রোমের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র লুটিয়ে পড়লেন পম্পেইয়ের মূর্তির পাদদেশে। বলা হয়, তার মুখের শেষ কথা ছিল “Et tu, Brute?” (তুমিও, ব্রুটাস?)।

Related Articles