Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হাজার বছরের পুরনো চীনের ভূগর্ভস্থ ‘গ্রেট ওয়াল’

চীনের প্রাচীন ইতিহাস থেকে দেখা যায়, উত্তরাঞ্চলীয় সং রাজবংশ (৯৬০-১১২৭ খ্রিষ্টাব্দ) প্রায় ২০০ বছর ধরে লিয়াও এবং জিন রাজবংশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। চীনের এই উত্তরাঞ্চল পুরোটাই সমতল ভূমি ছিল এবং এই অঞ্চলের মানুষগুলোও ছিলো সংখ্যালঘু। যুদ্ধে তাদের সাহায্যে আসার মতো তেমন কোনো পাহাড়-পর্বত বা নদীও এখানে ছিলো না। তাই প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে কিভাবে এই অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সংখ্যালঘু সং রাজবংশ এত দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত বিভিন্ন যুদ্ধে টিকে ছিলো? তাদের এই টিকে থাকার পেছনে সাহায্য করেছিলো তাদেরই তৈরি কিছু ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ। আসুন আজকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।

প্রাচীন সুড়ঙ্গপথের আবিষ্কার

১৯৪৮ সালের গ্রীষ্মকালে হেবেই প্রদেশের ইয়োংকিং গ্রামে হঠাৎ এক বড়সড় বন্যার সৃষ্টি হয়েছিলো। গ্রামের ভেতর দিয়ে দ্রুত বন্যার পানি ঢুকে পড়েছিলো। গ্রামবাসীরা হাতের কাছে যা পেয়েছিলেন তা-ই সম্বল হিসেবে নিয়ে জীবন বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালানো শুরু করেছিলেন।

সুড়ঙ্গপথের মুখ; Source: 9ccc.cc

কিন্তু হঠাৎ করেই তারা বিকট জোরে একটি আওয়াজ শুনতে পান। গ্রামবাসীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন বন্যার গতিপথ হঠাৎ করেই যেন পাল্টে গেছে। অর্থাৎ গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সেই পানি হুট করেই অন্যদিক দিয়ে বইতে শুরু করেছে। তারা আরো লক্ষ্য করলেন বন্যার পানির উচ্চতাও কমে গেছে। এবং তা দ্রুত আরো কমতে শুরু করেছে।

বন্যার পানির এমন অদ্ভুত আচরণে তারা যারপরনাই অবাক এবং কৌতূহলী হয়ে পড়েন। তারা অনুসন্ধান করা শুরু করেন। অবশেষে সেই রহস্যের সমাধান হয়। তারা গ্রামের একদম উত্তর দিকে একটি বড়সড় ভূগর্ভস্থ চলাচলের রাস্তা বা সুড়ঙ্গপথের আবিষ্কার করেন। এতদিন তারা জানতেনই না এধরনের কোন সুড়ঙ্গপথের ব্যাপারে।

সং রাজবংশের সামরিক কর্মকর্তার পুতুলরূপ; Source: wikimedia commons

বন্যার পানির চাপে এতদিনের অজানা সেই সুড়ঙ্গপথের উপরটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো ফলে সেদিক দিয়েই দিয়েই বন্যার পানি ঢুকে পড়েছিলো। যার ফলে বন্যার পানির গতিপথও হুট করে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো। যা একদিক দিয়ে গ্রামবাসীদের জন্য মঙ্গলই বয়ে এনেছিলো।

এরপর ১৯৫১ সালে ইয়োংকিং গ্রামের ঠিক ২.৫ কিলোমিটার দূরেই মাটির নিচে আরেকটি গুহার খোঁজ পাওয়া যায়। যার আকার ছিলো ১৫০ বর্গমিটারের মতো। ভূগর্ভস্থ সেই গুহায় মানুষের বসবাসের অনেক নমুনাও পাওয়া গিয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো গুহাটিতে ছিলো প্রায় ডজন খানেকের মত ছোট ছোট দরজা। সেগুলো দিয়ে মাটির ভেতর দিয়ে চলে গেছে আলাদা আলাদা সুড়ঙ্গপথ। এগুলো ঠিক ৩ বছর পূর্বে আবিষ্কার হওয়া ইয়োংকিং গ্রামের সুড়ঙ্গপথটির মতো। আবার বড়সড় এই সুরঙ্গপথগুলোর মাঝে মাঝেই দেখা গিয়েছে ছোট ছোট কুঁড়েঘর। পাশাপাশি সেখানে ছিলো অর্ধেক পোড়া মোমবাতি এবং ইটের তৈরি বিছানা; যেগুলোর উপরে কিছু কুপিও পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ বোঝা গেলো এখানে পূর্বে মানুষেরও বসবাস ছিলো!

অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে; Source: sohu.com

এরপর পুরোদমে অনুসন্ধান চালানো হয় পুরো ইয়োংকিং গ্রাম জুড়ে। সেই অনুসন্ধানের মাধ্যমে বের হয়ে আসে হাজার বছরের প্রাচীন সুড়ঙ্গপথগুলো ও তাদের বিস্তারের বিষয়টি। দেখা গেলো গ্রামটির পুরোটা জুড়েই ছড়িয়ে ছিলো এই ভূগর্ভস্থ পথগুলো। পরিমাপ করলে যার আকার প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার দাঁড়ায়।

কারা এই প্রাচীন সুড়ঙ্গপথ তৈরি করেছিলো?

বিশেষজ্ঞরা দেখলেন এই সুড়ঙ্গপথগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। এগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিলো যাতে প্রচুর পরিমাণে সৈন্য ধারণ করা যায়। পাশাপাশি পথগুলোর গঠনবিন্যাস ছিলো বেশ জটিল এবং পরিপূর্ণ। এগুলোতে রয়েছে লুকানো বের হওয়ার রাস্তা ও দরজা, নিজেকে আড়ালে রেখে মোকাবেলা করার মত দেয়াল ও স্তম্ভ, তালা দেওয়া যায় এমন ভারী দরজা ইত্যাদি।

যেকোনো বিপদে কিংবা দুর্যোগে নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার মত সুবিধাও এখানে ছিলো। যেমন এর ভেতরে বাতাস চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় ছিদ্র, বাতি রাখার দন্ড এবং ইটের তৈরি বিছানার দেখা পাওয়া গিয়েছিলো। সুড়ঙ্গপথগুলো তৈরিতে একধরণের নীল রঙের ইট ব্যবহার করা হয়েছিলো। যেগুলোর আকার ছিলো ৩০x৬০x৮ ঘন সেন্টিমিটার। ইটগুলো তৈরিতে সবচেয়ে উপযুক্ত মাটি ব্যবহার করা হয়েছিলো এবং সেগুলো অনেক উচ্চ তাপমাত্রায় পোড়ানো হয়েছিলো। যার কারণে ইটগুলো ছিলো বেশ মজবুত এবং কঠিন।

গুহামুখ; Source: mini.eastday.com

অনুসন্ধান চালিয়ে আরো যে তথ্য পাওয়া গেলো তা হলো, ইয়োংকিং গ্রামের এই নীল ইটগুলো এবং সং রাজবংশের অন্তর্গত কিগাং ও জিয়োং প্রদেশের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথে পাওয়া নীল ইটগুলো একই প্রকারের। অর্থাৎ এই প্রদেশগুলোর সুড়ঙ্গপথগুলো যে একই সময় ও পরিকল্পনার ফল তা বোঝা গেলো। আর এ ধরনের বিস্তৃত সুড়ঙ্গপথ তৈরি ও পরিচালনার জন্য ব্যাপক ইটের দরকার ছিলো। তাই ধারণা করা হচ্ছে এই প্রাচীন সুড়ঙ্গপথগুলো তৈরি করা হয়েছিলো তৎকালীন রাজবংশীয় নির্দেশে এবং পুরো রাজ্য জুড়ে।

সব মিলিয়ে কতখানি জুড়ে ছিলো সেই পথগুলো?

প্রাচীন ইটের সুড়ঙ্গপথ; Source: ancient-origins.com

বিশেষজ্ঞরা অনুসন্ধানের কাজে এধরণের কিছু সুড়ঙ্গপথ খুঁড়ে দেখেছিলেন ইয়োংকিং, জিয়োং এবং বাঝৌ প্রদেশে। প্রাচীন এই সুরঙ্গপথগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে গিয়েছে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার, উত্তর থেকে দক্ষিণে তা ২৫ কিলোমিটার। যা ছড়িয়েছে ১,৬০০ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, সং এবং লিয়াও রাজবংশের বিস্তারের সাথেসাথে পশ্চিমের রংছেং ও জুশুই প্রদেশগুলোতেও এই সুড়ঙ্গপথগুলো ছড়িয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সেগুলো আসলেই কি ছড়িয়েছিলো বা ছড়ালেও তা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তা এখনো বের করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

কেন তৈরি করা হয়েছিলো সুড়ঙ্গপথগুলো?

এখন আসা যাক মূল বিষয়ে। এই রহস্যময় সুরঙ্গপথগুলো এত জনবল, পরিকল্পনা এবং অর্থ খরচ করে কেন তৈরি করা হয়েছিলো? এই ব্যাপারে যদিও বিশেষজ্ঞদের মতভেদ রয়েছে তবে ভূগর্ভস্থ এই নেটওয়ার্কগুলো নিয়ে প্রচলিত রয়েছে অনেক মতবাদ। একটি মতবাদ থেকে পাওয়া যায় এই প্রাচীন ভূগর্ভস্থ পথগুলো তৈরি করেছিলেন জেনারেল ইয়াং এবং তার পরিবার। পরপর তিন প্রজন্মে যে পরিবার থেকেই উত্থান হয়েছিলো তিনজন শক্তিশালী জেনারেলের।

একজন জেনারেল; Source: sina.cn

আরেকটি মতবাদে বলা হয়েছে, জেনারেল ইয়াং লিউলাং এই সুরঙ্গপথগুলো তৈরি করেছিলেন নিজেদের সীমানা প্রতিহত করতে। বলা হয় ৯৬০-১১২৭ খ্রিস্টাব্দে লিয়াও রাজবংশের সৈন্যদল ইয়োংকিং প্রদেশের উত্তরাঞ্চল এবং সেখানকার জমিজমা বেশ কঠোরভাবে পাহারা দিতো। তাই ইয়াং লিউলাং এই ভূগর্ভস্থ পথগুলোতে নিজের সৈন্যদল লুকিয়ে রাখতেন। পাশাপাশি উপযুক্ত পরিস্থিতিতে সৈন্যরা দ্রুত লুকিয়ে গিয়ে লিয়াও সৈন্যদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতেও পারতো।

বিশেষজ্ঞরা আরো ধারণা করেন, প্রাচীন চীনে এই ভূগর্ভস্থ পথগুলো ব্যবহার করা হতো যুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের আক্রমণ করার কাজেও। সৈন্যরা লুকিয়ে দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে পারতো শত্রুদের অজান্তেই। শত্রুদের পেছনে গিয়ে হাজির হতে বা উপযুক্ত কোনো স্থানে হুট করে বের হয়ে আক্রমণ করতেও এই পথগুলো বেশ কাজে আসতো।

সেখান থেকে পাওয়া কিছু নিদর্শন; Source: sohu.com

সেই সময়ে যুদ্ধ প্রতিহত করতে এবং শত্রুদের আগমন বাধাগ্রস্ত করতে বিশেষ করে অশ্বারোহী সৈন্যদলের আক্রমণ প্রতিহত করতে বিভিন্ন পাহাড়-পর্বতের ধার ঘেঁষে এবং নদীর ধারে বিরাট বিরাট সুদীর্ঘ দেয়াল তৈরি করা হতো। উদাহরণস্বরূপ চীনের বিখ্যাত সেই ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’-র কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু অন্যান্য সমতল ভূখণ্ডে এধরণের আক্রমণ প্রতিহত করা ছিলো অনেকখানি দুঃসাধ্য। তাই এরকম ভূগর্ভস্থ পথগুলো সৈন্যদের সাহায্য করতো লুকিয়ে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে এবং পালিয়ে যেতে।

এভাবে নিজেদের প্রতিহত করা এবং লুকিয়ে আক্রমণ করার সুবিধার জন্য এই প্রাচীন সুড়ঙ্গপথগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এদের নাম দেওয়া হয় চীনের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রেট ওয়াল’ নামে।

ফিচার ইমেজ: pxhere.com

Related Articles