Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হাজার মানুষের জীবন বাঁচানো এক মানচিত্রের গল্প

চোখ বন্ধ করে লণ্ডনের কোনো একটা জায়গার কথা ভাবুন। আপনার কল্পনায় নিশ্চয়ই জাদুঘরে তুলে রাখার মতো বাড়িঘর, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, ছাতা মাথায় ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে হেঁটে চলা সাহেব মেমের দল চলে আসবে। লন্ডন কিন্তু সবসময় এমনটা ছিল না। খুব বেশি দিন আগে নয়, ঊনবিংশ শতকেই লন্ডনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বিসহ অবস্থা ছিল।

লন্ডনের একটি জেলা সোহো। তখনো লন্ডনের নর্দমা গিয়ে পৌঁছায়নি সোহোতে। রাস্তার ধারে অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা গোয়াল, কসাইখানা, উঠতি কলকারখানার তেল-ময়লা পড়ে থাকতো। আদ্যিকালের হাড় জিরজিরে নর্দমাগুলো এসব আর বয়ে নিতে পারছিল না। প্রায় নর্দমা উপচে পড়তো ময়লা। কোথাও পাইপ চুঁইয়ে ময়লা বের হত। এসব আবর্জনায় দিনের পর দিন বিরক্ত হয়ে লন্ডনের কর্তারা ভাবলো, ড্রেনগুলোকে সোজা টেমস নদীতে গিয়ে ফেললেই হয়। হাজার হোক, নদী বলে কথা। কথায় বলে, নদীর জল ঘোলাও ভালো। ওসব ময়লা নদীর পানিতে দাঁড়াবে না।

ওদিকে টেমস নদীর সাথে যোগাযোগ ছিল পুরো লন্ডনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার। যে লন্ডন এর মাঝেই ধারাবাহিক কলেরার শিকার, তার রোজকার, গোসল খাওয়ার পানিতে মিশে গেল বর্জ্য। পানির পাইপে, বোতলে করে ছড়িয়ে পড়লো রেস্তোরা, বার আর মানুষের বসতবাড়িতে। এরপর আর কলেরা ঠেকায় কে? ১৮৩২ সাল থেকে শুরু করে কলেরায় মারা যাওয়া লোকের সংখ্যা প্রায় ১৫,০০০।

মিয়াজমা বা রোগবাহী বাতাস; image source: Stuff to Blow Mind

লুই পাস্তুর তখনও জীবাণু নিয়ে মানুষের সামনে কথা বলতে শুরু করেননি। মানুষের বিশ্বাস ছিলো কলেরা হয় ‘মিয়াজমা’র কারণে। মিয়াজমার ধারণা বহুদিন যাবত চলে আসছিল। বাতাসে ভাসতে থাকা মিয়াজমা কণিকা, উৎপন্ন হয় আমাদের আশেপাশের পচে যাওয়া জৈব পদার্থের উৎকট গন্ধ থেকে।

মিয়াজমা তত্ত্বের বহু তাত্ত্বিক আর অনুসারী ছিল। ডা. উইলিয়াম ফার বিশ্বাস করতেন, লন্ডনের মিয়াজমা তৈরির বিশাল কেন্দ্র টেমস নদীর পার্শ্ববর্তী মাটি। এই মাটিতে বিভিন্ন ময়লা ছড়িয়ে থাকে, যা পচে মিয়াজমা তৈরি হয়ে শহরব্যাপী ছড়ায়। মিয়াজমার ধারণায়, এই বাতাসে ভাসতে থাকা কণাগুলো যে মানুষকে ছুঁয়ে যায়, সে-ই আক্রান্ত হয় কলেরায়।

অন্যদিকে জীবাণু তত্ত্ব এমন সময় এসেছিল, যখন জীবাণু আবিষ্কৃতই হয়নি। ডাক্তার জন স্নো বুঝতে পেরেছিলেন, কলেরা রোগ হাওয়ায় ছড়াচ্ছে না। তিনি জীবাণু তত্ত্ব দিয়েছিলেন। সেখানে দেখানো হয়, মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে পানির মাধ্যমে। আর এর সবই প্রমাণ করেছিলেন একটি মানচিত্র দিয়ে, সেই মানচিত্র যা পরবর্তীতে হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচায়।

১৯৫৪ সালের ৩১ আগস্ট সোহোর ব্রডস্ট্রিটে বিশাল আকারে কলেরার মহামারি দেখা দিল। জন স্নোর মতে, ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা কলেরার মহামারির মাঝে এটা সবচাইতে ভয়ানক ছিল। তিন দিনের মাঝে ১২৭ জন আর দশ দিনে পাঁচশোর বেশি মানুষ মারা গেল কলেরায়। মৃত্যুর হার দাঁড়ালো ১২ শতাংশ।

ব্রডস্ট্রিট পাম্পের অবস্থান,পাশের বিন্দুদিয়ে কলেরার প্রকোপ বুঝানো হয়েছে; image source: A bit of cs4fn

হেনরি হোয়াইটহেড, যিনি কি না আগে মিয়াজমা তত্ত্বের ভক্ত ছিলেন, তিনিও জন স্নোর জীবাণু তত্ত্বের সমর্থক হয়ে পড়েন। তার সাহায্যে স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে স্নো আক্রান্তদের মাঝে একধরনের মিল পেলেন, আসলে এমন কিছুই তিনি খুঁজছিলেন। ব্রডস্ট্রিটের এক পাম্প থেকে এদের সবার বাসায় পানি যায়। কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষায় স্নো এই পানির কোনো দোষ বের করতে পারেননি। অথচ তার কাছে প্রমাণ ছিল, এই পাম্পের পানি নিয়মিত বা কখনো কখনো পান করে এমন মানুষেরাই আক্রান্ত। কিছু বাসায় দেখা গেল শুধু বাচ্চারা অসুস্থ। তারা ব্রডস্ট্রিটের স্কুলে যেত, আর কাছাকাছি থাকায় ওখানকার পাম্প থেকেই পানি নিত। এক বাসার বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে মারা গেলে স্নো তার ছেলের সাথে কথা বলে জানলেন, তার মা ওই পাম্পের পানি পান করতেন। তার কাছে ভালোই লাগতো ওই পানি। শুধু মায়ের জন্য ছেলে ওখান থেকে মাঝে মাঝে পানি আনতো।

এই পাম্পটি অবস্থিত ছিল পুরোনো এক সেপটিক ট্যাংকের মাত্র তিন ফুট উপরে। সেপটিক ট্যাংক ততদিনে তার কলেরার জীবাণু ছড়াতে শুরু করেছিল। বোর্ড অব গার্ডিয়ান্সের সাথে সাক্ষাতকারে স্নো তার সব যুক্তি বুঝিয়ে বলেন। পানিতেই কিছু একটা আছে এমন নিশ্চিত করার পর কর্তৃপক্ষ পাম্পটির হাতল সরিয়ে একে অকার্যকর করে দেয়। বিশ্বাস করা হয়, এই কারণেই সেবারের মতো বেঁচে গিয়েছিল অনেকে।

কর্তৃপক্ষ পাম্পটির হাতল সরিয়ে একে অকার্যকর করে দেয়; image source: UCLA Fielding School of Public Health

এরপর স্নো বিন্দু দিয়ে একধরনের মানচিত্র তৈরি করেন। পাম্পের আশেপাশের মানুষের কলেরা আক্রান্ত হওয়ার সাথে দূরের মানুষের তুলনা ছাড়াও ভূতাত্ত্বিক কোনো স্থাপনার সাথে কলেরার এমন সম্পর্ক নির্ধারণ করতে চাওয়া বিশেষ ধরনের ডায়াগ্রামের মাঝে পড়তো। তিনি প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা পানির পাম্পের অবস্থান চিহ্নিত করেন। সেগুলোর পাশে বিন্দু দিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা চিহ্নিত করেন। আলাদা আলাদা পানি সরবরাহকারীদের ক্রেতাদের মাঝে একটা তুলনা দাঁড় করান। এই মানচিত্রেও ধরা পড়ে ব্রডস্ট্রিটের পাম্পটি থেকে পানি নেয়া মানুষগুলোই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।  

ব্যতিক্রম দেখা গেল ব্রডস্ট্রিটের এক পানশালায়। সেখানকার বিয়ারের সাথে পানি মেশানো হতো, অথচ সেখান থেকে পান করে কেউ আক্রান্ত হয়েছে এমন খবর পাওয়া গেল না। অনুসন্ধানে জানা যায়, পানি মেশানোর পর বিয়ার ফুটানো হত। সম্ভবত এই কারণেই কারোর কিছু হয়নি।

স্নোর মানচিত্রে আরো ধরা পড়লো, সাউথওয়ার্ক ও ভক্সহল নামের দুটো কোম্পানি তাদের ক্রেতাদের টেমস থেকে আসা নর্দমার দূষিত পানি পান করাচ্ছে। তাদের ক্রেতাদের মাঝেও কলেরার প্রকোপ দেখা যায়। স্নোর কলেরা মানচিত্র স্বাস্থ্যের সাথে ভূগোলের সম্পর্ক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সেই গল্পের মতো কলেরা পালালে কর্তৃপক্ষ আবার পাম্পের হাতল লাগিয়ে দিল। মনে মনে যদিও বা তারা জানতো স্নোর কথা সত্যি, কিন্তু তার তত্ত্ব মেনে নেওয়া মানে ‘মানুষ মলবাহিত জীবাণু খাচ্ছে, আর তা দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে’। এ বিষয় তখন তাদের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। কলেরার পুনরায় আক্রমণ হতে পারে জেনেও তারা নিজেদের অস্বস্তিকে বেশি গুরুত্ব দিলেন। মানুষ দুমুখো আচরণ শুরু করলো। মুখে তারা মানতে চাইতো না স্নোর তত্ত্ব, এদিকে পাম্প থেকে পানি নিতেও কেউ যেত না। ফলে ১৮৫৪ এর মতো ভয়ানক মড়ক লাগলো না। অনেক বিচার বিশ্লেষণ শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৮৫৪ সালের মহামারির দোষ চাপালো বেচারা মিয়াজমার কাঁধে।

১৮৬৬ সালে আরেকজন ডাক্তার এডুইন ল্যাঙ্কেস্টার ১৮৫৪ সালের কলেরা মহামারি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। স্নোর মানচিত্র দেখার পর তিনি নিশ্চিত হন, স্নো অসুখের কারণটা অন্তত নির্ভুলভাবে বুঝতে পেরেছিল। তার বুদ্ধিদীপ্ত ম্যাপ সত্য কথা বলছে। ল্যাঙ্কেস্টার স্নোর সাথে একমত ছিলেন যে, পাম্পটা দূষিত পানি ছড়াতো। মানুষ স্নোর মতোই ল্যাঙ্কেস্টারকে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু এরপর তাকে ঐ এলাকার প্রথম মেডিকেল অফিসার করা হয়।

পাম্পের রেপ্লিকা; image source: golondon.info

পৃথিবী বদলে গেছে। আজ মানুষ জানে কলেরা কেন হয়, কীভাবে হয়, কোন ওষুধ এর প্রতিষেধক এমন সব তথ্যই। ব্রডস্ট্রিটের বাসিন্দারা জানে, জন স্নো ঠিক ছিলেন, ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। ১৯৯২ সালে ১৮৫৪ সালের সেই পাম্পটির জায়গায় আসল পাম্পের একটি রেপ্লিকা স্থাপন করা হয়। প্রতিবছর জন স্নো সোসাইটি আয়োজন করে ‘পাম্পের হাতল বক্তৃতা’। তার স্মরণে পাম্পের হাতল খুলে নিয়ে লাগানোর একটা অনুষ্ঠানও করতো তারা। কুখ্যাত সেই পাম্প অথবা হার না মানা জন স্নোর স্মৃতিচিহ্নকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টাও করেছে নগর কর্তৃপক্ষ। কৌতূহলী পর্যটককে আজও সেখানে পথ দেখিয়ে দেয় লাল গ্রানাইট পাথর।

ফিচার ইমেজ: Youtube

Related Articles