মানবজাতির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত আফ্রিকা মহাদেশে যেমন অজস্র ভাষা আর শত শত ঐতিহ্যবাহী ধর্মের সম্মিলন ঘটেছে, তেমনিভাবে সেখানকার সৌন্দর্য আর সম্ভাবনা টানে আগমন ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের। রাষ্ট্র বলতে আমরা যে রাজনৈতিক কাঠামোকে বুঝে থাকি আধুনিককালে, তার সূচনাও হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশে। সাহারা মরুভূমির মাধ্যমে দ্বিধাবিভক্ত আফ্রিকা মহাদেশের সাথে এশিয়ার মানুষদের সুদূর অতীত থেকেই যোগাযোগ থাকলেও ইউরোপের সাথে এর যোগাযোগ স্থাপিত হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে।
শুরুতে বাণিজ্যের প্রয়োজনে আসা ইউরোপীয়রা একসময় দক্ষ প্রশাসন আর প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী দ্বারা উপনিবেশ করে আফ্রিকা মহাদেশের সবগুলো দেশকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো বছর আফ্রিকাকে বিভিন্নভাবে শোষণ করেছে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো, আফ্রিকা সরাসরি ইউরোপের রাজনৈতিক শাসনের অধীনে ছিল একশো বছরেরও বেশি সময়।
কেন এসেছিল ইউরোপীয়রা?
পঞ্চদশ শতাব্দীতে পর্তুগালের রাজপুত্র হেনরির আগমন ঘটে আফ্রিকা মহাদেশে, ইউরোপের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয় আফ্রিকার। কাছাকাছি সময়ে ইউরোপীয় বণিকেরা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে, অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপকে যুক্ত করে পৃথিবীর সবগুলো অংশের সাথে। এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অংশে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই উপনিবেশ স্থাপন শুরু করলেও আফ্রিকাতে প্রক্রিয়া শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে। শুরুর দিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রহের মধ্যে ছিল আফ্রিকার সমুদ্র বন্দরগুলো নিয়ন্ত্রণ করা, এশিয়ার সাথে নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য রুট তৈরি করে দেওয়া দেশীয় বণিকরা।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে আফ্রিকাতে আসার পর ইউরোপীয়রা মূলত জড়িয়ে পড়ে দাস ব্যবসার সাথে, আফ্রিকানদের বন্দী করে বিক্রি করে দেওয়া হয় উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা আর ক্যারিবীয় অঞ্চলগুলোতে। আফ্রিকান দাসদের প্রতি ইউরোপীয়দের আচরণ মানবসভ্যতার নিষ্ঠুরতম অধ্যায়গুলোর একটি, আধুনিক যুগে একে ব্যাখ্যা করা যায় জাতিগত নিধনের চেষ্টা হিসেবেও। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে রেনেসাঁর প্রভাবে স্বাধীনতা অর্জন আর যুক্তরাষ্ট্রে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ ইতি টানে ইউরোপীয়দের দাস ব্যবসায়।
উপনিবেশ শাসন
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ বদলে যায়, একে একে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। মোটা দাগে ১৮৮১ সাল থেকে উপনিবেশ স্থাপনের এ প্রতিযোগিতা চলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত, ইতিহাসে তা পরিচিতি পায় ‘স্ক্র্যাম্বল অভ আফ্রিকা’ নামে। তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রায় সবগুলোই অংশ নেয় ১৮৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনে, আফ্রিকাতে উপনিবেশ স্থাপন করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। এ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পেছনে অনেকগুলো স্বার্থের দ্বন্দ্ব ভূমিকা রেখেছে, ভূমিকা রেখেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণ।
কাঁচামালের যোগান ও বাজারের সন্ধান
ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার প্রাথমিক কারণ ছিল ব্যবসা করা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের সাথে ইউরোপকে যুক্ত করা। পরবর্তী কয়েক শতকের মধ্যে ইউরোপের অর্থনীতি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়, বৃদ্ধি পায় এশিয়ার সাথে বাণিজ্য। এর মধ্যেই ইউরোপে শিল্প বিপ্লব হয়, দ্রুত বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক পণ্যের উৎপাদন। এ পণ্য উৎপাদনের জন্য যেমন কাঁচামালের প্রয়োজন ছিল, তেমনিভাবে প্রয়োজন ছিল উৎপাদিত পণ্যের জন্য বাজার খুঁজে বের করা। আফ্রিকার কৃষিপ্রধান অর্থনীতি সে কাঁচামাল যোগানের মাধ্যম হয়েছে। উপনিবেশ স্থাপন করে ইউরোপীয় শক্তিগুলো বিস্তৃত করেছিল নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার।
জাতীয়তাবাদের উত্থান
ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিতে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, তৈরি হয় একে-অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাড়না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উত্থান ঘটা জাতীয়তাবাদীদের সন্তুষ্ট করতেও রাষ্ট্রগুলো উপনিবেশ বিস্তারের দিকে এগিয়ে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় ইউরোপীয় দেশগুলোত মধ্যে আধুনিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তৈরি করতে হয় বড় আকারের সামরিক বাহিনী। আফ্রিকা মহাদেশকে উপনিবেশ করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় শক্তিগুলো উদ্ভাবিত নতুন অস্ত্রগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষার সুযোগ পায়, নিজেদের অধীনে থাকা বিশাল সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানোর সু্যোগ পায়, সন্তুষ্ট করে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকেও।
প্রাকৃতিক সম্পদ
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আধার আফ্রিকা মহাদেশের প্রতি ইউরোপের আগ্রহের অন্যতম কারণ ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ। তেল ও গ্যাসের উৎস ছিল আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলো, ক্যামেরুন, সাদ, কঙ্গোর মতো দেশগুলো। হীরকও পাওয়া যেত আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে। সোনা, নিকেল, ইউরেনিয়াম, আকরিক লোহা, অ্যালুমিনিয়ামের মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের যোগান দিয়েছে আফ্রিকা মহাদেশ, পশ্চিম সাহারায় পাওয়া যেত ফসফেট, কপারের মতো খনিজ পদার্থ। এই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের উপস্থিতি আফ্রিকা মহাদেশকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
আবার, আটলান্টিক রেভ্যলুশনের পর থেকেই ইউরোপ শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের মধ্যে গিয়ে গিয়েছে, বিভিন্ন দেশে সংস্কারপন্থীদের মাধ্যমে হয়েছে বিপ্লব। ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধও তখন তুঙ্গে ওঠে, ধর্মীয় বিরোধগুলো বিভিন্নভাবে ধারণ করতে থাকে সহিংস রূপ। এ অনিশ্চয়তা আর ধর্মীয় সংঘাতের শঙ্কা থেকে বাঁচতেও অনেক ইউরোপীয় পাড়ি জমায় আফ্রিকা মহাদেশে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে শান্তির সন্ধানে।
খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার
খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেও ইউরোপীয় শক্তিগুলোর আগমন ঘটে আফ্রিকাতে। আফ্রিকা মহাদেশে খ্রিষ্টান ধর্মের আগমন ঘটে প্রথম শতাব্দীতেই, বিস্তৃত হয় উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলোতে। পরবর্তী সময়ে, সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের বিকাশ ঘটে আফ্রিকায়, বিস্তৃত হয় আফ্রিকার বড় একটা অংশ জুড়ে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে নিজেদের উপনিবেশ শাসনের নৈতিক বৈধতা অর্জনের জন্য করেছে ধর্মপ্রচারের কাজও। ফলে, আফ্রিকাতে পঞ্চদশ শতাব্দীতে পর্তুগালের আগমনের সাথে সাথে আগমন ঘটে খ্রিষ্টান মিশনারিদেরও।
ফ্রান্স থেকে শুরুতেই আসেন চল্লিশ হাজার মিশনারি, যারা পরে ছড়িয়ে পড়েন আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে। ইউরোপ থেকে আগত মিশনারিরা আফ্রিকায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, গড়ে তোলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল। সময়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন ভূমি দখল আর ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজেও। এই মিশনারিদের স্বার্থ আর পোপের রাজনৈতিক নেতৃত্বও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে আফ্রিকার উপনিবেশায়নে।
সম্পদ আর জনসংখ্যার অসামঞ্জস্য
ম্যালথাসের সম্পদ আর জনসংখ্যা বিষয়ক তত্ত্বের ধ্রুপদী উদাহরণ হিসেবে আবির্ভূত হয় অষ্টাদশ আর ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপ। একদিকে শিল্প বিপ্লবের ফলে বাড়ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বড় হচ্ছিল অর্থনীতির আকার, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ইউরোপের জনসংখ্যা। এই বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ঘটাতে হয় ইউরোপীয় দেশগুলো, উপনিবেশ স্থাপন করে এশিয়া আর আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অভিবাসী হওয়া ইউরোপীয়রা আফ্রিকাতে এসে পায় ভূমির দখল, চর্চার সুযোগ পায় রাজনৈতিক ক্ষমতা। জনসংখ্যার এই বিকেন্দ্রীকরণ অভিবাসী হওয়া ইউরোপীয়দের এবং মূল ভূখণ্ডে থাকা ইউরোপীয়দের জীবনমান বাড়ায়।
নিজেদের নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়নের এ প্রচেষ্টাও ভূমিকা রাখে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টাকে জ্বালানি দিতে।
আফ্রিকানদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা
এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ধারণা, আফ্রিকাতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়, মানবসভ্যতার প্রথম রাষ্ট্র ছিল বর্তমান ইথিওপিয়া ও মিশরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রটি। সুদীর্ঘকাল থেকে আফ্রিকাতে রাষ্ট্রকাঠামো ও রাজনীতির চর্চা থাকলেও, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে বারবারই ব্যর্থ হয়েছে আফ্রিকার দেশগুলো। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার পরেও একটা দীর্ঘ সময় স্বাধীনতা ছিল আফ্রিকানদের, ম্যালেরিয়ার ভয়ে ইউরোপীয়দের দখলদারিত্ব সীমাবদ্ধ ছিল সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতেই। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করার জন্য কয়েক শতাব্দী সময় পেলেও সেটা কাজে লাগায়নি আফ্রিকানরা, ব্যবহার করতে পারেনি প্রকৃতিপ্রদত্ত ভৌগোলিক সুবিধাগুলো। উপনিবেশ শাসনের অধীনে যাওয়ার পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ এটাই- সময়ের সাথে নিজেদের পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়েছিল আফ্রিকানরা, ব্যর্থ হয়েছিল নিজেদের সামষ্টিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
প্রায় একই কারণে ইউরোপের উপনিবেশ শাসনের অধীনে গেছে এশিয়া মহাদেশের বড় একটা অংশ, ইউরোপের উপনিবেশ শাসনের অধীনে ছিল উত্তর আমেরিকা আর দক্ষিণ আমেরিকার বড় একটা অংশ। উপনিবেশ শাসনের অধীনে যাওয়া অঞ্চলগুলোর লোকেরা পরাধীনতার সময়টাকে দেখতে চায় দুর্ভাগ্য হিসেবে, এড়িয়ে যেতে চায় সময়ের সাথে নিজেদের পরিবর্তন করে নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যর্থতাকে। এ ব্যর্থতাকে স্বীকার না করার প্রবণতা এখনো আছে উক্ত দেশগুলোতে। তারা বারবার যাচ্ছে স্বৈরতন্ত্রের অধীনে, সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার অভাবে বাঁধা পড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের এক অসীম চক্রে, শিকার হচ্ছে পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের।
This article is written in Bangla, about the colonialization of Africa by European powers.
All the necessary links are hyperlinked inside.
Featured Image: Walk Good.