১৪ এপ্রিল, ১৯১২; বিশালাকার এক বরফখন্ডের সাথে সংঘর্ষে ২,২২৩ জন যাত্রীসমেত ডুবে যায় তৎকালীন সময়ে সাড়া জাগানো জাহাজ টাইটানিক। ২,২২৩ জনের মধ্যে এই বিয়োগাত্মক ঘটনায় বেঁচে ছিলো মাত্র ৬০৬ জন। সেই ঘটনার পর কেটে গেছে ১০০ বছরেরও বেশি সময়। তবুও টাইটানিক নিয়ে কল্পকাহিনী, মিথ কিংবা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সময়ের সাথে সাথে আরো ডালপালা ছড়াচ্ছে। আজ আমরা জানবো এমনই কিছু জনপ্রিয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্পর্কে।
জে পি মরগান ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী
উনিশ দশকের শুরুতে মিলিয়নিয়ার ব্যাংকার হিসেবে বেশ নামডাক ছিলো জে পি মরগানের। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনুযায়ী, নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতেই জে পি মরগান টাইটানিক ডুবানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। এই গুঞ্জন ডালপালা মেলার সঙ্গত কিছু কারণও ছিলো।
সেই সময় জে পি মরগানের প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যাকব এস্টর, ইসিডর স্ট্রস, বেঞ্জামিন গুগেনহাইম টাইটানিক জাহাজে একসাথে চড়েছিলেন। সেই একই টাইটানিক জাহাজে করে দেশের বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো মরগানেরও। কিন্তু কী মনে করে ঠিক জাহাজ ছাড়ার আগমুহূর্তে নিজের মনোভাব পরিবর্তন করেন তিনি। জাহাজ ঘাটেই থেকে যান। সে যাত্রায় জে পি মরগান বেঁচে যান। কিন্তু টাইটানিকের সাথে সাথে ডুবে প্রাণ হারান বাকি তিনজন। এই তিনজন সেই সময় মরগানের প্রস্তাব করা ফেডারেল রিজার্ভের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন। বিশেষ করে ইসিডর স্ট্রস মরগানের উত্থাপিত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।
তবে অনেকের মতে, মরগান নন, কায়দা করে এই তিনজনকে জাহাজে পাঠিয়ে তাদের প্রাণে মেরেছেন রথসচাইল্ড পরিবার। ১৮ শতকের শুরুতে তখন রথসচাইল্ড পরিবারের করা ব্যাংক ইউরোপে দারুণভাবে প্রসারিত হচ্ছিলো। আর ফেডারেল রিজার্ভ প্রথা না হলে তাদের মুখ থুবড়ে পড়তে হতো। তাই অনেকের মতে, রথসচাইল্ড পরিবারই টাইটানিক ডোবার জন্য দায়ী।
টাইটানিক কখনো ডুববে না
ইনস্যুরেন্স নিয়ে কল্পকাহিনীও যুক্ত হয়েছে টাইটানিক ডোবার কারণ খুঁজতে গিয়ে। অনেকের মতে, টাইটানিক জাহাজটি হোয়াইট স্টার লাইন শিপের আরেকটি জাহাজ আরএমএস অলিম্পিকের সাথে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। যদিও মিসৌরি ও টেনেসির টাইটানিক জাদুঘরের সহ-সভাপতি ও কিউরেটর পল বার্নস পুরো ব্যাপারটিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেন।
মূলত কাহিনী গড়ে ওঠে অলিম্পিক জাহাজটি অকেজো হয়ে যাওয়ার পর। ১৯১১ সালের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্কে আসার পথে অলিম্পিক জাহাজটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেজন্য একে ঠিক করার জন্য বেলফাস্টে অবস্থিত হারল্যান্ড এন্ড উলফ জাহাজ সারাইখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কোম্পানি জাহাজটিকে ঠিক করে দেয় এবং পরবর্তীতে এটি নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরত আসে। অলিম্পিক জাহাজটি ফেরত আসার সময় ছিলো ১৯১২ সালের মার্চ মাস। ঠিক টাইটানিক ছাড়ার কয়েক সপ্তাহ আগে।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনুযায়ী, কিছু মানুষ তখন দেখলো অলিম্পিক নামের জাহাজটির অবস্থা কিছুটা শোচনীয়। সেক্ষেত্রে ইনস্যুরেন্স সুবিধা কম পাবে বিধায় সেই জাহাজটি টাইটানিক দিয়ে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। ব্যাপারটি অনেকটা কল্পকাহিনীর মতো হলেও অনেকেই বিশ্বাস করে, ইনস্যুরেন্সের জন্য টাইটানিক পরিবর্তিত করে দেওয়া হয়েছিলো।
অভিশপ্ত মমি
টাইটানিকের সাথে ডুবে মারা যাওয়া ১,৫১৭ জনের মধ্যে একজন ছিলেন উইলিয়াম স্টিড। উইলিয়াম স্টিড পেশায় ছিলেন একজন ব্রিটিশ সম্পাদক। তবে বেশ কিছু সময় ধরে তিনি আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছিলেন। এই স্টিডই প্রথম দাবী করেন একটি অভিশপ্ত মমির কারণে লন্ডনে বেশ কিছু রহস্যজনক মৃত্যু ঘটছে। স্টিড টাইটানিকের বেশ কয়েকজন যাত্রীর কাছে এই অভিশপ্ত মমির গল্প করেন। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার কিছুদিন পর ওয়াশিংটন পোস্ট এই মমি এবং উইলিয়াম স্টিডকে নিয়ে একটি শিরোনাম করে। তখন ব্যাপারটি বেশ হইচই রব তৈরি হয় চারপাশে।
টাইটানিক জাদুঘরের পরিচালক বার্নস বলেন, অনেকে বিশ্বাস করে, সেই মমিটিও টাইটানিকে তোলা হয়েছিলো। ব্রিটিশ মিউজিয়াম নাকি সেই মমিটি বিক্রি করে দিয়েছিলো এবং তা এর আমেরিকান ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জাহাজে তোলা হয়েছিলো।
যদিও সত্যিটা হচ্ছে, টাইটানিকে কোনো মমিই তোলা হয়নি এবং অভিশপ্ত আখ্যা পাওয়া সেই মমিটি এখনো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বহাল তবিয়তেই আছে।
'নো পোপ' তত্ত্ব
পোপকে অসম্মান করা নিয়েও আরেকটি তত্ত্ব বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। টাইটানিক জাহাজটি তৈরি করা হয় হোয়াইট স্টার লাইন শিপ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে। মূল কাঠামো বানানো হয় বেলফাস্টে অবস্থিত হারল্যান্ড এন্ড উলফ কোম্পানিতে। অনেকের মতে, জাহাজটি তৈরি করার সময় এর নাম্বার ছিলো 3909 04। আয়নার সামনে এই নাম্বারটি দেখতে অনেকটা NO POPE লেখার মতো দেখায়। কারখানার ক্যাথলিক কর্মীরাই এই কাজটি করেছে বলে সবার ধারণা। আর এজন্যই অনেকের মতে টাইটানিকের প্রতি দুর্ভাগ্য নেমে আসে।
টাইটানিকের ইতিহাস নিয়ে লেখা ওয়াল্টার লর্ড লিখেছিলেন, 'নো পোপ' তত্ত্বটি ১৯৫০ এর দিকে আবির্ভূত হয়। আয়ারল্যান্ডের কিছু মানুষ প্রথম এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। যদিও বার্নস ১৯৮৬ সালে তার লেখা বইয়ে দাবী করেছেন, এই ধরনের কোনো নাম্বার টাইটানিকের গায়ে লাগানো ছিলো না।
জাহাজের হাল নাম্বার ছিলো ৪০১, যা হারল্যান্ড এন্ড উলফের ইয়ার্ড নাম্বারের অনুসরণে দেওয়া হয়েছিলো। জাহাজের নাম্বার ছিলো ১৩১৪২৮, যা কোনোভাবেই কল্পিত সেই নাম্বারের সাথে মেলে না। এমনকি হারল্যান্ড এন্ড উলফ কোম্পানি তাদের কারখানা থেকে সব ক্যাথলিক কর্মী বিদায় করে ১৮০০ সালের শুরু থেকেই। এরপর থেকে সেখানে শুধু প্রোটেস্ট্যান্ট কর্মীরাই কাজ করতো।
তবে জাদুঘর কিউরেটর বার্নস বলেন, এত কিছু সত্ত্বেও প্রায়ই দর্শনার্থীরা 'নো পোপ' তত্ত্ব নিয়ে বার্নসকে প্রশ্ন করেন।
জ্যাক ডওসন এবং জে গেটসবি
এই তত্ত্বটি মূলত ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া টাইটানিক মুভি থেকে এসেছে। বিখ্যাত টাইটানিক মুভিতে জ্যাক ডওসন চরিত্রটিতে অভিনয় করেন হলিউড তারকা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও। অন্যদিকে গ্রেট গ্যাটসবি মুভিতেও জে গ্যাটসবি চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন ডিক্যাপ্রিওই।
এই দুটি মুভিকে এক করে ভক্তরাই এই উদ্ভট তত্ত্ব আবিষ্কার করে। তাদের মতে, জাহাজ ডুবে গেলেও সেখানে বেঁচে যায় জ্যাক। সেখান থেকে আমেরিকায় গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে, যা আমরা গ্রেট গ্যাটসবি মুভিতে দেখতে পাই। রোজকে ফিরে পাবার জন্য আমেরিকায় গেটসবি রুপি জ্যাক পার্টি শোম্যান শুরু করে। কিন্তু রোজকে ফিরে পাবার পরিবর্তে ডেইজি নামের নতুন একজন মেয়ের প্রেমে পড়ে জ্যাক। ক্রিস লাফ নামের এক ব্যক্তি দুটি মুভির টাইমলাইনকে এক করে ফিকশন লিখে ব্লগে ছেড়ে দেন। সেই থেকেই এই তত্ত্বটি জনপ্রিয় হয়।
এই পুরোটাই ভক্তদের মস্তিষ্কপ্রসূত কাজ, যদিও এটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই তা বলেই দেওয়া যায়। তবে টাইটানিককে ঘিরে যত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রয়েছে, তার মধ্যে ডিক্যাপ্রিওকে নিয়ে তৈরি করা এই ব্যাখ্যাটি বেশ জনপ্রিয়।
Feature Image : National Geographic Society
References : References are hyperlinked in the article.
Description : This Bangla article is about the popular conspiracy theories about Titanic.