Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অভিশপ্ত রাসায়নিক অস্ত্রের কলঙ্কময় ইতিহাস

১৯১৫ সালের কথা। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো পুরোদমে। বলতে গেলে মিত্রপক্ষের সুদক্ষ যুদ্ধকৌশলের নিকট কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলো জার্মান সেনারা। কিন্তু যুদ্ধবাজ জার্মানীর কাইজার এই পরাজয় মানতে নারাজ! তিনি বুঝতে পারলেন শুধু বন্দুক, গোলা-বারুদ দিয়ে বিশ্বযুদ্ধ জয় করা সম্ভব নয়। তিনি জার্মানীর দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানীদের ডেকে পাঠালেন। কাইজার এর এক নির্দেশ, “যেভাবেই হোক নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করা চাই!”

সেদিনের বিজ্ঞানীদলের মধ্যে তরুণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ফ্রিটজ হেবারও ছিলেন। বিজ্ঞানের সব জটিল ব্যাপারের সহজ এবং দ্রুত সমাধান বের করার ক্ষেত্রে তাঁর অনেক সুনাম ছিল। তিনি রাতদিন জেগে কাজ করতে লাগলেন। তাঁর এই পরিশ্রম বৃথা যায়নি। কাইজারের নিকট তিনি এক নতুন অস্ত্র নিয়ে হাজির হলেন। সেটি ছিল বিষাক্ত গ্যাস ‘ক্লোরিন’।

কাইজার তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সেই অস্ত্র প্রয়োগ করার অনুমতি প্রদান করলেন। ২২ এপ্রিল সকালে তিনি বেলজিয়ামে অক্ষশক্তির অধিকৃত শহর ইপ্রিস থেকে চার কিলোমিটার দূরে তাঁর অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করলেন। সেদিন প্রায় ৬,০০০ গ্যাস সিলিন্ডার থেকে ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়ে দেয়া হলো শত্রুপক্ষের ঘাঁটি বরাবর। এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা।

প্রায় ৭ দিন পর, যখন ফ্রিটজ হেবার ইপ্রিস শহরে জার্মান সেনা নিয়ে প্রবেশ করেন, তখন সেটাকে আর শহর বলে ডাকা যাচ্ছিল না। পথে-ঘাটে লাশের পর লাশ স্তূপ হয়ে সেটা বিশাল বিরানভূমিতে রূপ নিয়েছে।

এই ঘৃণ্য ঘটনার মাধ্যমে আধুনিক যুদ্ধকৌশলে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের অভিষেক ঘটে। শুরু হয় এক অভিশপ্ত অধ্যায়ের।

রাসায়নিক অস্ত্র কী?

রাসায়নিক অস্ত্র বলতে সোজা কথায় যেকোনো ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা তৈরি অস্ত্রকে বোঝায়। রাসায়নিক অস্ত্র কঠিন, তরল ও বায়বীয়- যেকোনো রূপে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে পারমাণবিক অস্ত্র এবং জীবাণুমূলক অস্ত্রের ব্যবহার রাসায়নিক অস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সাধারণ যুদ্ধে গোলা-বারুদের থেকেও হাজার গুণ বেশি কার্যক্ষম এই রাসায়নিক অস্ত্র। বিভিন্ন বিখ্যাত যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এর পরিণতি ছিল মর্মান্তিক!

সীমান্ত অধিকারের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কাছে মানবতার পরাজয়ের জ্বলজ্যান্ত নিদর্শন হিসেবে রাসায়নিক অস্ত্র ইতিহাসের পাতায় খলনায়ক হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে। জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রিটজ হ্যাবারকে ‘রাসায়নিক অস্ত্রের জনক’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

রাসায়নিক অস্ত্রের জনক বিজ্ঞানী ফ্রিটজ হেবার; সূত্রঃ Jewish Current

ইতিহাসের পাতা থেকে

ফ্রিটজ হ্যাবারকে রাসায়নিক অস্ত্রের জনক হিসেবে গণ্য করা হলেও ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে রাসায়নিক অস্ত্র এক প্রবীণ অভিনেতা। প্রথমদিকে রাসায়নিক অস্ত্রের ধারণা পাওয়া যায় গ্রীক পুরাণ থেকে। পৌরাণিক বীর হারকিউলিস তার তীরের ফলায় বিষ মাখানোর মাধ্যমে রাসায়নিক অস্ত্রের জন্ম দেন। হারকিউলিসের পুরাণ ছাড়াও ইথাকার রাজা ওডেসিয়াস বিষ মাখানো বর্শা ব্যবহার করতেন।হোমার তাঁর ঐতিহাসিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’-এর মাঝে ট্রয় যুদ্ধে বিষাক্ত হাতিয়ার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন।

বহুকাল ধরে রাসায়নিক অস্ত্র সাহিত্যের দরবারে ট্রাজেডি, বিশ্বাসঘাতকতা এবং বর্বরতার প্রতীক হিসেবে সমাদৃত হয়ে এসেছে। মহাকাব্যের পঙক্তি থেকে রাসায়নিক অস্ত্রকে বাস্তব জগতে নিয়ে আসা হয় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বে। তীর্থভূমি কিরা শহরের অধিকার নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এথেন্স এবং স্পার্টা। এথেন্সের সৈনিকরা কিরা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া প্লেস্তোস নদীর পানিতে বিষাক্ত হেলেবোর গাছের নির্যাস মিশিয়ে দেন। বিষাক্ত পানির প্রভাবে প্রাণ হারান কিরা শহরবাসী স্পার্টানরা। এই ঘটনার পর বিভিন্ন ছোটখাট যুদ্ধে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে অস্ত্র হিসেবে বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহার ঠিক কখন শুরু হয়েছিলো এই নিয়ে ইতিহাসবিদগণ বিভিন্ন মতবাদে ব্যক্ত করেছেন।

শিল্পীর দৃষ্টিতে ট্রয় যুদ্ধ; সূত্রঃ ancient.eu

অনেকের মতে, ৪৩১ খ্রিস্টপূর্বে পেলোপনেশিয়ানরা গ্রিক সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ শহর প্লেতিয়া দখলের সময় বিষাক্ত সালফার গ্যাস অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। ইতিহাসবিদদের অনেকেই মনে করেন, গ্যাসের প্রথম ব্যবহার হয়েছিলো আনুমানিক ২৫৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান-পারস্য যুদ্ধে। যুদ্ধকালীন পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি সুড়ঙ্গ পরীক্ষার মাধ্যমে সালফার ও বিটুমিন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ইতিহাসের অধ্যাপক ড. জেমস এর মতে, “পারস্য বাহিনী রোমানদের সুড়ঙ্গ খননের কথা টের পাওয়ার পর তাদের জন্য এক অভিশপ্ত চমক প্রস্তুত করেছিলো। রোমানরা খনন কাজ চালানোর সময় তারা ঘন বিষাক্ত গ্যাস সুড়ঙ্গে ছেড়ে দেন। ফলে রোমান সৈনিকরা সহ সুড়ঙ্গটি পুড়ে যায়।” এভাবে প্রাচীন ইউরোপে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।

প্রায় ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাসায়নিক অস্ত্রের আধিপত্য ইউরোপ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাচ্যের মাটিতে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেন মঙ্গোল সাম্রাজ্যের জনক চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিসের সেনারা ক্যাটাপুল্টের সাহায্যে সালফার মিশ্রিত কাপড়ে আগুন লাগিয়ে গোলা নিক্ষেপ করতেন শত্রুশিবিরে। আবার চীন-মঙ্গোল যুদ্ধে চীনারাও চেঙ্গিস বাহিনীর বিরুদ্ধে বিষ মাখানো বর্শা ব্যবহার করেছিলো।

চীন-মঙ্গোল যুদ্ধ; সূত্রঃ ancient-origins.net

পনের শতাব্দীর শেষ দিকে স্পেনের হিস্পানিওলা দ্বীপে স্পেন-তাইনো যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তাইনো সেনারা স্প্যানিশদের দিকে ছাই ও গোলমরিচের সিরাপ দিয়ে ঠাসা লাউ ছুঁড়ে মারেন। হাস্যকর এই লাউ কিন্তু সেদিন ঠিকই স্প্যানিশদের কোণঠাসা করে দিয়েছিলো।

রাসায়নিক অস্ত্রের অবাধ ব্যবহারের ফলে যুদ্ধফেরত সৈনিকদের অঙ্গে চিরস্থায়ী বিকৃতি দেখা দিতে থাকে। এছাড়াও রাসায়নিক যুদ্ধের ভয়াবহতা ধীরে ধীরে মানবতাকে বিপন্ন করে দিচ্ছিলো। ইউরোপের বৃহৎ দুই পরাশক্তি ফ্রান্স এবং জার্মানী সর্বপ্রথম রাসায়নিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ১৬৭৫ সালে ঐতিহাসিক স্ট্রাউসবার্গ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ফ্রান্স ও জার্মানী। এর মাধ্যমে তারা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সময়ের আবর্তনে রক্ষক পরিণত হলো ভক্ষকে। স্ট্রাউসবার্গ চুক্তিবদ্ধ ফরাসীরা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় ২০০ বছর পর ১৮৪৫ সালে আলজেরিয়া অভিযানের সময় প্রায় ১,০০০ যাযাবর আদিবাসীকে গুহায় বন্দী অবস্থায় বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। চুক্তির বরখেলাপে জার্মানরাও অন্তর্ভুক্ত আছে। তাদের হাত ধরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন ঘটে রাসায়নিক অস্ত্রের।

দেশপ্রেমের খেসারত

দেশকে ভালোবাসা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব বলে আমরা স্বীকৃতি দিই। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন, একজন বিজ্ঞানীর অন্ধ দেশপ্রেমের কারণে হারিয়ে যাওয়া রাসায়নিক অস্ত্র নতুন করে আগমন করে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে। এর খেসারত দিতে গিয়ে আজ দেউলিয়া বিশ্বমানবতা।

রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার অতি প্রাচীন হলেও উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে মানুষ বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন শুরু করে। গবেষণাগারে তৈরি হতে থাকে মাস্টার্ড, ক্লোরিন, সারিন প্রভৃতি গ্যাস। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের পূর্বেই প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলো এই অস্ত্রের ভয়াবহতা!

১৮৬১ সাল থেকে শুরু হওয়া আমেরিকান গৃহযুদ্ধে দু’পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে অবাধে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার হতে থাকে। কনফেডারেট সেনাপরামর্শক ইশাম ওয়াকারের পরামর্শে বেলুনের মাধ্যমে সাধারণ জনতার উপর বিষাক্ত গ্যাসের আক্রমণ চালানো হয়।

ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে রাসায়নিক সহিংসতা। একে রুখে দিতে সর্বপ্রথম একীভূত হন ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ। ১৮৭৪ সালে ব্রাসেলস সম্মেলনে রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়। কিন্তু সেদিনের সম্মেলনে এই দাবি মেনে নেয়া হয়নি। ১৮৯৯ সালে হেগ শান্তি সম্মেলনে পশ্চিমা নেতাদের হস্তক্ষেপে এই দাবি মেনে নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন রাষ্ট্রপ্রধানরা। সব ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর হৈমন্তী গল্পে বলেছেন ‘মানুষ পণ করে পণ ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা বোধহয় এই উক্তি মাথায় রেখেই চুক্তিভঙ্গ করে বসে। ফ্রিটজ হেবার নামক তরুণ বিজ্ঞানী দেশপ্রেমে অন্ধ হয়ে বিবেক বিসর্জন দিলেন, তৈরি করলেন বিধ্বংসী অস্ত্র ক্লোরিন গ্যাস। প্রথম সিলিন্ডারের ডালা খুলে যাওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর আলোয় আগমন ঘটলো এক দানবের, যার থাবায় হাজার হাজার সৈনিক নির্মমভাবে প্রাণ হারান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্লোরিন গ্যাস আক্রমণের একটি ছবি; সূত্রঃ Wikimedia commons

প্রথমদিকে জার্মান অফিসাররা কেউই হেবারের আবিষ্কারকে আমলে নেননি। শেষ পর্যন্ত হাজার অনুরোধের পর কাইজারের সম্মতিতে দুর্ভেদ্য ইপ্রিস সীমান্তে নিতান্ত পরীক্ষামূলকভাবে ১৭০ মেট্রিক টন ক্লোরিন গ্যাস নিয়ে আক্রমণ করেন হেবার। তিনি গ্যাস থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষ মাস্কও তৈরি করেন জার্মানদের জন্য।

বলতে গেলে পুরো পরিস্থিতি বদলে যায়। কিন্তু জার্মানরা ইপ্রিস পুরোপুরি দখল করতে ব্যর্থ হয়। এর কারণ হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইতিহাসবিদ মেলানিয়া মরিন পেলেতিয়ে বলেন, “জার্মান অফিসাররা ইপ্রিসে অবস্থান করতে সুবিধা বোধ করেননি। কারণ তারা নিজেরাই নিজের গ্যাসের ভয়ে তটস্থ ছিলেন।”

এই আক্রমণের কারণে অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানরা হতবিহ্বল  হয়ে পড়েন। চুক্তিভঙ্গের প্রতিশোধ নিতে তারা নিজেদের বিজ্ঞানীদের রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করার নির্দেশ দেন। একই বছর ২৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশরা জার্মানদের উপর ক্লোরিন গ্যাস নিয়ে আক্রমণ করে। ফ্রান্সের লু ময়দানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ব্রিটিশরা জার্মানদের এই গ্যাস দিয়ে কুপোকাত করে। জার্মানরা মরিয়া হয়ে উঠে। এবার আর ক্লোরিন নয়, আরো মারাত্মক অস্ত্র চাই। বড়দিনের ৬ দিন পূর্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উপর ব্যবহার করা হয় নতুন অস্ত্র ‘ফসজিন গ্যাস’। সেদিন প্রাণ হারান আরো প্রায় ১,০০০ সেনা।

বিষাক্ত গ্যাস থেকে আত্মরক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার করেছিলেন জার্মান সেনারা; সূত্রঃ canada.com

১৯১৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন ‘মাস্টার্ড গ্যাস’। প্রথম তিন সপ্তাহ একনাগারে এই গ্যাস ব্যবহারের ফলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২,১০০!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মাস্টার্ড গ্যাস দিয়ে আক্রমণ করছেন জার্মান সেনারা; সূত্রঃ firstworldwar.com

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বসে থাকেনি। ১৯১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রাসায়নিক অস্ত্রাগার তৈরি করা হয়। অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাপিয়ে অক্ষশক্তি আর মিত্রশক্তি মেতে উঠে রাসায়নিক গ্যাস ছুঁড়াছুঁড়িতে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সহযোদ্ধাদের সাথে অ্যাডলফ হিটলার (ডানদিক থেকে প্রথম) ; সূত্রঃ Alamy Stock photo

এবার একটি মজার ঘটনা বলা যাক। ১৯১৮ সালের অক্টোবরের ঘটনা। এক তরুণ জার্মান সৈনিক ইপ্রিসের যুদ্ধক্ষেত্রে বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে মারাত্মকভাবে আহত হন। সাময়িকভাবে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়। এরপর তাকে পূর্ব জার্মানীতে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। যুদ্ধের বাকিটা সময় সেই সৈনিক হাসপাতালেই কাটিয়ে দেন। পরবর্তীতে এই তরুণ সৈনিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীকে নেতৃত্ব দেন। তাকে আমরা অ্যাডলফ হিটলার নামে চিনি।

২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং জার্মান হলোকাস্ট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৫ সালে জেনেভা সম্মেলনে তৎকালীন বিশ্ব শান্তি সংঘ জাতিপুঞ্জ নতুন করে রাসায়নিক অস্ত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু ১৯৩৬ সালে ইতালীয় সৈরাচার বেনিতো মুসোলিনি জেনেভা প্রটোকলকে অগ্রাহ্য করে ইথিওপিয়ার উপর মাস্টার্ড বোমা নিক্ষেপ করেন। ফলে পুনরায় রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এর ব্যবহার হয়েছিলো। তবে ব্যবহারের ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দি ইহুদিদের রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়; সূত্রঃ myjewishlearning.com

জার্মান ফুয়েরার হিটলারের নির্দেশে বন্দি ইহুদিদের একটি স্বতন্ত্র কক্ষে নিয়ে সেখানে সায়ানাইড গ্যাস দিয়ে হত্যা করা হতো। এই ঘটনাকে ইতিহাসের পাতায় ‘হলোকাস্ট’ নামে চিহ্নিত করা হয়। নাৎসি বাহিনীর সদস্যরা ইহুদিদের ধরে এনে বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিষিদ্ধ গ্যাস ‘টাবুন’ উৎপাদনে কাজে লাগিয়ে দেন। সেই গ্যাস পরীক্ষা করার জন্য গিনিপিগ হিসেবে বন্দীদের ব্যবহার করা হতো। জার্মান হলোকাস্ট ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা। এর মাধ্যমে ষাট লক্ষাধিক ইহুদি প্রাণ হারান। জার্মানদের সাথে হাত মেলানো যুদ্ধবাজ জাপানীরাও গ্যাস ব্যবহারের মাধ্যমে গণহত্যায় অংশ নেয়।

বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েক বছরের জন্য রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার থেমে থাকলেও তা একেবারে হারিয়ে যায়নি। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সেনারা ‘নাপালম গ্যাস’ বোমা ব্যবহার করেন। বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার রেশ না কাটতেই এই ভয়াবহ রাসায়নিক আক্রমণে শান্তিকামী মানুষদের মনে ক্ষোভের জন্ম দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতি বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে ট্রাংবাঙ্গ শহরে নাপালম বোমা হামলার একটি দৃশ্য; সূত্রঃ Japan Focus

১৯৭২ সালে বিশ্বনেতারা এক হয়ে ১৯২৫ জেনেভা প্রটোকল পরিমার্জন করে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। নতুন চুক্তিতে শুধু ব্যবহার নয়, উৎপাদনের উপরও কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু পূর্ববর্তী সকল চুক্তির মতো এই নতুন চুক্তিপত্রকেও সামান্য আঁকিবুঁকি করা কাগজে পরিণত করেন ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেইন।

তিনি ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরানী কুর্দি সম্প্রদায়ের উপর ‘টাবুন’ গ্যাস নিক্ষেপ করেন। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে সমঝোতা স্বাক্ষরের পূর্বে ইরানও রাসায়নিক অস্ত্রের মাধ্যমে পাল্টা আক্রমণ করেছিলো। এবার জাতিসংঘ নতুন নীতি অবলম্বন করে। ১৯৯৩ সালে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের মধ্যে সকল প্রকার রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ এবং ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ জারি করা হয়। নিশ্চয় পাঠকরা ধরে ফেলেছেন যে, বরাবরের মতো এবারও কেউ না কেউ এই নীতিমালা ভঙ্গ করবেই! পাঠকদের ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক। তবে জার্মানী কিংবা ফ্রান্স নয়, এবারের অপরাধী হচ্ছে ইসরাইল। ২০০৯ সালে গাঁজা আগ্রাসনের সময় ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের উপর বিষাক্ত ‘সাদা ফসফরাস বোমা’ নিক্ষেপ করে। আক্রমণ পরবর্তী ফুটেজ দ্বারা বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং ইসরাইলের প্রতি তীব্র নিন্দা জানায়।

গাজায় ইসরাইল কর্তৃক সাদা ফসফরাস বোমা হামলা ; সূত্রঃ Human Rights Watch

সর্বশেষ রাসায়নিক আক্রমণ ঘটান স্বৈরাচারী শাসক সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল আসাদ। ২০১৩ সালে সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধে তিনি নিজের জনগণের উপর ‘সারিন গ্যাস’ দিয়ে আক্রমণ করেন। আক্রমণে শত শত সাধারণ নাগরিক নিহত হন। নিহতদের লাশের বীভৎস ছবি বিশ্বমানবতাকে চরমভাবে আঘাত করে।

সিরিয়ায় সারিন গ্যাস আক্রমণে আহত সন্তানকে কোলে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক বাবা; সূত্রঃ CNN

রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কুফল

পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত অনেক ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে মাস্টার্ড গ্যাস। এছাড়াও ক্লোরিন গ্যাস, ভি-এক্স, সারিন গ্যাস, সাদা ফসফরাস, ফসজিন গ্যাস ইত্যাদি বিখ্যাত রাসায়নিক অস্ত্র। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে বিষক্রিয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদি যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু ঘটে থাকে। আহত ব্যক্তির দেহ চিরস্থায়ীভাবে বিকৃত হয়ে যায় অথবা আমরণ পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়। অনেকের দেহ সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়।

রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ফলে শুধু মানুষ নয়, পরিবেশের অন্যান্য জীবজন্তুসহ, বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান, জলাশয় বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুনরায় কোনো বিশ্বযুদ্ধে অবাধ রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের ফলে পুরো পৃথিবীর সেবনযোগ্য বায়ু বিষাক্ত হয়ে পড়বে।

ত্রাণকর্তা OPCW

OPCW এর পূর্ণরূপ Organization for the Prohibition of Chemical Weapons। রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার থেকে মানবতাকে রক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৯৭ সালে নেদারল্যান্ডের দি হেগ শহরে এই আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম হয়। বর্তমানে পৃথিবীর ১৯২টি সার্বভৌম রাষ্ট্র এই সংস্থার সদস্য। লক্ষ্য অর্জনে বদ্ধ পরিকর এই সংস্থা চারটি মূলনীতিতে বিশ্বাসী। মূলনীতিগুলো হচ্ছেঃ

  • সমস্ত রাসায়নিক অস্ত্রের ধ্বংস সাধন।
  • রাসায়নিক শিল্পকারখানার উপর কড়া নজরদারি।
  • যেকোনো ধরনের রাসায়নিক হুমকি থেকে যেকোনো রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তিকে রক্ষা করা।
  • বিশ্বজুড়ে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলা।

সাম্প্রতিককালে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল আসাদ কর্তৃক সারিন গ্যাস আক্রমণের ফলে সিরিয়া জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে OPCW কর্তৃক সিরিয়া থেকে প্রায় সবরকম রাসায়নিক অস্ত্র হরণ করা হয়। তাদের এই অসামান্য কাজের স্বীকৃতস্বরূপ ২০১৩ সালে OPCW কে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়।

২০১৩ সালে OPCW নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হয়; সূত্রঃ opcw.org

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, OPCW এর হস্তক্ষেপে সিরিয়ায় ব্যবহৃত রাসায়নিক অস্ত্রসমূহের প্রায় ৯৭% ধ্বংস করা হয়। বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। এর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা। এর যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি খারাপ দিকও রয়েছে।

রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে মানবসভ্যতা; সূত্রঃ diplomaticourier.com

রাসায়নিক অস্ত্র এক অভিশাপ। বহুবার নানা নীতিমালা, চুক্তি, প্রটোকল গঠন করার পরেও বিভিন্ন সময়ে মানুষ বিবেক বিসর্জন দিয়ে হাতে তুলে নিয়েছে রাসায়নিক অস্ত্রকে। এর মানে শুধু চুক্তি স্বাক্ষরই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন আরো কার্যকরী মাধ্যমের। সাম্প্রতিককালে OPCW এর কার্যক্রম আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। বিশ্ব নেতৃত্বের পূর্ণ সহযোগিতা পেলেই কেবল এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আর তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে সুস্থ মানব বিলুপ্ত হয়ে জন্ম নেবে বিকৃত এবং পঙ্গু মানব সভ্যতা।

ফিচার ইমেজ- metabunk.org

Related Articles