রত্নপাথরের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। ইতিহাসে অনেক রত্নই তাদের আকার-আকৃতি আর সৌন্দর্য দিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে। তবে কোনো কোনো রত্ন কুখ্যাতি অর্জন করেছে তাদের মালিকদের দুর্ভাগ্যের সঙ্গী হয়ে। সচেতন বা অসচেতন যেভাবেই হোক, এসব রত্নকেই দুর্ভাগ্যের কারণ ধরে নিয়েছে বহু মানুষ। ফলে তাদের কপালে জুটেছে অভিশপ্ত পাথরের তকমা। আমাদের গল্প তেমন পাথরগুলো নিয়েই। তাদের মধ্যে একটি লা পেরেগ্রিনা (La Peregrina )।
লা পেরেগ্রিনা সম্ভবত পৃথিবীর সবথেকে নামকরা মুক্তা। স্প্যানিশে এর অর্থ করা যায় অনেকটা পরিব্রাজক (Wanderer or the Pilgrim) মুক্তা। ৫৫ ক্যারেটেরও বেশি ওজনের লা পেরেগ্রিনা বিশেষভাবে বিখ্যাত তার আকৃতির নিখুঁত প্রতিসাম্যের জন্যে।
উৎস
লা পেরেগ্রিনার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয় পানামা উপসাগরের পার্ল দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দ্বীপ সান্টা মার্গারিটাকে (Santa Margarita)। ষোড়শ শতাব্দীতে এই অঞ্চল ছিল স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। পানামা উপসাগরে মুক্তার জন্য সুপরিচিত। জনশ্রুতি আছে, ১৫১৩ সালে কোনো এক দাস সাগরে নেমে ঘটনাক্রমে লা পেরেগ্রিনার সন্ধান পায়।
দাসটি তার মালিকদের হাতে এই পাথর তুলে দিলে তারা লা পেরেগ্রিনার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে পড়েন। এমন অসাধারণ একটি রত্ন খুঁজে পাবার পুরষ্কার হিসেবে সেই দাসকে মুক্ত করে দেয়া হয়। অন্য আরেক গল্পে আছে, লা পেরেগ্রিনা যখন উপঢৌকন স্বরূপ তৎকালীন পানামার স্প্যানিশ উপনিবেশের প্রশাসক ডন পেদ্রো ডি টেমেজের কাছে পাঠানো হয় তিনিই নাকি খুশি হয়ে সেই দাসের মুক্তির আদেশ দিয়েছিলেন।
যেটাই হোক না কেন, টেমেজের ভাণ্ডারে লা পেরেগ্রিনা জমা পড়েছিল বলে আমরা জানতে পারি। কিন্তু টেমেজ নিজের জন্যে এই মুক্তা রেখে দেননি। তিনি লা পেরেগ্রিনা উপহার হিসেবে স্পেনের যুবরাজ এবং ভবিষ্যৎ রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের হাতে তুলে দেন। এরপর দৃশ্যপটে আগমন ঘটল ইংল্যান্ডের রানী প্রথম মেরির।
মেরি
টিউডর রাজা অষ্টম হেনরি আর তার প্রথম স্ত্রী স্প্যানিশ রাজকন্যা ক্যাথেরিন অফ আরাগনের সন্তান মেরি। পিতার মৃত্যুর পরে ১৫৫৩-৫৮ সাল অবধি মেরি ছিলেন ব্রিটিশ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। ক্যাথলিক মেরি প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রতি ছিলেন খড়গহস্ত। কাজেই ক্ষমতায় বসে তিনি তাদের উপর শুরু করেন অত্যাচার নির্যাতন। তার সময় প্রায় তিনশত প্রোটেস্ট্যান্টকে পুড়িয়ে মারা হয় রানীর নির্দেশে। ফলে মেরির নাম হয়ে গিয়েছিল ব্লাডি মেরি।
ক্যাথলিক স্পেনের সুদর্শন দ্বিতীয় ফিলিপের প্রতি মেরির টান ছিল দুর্নিবার। যদিও বয়সে প্রায় দশ বছরের ছোট ফিলিপ মেরিকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তবে রাজনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় তাদের বিয়ে ঠিক হয়। ফিলিপ তার হবু বধূকে লা পেরেগ্রিনা উপহার পাঠালেন।
লা পেরেগ্রিনা একটি হারে যুক্ত করে মেরি পরিধান করতেন। বেশ কিছু ছবিতে লা পেরেগ্রিনা তার গলায় শোভা পেতে দেখা যায়। কিন্তু মুক্তার দুর্ভাগ্যের গল্পের সূচনা হয় এখান থেকেই। ফিলিপ আর মেরির সংসার ছিল ছন্নছাড়া। মেরির প্রতি ফিলিপের কোনো ভালবাসাই ছিল না। স্প্যানিশ রাজপুত্র স্পেন আর ইংল্যান্ডে অন্যান্য সুন্দরী রমণীর সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হন। অন্যদিকে মেরি পাগলের মতো ফিলিপের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে গর্ভবতী বলে দাবি করেন। সিংহাসনের হবু উত্তরাধিকারির জন্মের উৎসবে স্পেন যখন মাতোয়ারা, তখন দেখা গেল মেরি আসলে গর্ভধারণ করেননি।
লা পেরেগ্রিনা উপহার পাবার পর থেকে মেরির অসুখবিসুখে ভোগার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ক্রমেই রানী দুর্বল হয়ে পড়েন, এবং ১৫৫৮ সালের মে মাসে ৪২ বছর বয়সে মারা যান। সেসময় ইংল্যান্ডে চলছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি।
ফিলিপের মৃত্যু
মেরির মৃত্যুর পর ফিলিপের কাছে চলে আসে লা পেরেগ্রিনা। মেরির দুর্ভাগ্যের পেছনে তার পারিবারিক সমস্যাই প্রধান হলেও লা পেরেগ্রিনার নাম জড়িয়ে পড়ে রানীর কুখ্যাতির সাথে। ফিলিপ যখন প্রায় ৫২ দিন যন্ত্রনায় ভুগে মারা গেলেন তখন লা পেরেগ্রিনার প্রতি আঙুল ওঠে অনেকের। এই অভিশপ্ত মুক্তার জন্যই নাকি এমন ভয়ানক মৃত্যু ঘটল স্পেনের রাজার।
পরবর্তী যাত্রা
ফিলিপের পর লা পেরেগ্রিনা স্প্যানিশ মুকুটের একটি গহনায় পরিণত হয় (Spanish Crown Jewels)। ১৬০৫ সালে স্পেন আর ইংল্যান্ডের শান্তিচুক্তির অনুষ্ঠানে স্পেনের রানী মার্গারেট লা পেরেগ্রিনা পরিধান করেন।এরপর লা পেরেগ্রিনার মালিক হন চতুর্থ ফিলিপের স্ত্রী রানী ইসাবেল। বলা হয়, দুজনেই ছিলেন পরকীয়ায় ব্যস্ত। ইসাবেলের সম্পর্ক ছিল পেরাল্টা নামে এক কবির সাথে। ফিলিপ আর তার প্রধানমন্ত্রী অলিভারেজের চক্রান্তে তিনি খুন হন।
এরপর ইসাবেল ১৬৪৪ সালে মারা গেলে ফিলিপ দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন তার ভাগ্নি ১৪ বছরের মারিয়ানা অফ অস্ট্রিয়াকে। ফলে মারিয়ানা হন লা পেরেগ্রিনার মালিক। তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে মাত্র দুজন বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছাতে সমর্থ হয়। ১৬৯৬ সালের ১৬ মে মারিয়ানার মৃত্যুর পর লা পেরেগ্রিনা আড়ালে চলে যায় ১০০ বছরেরও বেশি সময়।
নেপোলিয়ন
১৮০৮ সাল। স্পেনে আগ্রাসন চালান ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। দুর্ধর্ষ এই সেনানায়ক সহজেই পরাজিত করলেন স্প্যানিশদের। স্পেনের সিংহাসনে বসালেন ভাই জোসেফকে। পাঁচ বছর শাসন করার পর ১৮১৩ সালে আর্থার ওয়েলেসলি ওরফে ডিউক অফ ওয়েলিংটন ফরাসিদের তাড়িয়ে দেন স্পেন থেকেই। জোসেফ পালিয়ে আসার সময় সাথে নিয়ে আসেন মূল্যবান রাজকীয় গহনা, যার মধ্যে খোঁজ পাওয়া যায় লা পেরেগ্রিনার। বলা হয়, মূলত এ সময় থেকেই মুক্তাটিকে লা পেরেগ্রিনা বা পরিব্রাজক নাম দেয়া হয়, কারণ পানামা হয়ে স্পেন, ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স ঘুরে ফেলেছে সে।
১৮১৫ সালে চূড়ান্তভাবে নেপোলিয়নের পতনের পর জোসেফ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তার সাথে অবধারিতভাবেই ছিল লা পেরেগ্রিনা। ১৮৪৪ সালে ফ্লোরেন্সে তার মৃত্যুর পর মুক্তা হাতবদল হয়ে চলে যায় তার ভাগ্নে চার্লস লুইস বোনাপার্টের কাছে। ১৮৫২ সালে তৃতীয় নেপোলিয়ন হিসেব ক্ষমতায় বসেন তিনি। কিন্তু পূর্বসুরির মতো লা পেরেগ্রিনা তাকেও ছাড়ল না! প্রুশিয়ার কাছে ফ্রান্সের পরাজয়ের সময় রণক্ষেত্রে শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন তিনি। তার শেষ জীবন কাটে ইংল্যান্ডে নির্বাসনে।
অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা নেপোলিয়ন ১৮৭৩ সালে লা পেরেগ্রিনা বিক্রি করে দেন লর্ড জেমস হ্যামিল্টন, ফার্স্ট ডিউক অফ অ্যাবেরকর্ণের কাছে। তার পরিবারে এই মুক্তা রয়ে যায় প্রায় ১০০ বছর। এই সময় নতুন করে এই পরিবারের কোনো দুর্ভাগ্যের খবর পাওয়া যায়নি। এরপর ১৯৬৯ সালে বিক্রির জন্য নিলামে উঠল লা পেরেগ্রিনা।
এলিজাবেথ টেলর
হলিউডে তখন এলিজাবেথ টেলরের রমরমা সময় চলছে। রিচার্ড বার্টনের সাথে তার প্রেম আর বিয়ে পত্রিকার প্রথম পাতার খবর। বার্টন ৩৭,০০০ পাউন্ডে লা পেরেগ্রিনা কিনে নেন টেলরের জন্যে। ভালবাসা দিবসের উপহার হিসেবে তুলে দেন স্ত্রীর হাতে।
টেলর আর বার্টনের সংসার ছিল ক্ষণস্থায়ী আর ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ। এর পেছনেও লা পেরেগ্রিনার কুখ্যাতিকে দায়ী করা হয়। টেলরের মৃত্যুর পর ২০১১ সালের ডিসেম্বরে আরেক নিলামে বিক্রি হয় লা পেরেগ্রিনা। পূর্বমূল্য হিসেবে ২-৩ মিলিয়ন ডলার দাম ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত ১১.৮ মিলিয়ন ডলার দাম ওঠে এই মুক্তার। এর নতুন মালিক নিজে পরিচয় গোপন রেখেছেন। তবে তিনি এশিয়ার কোনো দেশের বলে জানা যায়।
সন্ধান পাবার পর আজ পর্যন্ত লা পেরেগ্রিনার মালিক হয়েছেন ১২ জনের মতো ব্যক্তি। এদের মধ্যে আছেন স্পেনের রাজা, ফরাসি সম্রাট, ব্রিটিশ অভিজাত পরিবার, এমনকি হলিউড তারকাও। সবাই না হলেও তাদের অনেকেই হয়েছেন করুণ পরিণতির শিকার। জীবনে নানা দুর্ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়েছে তাদের। যদিও এর কারণ হিসেবে অনেক কিছুরই অবতারণা করা যায়, তারপরেও অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন লা পেরেগ্রিনারও এতে দায় আছে। ফলে অন্যান্য অভিশপ্ত রত্নপাথরের মত পরিচিত না হলেও এই তালিকায় নাম তুলেছে লা পেরেগ্রিনা।
This is an article about one of the most famous pearls in history-la peregrine. This article describes the discovery of the pearl and its supposed status as a cursed gemstone. Necessary references are hyperlinked and also mentioned below.
- The Dark History of the La Peregrina Pearl
- The Story of "La Peregrina, the Wandering Pearl"
- LA PEREGRINA PEARL: MONDAY MYSTERY PART 6
Feature image: robbreport.com.my