Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অভিশপ্ত রত্নপাথর: ব্ল্যাক প্রিন্সের রুবি

রত্নপাথরের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। ইতিহাসে অনেক রত্নই তাদের আঁকার আকৃতি আর সৌন্দর্য দিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে। তবে কোনো কোনো রত্ন কুখ্যাতি অর্জন করেছে তাদের মালিকদের দুর্ভাগ্যের সঙ্গী হয়ে। সচেতন বা অসচেতন যেভাবেই হোক এসব রত্নকেই দুর্ভাগ্যের কারণ ধরে নিয়েছে বহু মানুষ। ফলে তাদের কপালে জুটেছে অভিশপ্ত পাথরের তকমা। আমাদের গল্প তেমন পাথরগুলি নিয়েই। তাদের মধ্যে একটি ব্ল্যাক প্রিন্সের রুবি।

ব্রিটিশ রাজপরিবারের অন্যতম সম্পদ তাদের রাজকীয় গহনা। নানা দেশ থেকে নিয়ে আসা রত্নপাথর এর অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর মধ্যে একটি এই ব্ল্যাক প্রিন্সের রুবি (Black Prince’s Ruby )।

নামে রুবি হলেও এই রত্নটি ভিন্ন ধরনের একটি পাথর, যার নাম স্পিনেল (spinel)। এটি সম্ভবত পৃথিবীর বৃহত্তম অখণ্ড লাল স্পিনেল। ব্রিটিশ রাজ পরিবার ১৬৩৭ সালের দিকে এটি হাত করে। তখনো একে রুবি বলেই মনে করা হতো। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয় এটি আসলে স্পিনেল জাতীয় পাথর। রুবির সাথে স্পিনেলের বাহ্যিক মিল থাকায় একে রুবি বলে ভ্রম হচ্ছিল। ওজনের হিসেবে প্রায় ১৭০ ক্যারেট আর লম্বায় প্রায় ৫ সেন্টিমিটার এই পাথরের অবস্থান বর্তমানে ব্রিটিশ রাজমুকুটে। অভিশপ্ত রত্নপাথরের তালিকাতেও এটি স্থান দখল করে রেখেছে।

স্পিনেল দেখতে অনেকটাই রুবির মতো; Image Source: spg-pack.com

উৎপত্তি

বলা হয় ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবি তোলা হয়েছিল বর্তমান তাজিকিস্তানের অন্তর্গত বাদাখশানের কুহ-ই-লাল খনি থেকে। তবে ইতিহাসের পাতায় এর আবির্ভাব চতুর্দশ শতকে। প্রচলিত গল্প মতে তখন কিংডম অফ গ্রানাডার প্রিন্স আবু সাইদের সম্পত্তি ছিল এই রুবি। সমসাময়িক কাস্টিলের শাসক ছিলেন ডন পেদ্রো। কাস্টিল তখন স্পেনের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তির পথে। এ সময় চলমান রিকনকুইস্তার অংশ হিসেবে পেদ্রো নাকি লাগাতার হামলা চালাচ্ছিলেন গ্রানাডার উপর।

মানচিত্রে গ্রানাডা ও কাস্টিল; Image Source: hikenow.net

১৩৬২ সালে কয়েকটি যুদ্ধে ডন পেদ্রোর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয় গ্রানাডা। আলোচনার প্রস্তাব দেন আবু সাইদ। পেদ্রো তাকে কাস্টিলে আমন্ত্রণ জানান। মূল্যবান পরিচ্ছদ আর গহনা পরিধান করে প্রিন্স নিজেই পেদ্রোর ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন।

পেদ্রো কিন্তু আলোচনায় মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। তার কানে গিয়েছিল আবু সাইদের সঙ্গে থাকা বিশাল একটি রত্নের কথা। এই পাথর দখল করতে তিনি ফাঁদ পেতেছিলেন। গ্রানাডার লোকেদের নাগালে পেয়েই তিনি সৈনিকদের লেলিয়ে দিলেন। আবু সাইদসহ সবার কপালে জুটল তরবারির কোপ। জনশ্রুতি আছে, পেদ্রো নিজের হাতে প্রিন্সকে হত্যা করেন, তার মৃতদেহ থেকে খুলে নেন রুবি। এরপর থেকেই এর গায়ে সেঁটে যায় অভিশপ্ত তকমা। এই গল্পের সত্যাসত্য নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এটা সত্যি যে পেদ্রোর কাছেই প্রথম সুনির্দিষ্টভাবে খবর এই পাথরের খবর পাওয়া যায়।

ডন পেদ্রোর দুর্গতি

পেদ্রোর সৎ ভাই, হেনরি অফ ট্রাস্তামারা কাস্টিলের সিংহাসন দাবি করে বসেন। সৈন্যসামন্ত জুটিয়ে পেদ্রোর উপর আক্রমণ করলেন তিনি।  বিপন্ন পেদ্রো পালিয়ে গেলেন ফ্রান্সের বোর্দো শহরে। সেখানে তখন ব্রিটিশ রাজপুত্র এডওয়ার্ড অফ উডস্টকের দরবার। পেদ্রো রাজার সহায়তা প্রার্থনা করলেন। তাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন এর বিনিময়ে তিনি মূল্যবান রত্ন আর টাকাপয়সা দিয়ে কোষাগার পূর্ণ করে দেবেন।

এডওয়ার্ড ছিলেন জাঁদরেল সেনাপতি। ইতিহাসে তার বীরত্বের অনেক কাহিনী লেখা আছে। মৃত্যুর দেড়শ বছরের পর থেকে লোকমুখে ব্ল্যাক প্রিন্স উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। কেন, তা নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবাদ চালু রয়েছে।

এডওয়ার্ড দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স; Image Source: baldwin.co.uk

একটি গল্প হল যে তিনি সবসময় কালো বর্ম পরিধান করতেন বলে এই নাম। কারো কারো ধারণা তার প্রতীক, যেখানে তিনটি অস্ট্রিচ পাখির পালক ফুটিয়ে তোলা কালো পটভূমিতে, সেখান থেকেই এই উপাধির জন্ম। অনেকে দাবি করেন যুদ্ধবন্দীদের উপর নির্মমতার ফলে তাকে ডাকা হয় ব্ল্যাক প্রিন্স।

যাই হোক না কেন, এডওয়ার্ড সাড়া দিলেন পেদ্রোর অনুরোধে। দলবল নিয়ে চললেন স্পেনে। ১৩৬৭ সালের ৩ এপ্রিল উত্তর স্পেনে ব্যাটল অফ নাজেরা’তে (Najerá) তার হাতে বিধ্বস্ত হলেন হেনরি ও তার মিত্ররা। পেদ্রোকে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকাপয়সা দিয়ে পেদ্রো ব্যর্থ হলেন। কারণ হিসেবে দেখালেন খালি রাজকোষ।

এডওয়ার্ড এবার দাবি করে বসলেন পেদ্রোর সাধের রুবি। পেদ্রোর হাতে কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি অনেকটা বাধ্য হয়েই এডওয়ার্ডকে দিয়ে দিলেন তার রত্ন। সেই সাথে ব্রিটিশ রাজ পরিবার বনে গেল রুবির মালিক।  

রুবির অভিশাপ কিন্তু পেদ্রোকে ছাড়েনি। এডওয়ার্ড ফিরে যাবার সাথে সাথেই হেনরি আবার মাথাচাড়া দিলেন। তার সাথে লড়াই করতে করতে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন ডন পেদ্রো। সিংহাসন তো গেলই, ব্যাটল অফ নাজেরার মাত্র তিন বছরের মাথায় অনেকটা নিঃস্ব অবস্থায় প্রাণটাও খোয়ালেন তিনি সৎভাইয়ের হাতে।  

ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিশৃঙ্খলা

এডওয়ার্ডের কাছে ছিল বলে রুবির পোশাকি নাম হয়ে যায় ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবি। দুর্ভোগ তাকেও ঘিরে ধরে। রোগে ভুগে সিংহাসনে বসার আগেই মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে এডওয়ার্ডের মৃত্যু হয়। ফলে তার ছেলে রিচার্ড হয়ে গেলেন ক্রাউন প্রিন্স। তার দখলে চলে এলো বাবার রুবি। পরবর্তীতে দশ বছর বয়সেই দ্বিতীয় রিচার্ড নামে অভিষেক হল তার।

দ্বিতীয় রিচার্ডের ভাগ্যও খুব ভাল ছিল না। তাকে সইতে হচ্ছিল অভিজাতদের বিরোধিতা। এদের অন্যতম জন অফ গন্টের ছেলে হেনরি বলিংব্রুককে তিনি নির্বাসন দিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর হেনরি দেশে ফিরে এলেন, সাথে আনলেন একদল সেনা। রিচার্ডের উপর বিরক্ত অনেকেই তার সাথে যোগ দেয়। ফলে দ্রুতই হেনরির দল ভারী হয়ে গেল। রিচার্ডকে গদি থেকে টেনে নামিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। বলা হয় সেখানেই অনাহারে মৃত্যু হয় দ্বিতীয় রিচার্ডের।

দ্বিতীয় রিচার্ড; Image Source: royal.uk

হেনরি বলিংব্রুক সিংহাসনে বসেছিলেন চতুর্থ হেনরি নামে। ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবি তার অধিকারে চলে আসে। তিনি পত্তন করেন ল্যাঙ্কাস্ট্রিয়ান রাজবংশের। দীর্ঘ রোগে ভুগে হেনরি মারা গেলে ছেলে পঞ্চম হেনরি অভিষিক্ত হন। তিনি নিজ শিরস্ত্রাণের উপর সংযুক্ত করেন ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবি।

এই শিরস্ত্রাণ পরে ১৪১৫ সালের ২৫ অক্টোবর সংঘটিত বিখ্যাত এজিনকোর্টের যুদ্ধে ফরাসীদের বিপক্ষে নেমেছিলেন হেনরি। ময়দানে ফরাসী রাজপুত্র ডিউক অফ অ্যালঁস প্রথম জনের (Duc d’Alençon) মুখোমুখি হলেন ইংল্যান্ডের রাজার। বলা হয় কুঠারের আঘাতে হেনরির শিরস্ত্রাণ প্রায় ভেঙ্গে ফেলেছিলেন তিনি। আরো অনেক ফরাসীও তার উপর আক্রমণ করে। হেনরি বেঁচে গেলেও তার শিরস্ত্রাণ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। তবে যুদ্ধে জয় পান তিনি।

লড়াই শেষ হলে এক ফরাসী ভাঙ্গা টুকরোগুলি জোগাড় করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যায়। হেনরি ফিরে পায় তার রুবি। পুরষ্কার হিসেবে ফরাসী ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ব্যাটল অফ এজিনকোর্টে চতুর্থ হেনরি; Image Source: history.com
Image Source: Royal Collection Trust

টিউডর এবং স্টুয়ার্ট বংশ

ষোড়শ শতাব্দীতে টিউডররা ইংল্যান্ডের রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। প্রথম এলিজাবেথের শাসনামলে স্কটদের রানী মেরিকে ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবি উপহার দেন এলিজাবেথ। পরে এই মেরিকেই মাথা পেতে দিতে হয় জল্লাদের খাঁড়ার নিচে। তার ছেলে জেমসের কাছে রক্ষিত ছিল মায়ের রুবি। তিনি ১৬০৩ সালে ইংল্যান্ডের রাজা হলে টিউডর শাসনের সমাপ্তি ঘটে, সূচনা হয় স্টুয়ার্টদের সময়ের।  

জেমসের পর ছেলে প্রথম চার্লস হিসেবে ক্ষমতা পেলেন। উত্তরাধিকার হিসেবে তার কাছেই চলে গেল ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবি। চার্লসের দুর্ভাগ্যের জন্ম দিয়ে উত্থান হল অলিভার ক্রমওয়েলের। ১৬৪৬ সালে প্রথম ব্রিটিশ গৃহযুদ্ধের অবসানে চার্লসকে গদিচ্যুত করলেন তিনি। এর দুই বছর পর প্রথম চার্লসকে মৃত্যুদণ্ড দেন ক্রমওয়েল।

চার্লসের রত্ন ক্রমওয়েল জব্দ করে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বিক্রির তালিকায় ব্ল্যাক প্রিন্সের রুবির নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না। তবে অনেকেই দুটি রুবি পাথরের যেকোনো একটি এই রত্ন হতে পারে বলে মত দেন। একটি রুবি বিক্রি হয়েছিল চার পাউন্ডে, আরেকটি পনেরো পাউন্ডে। ১৬৬০ সালে এই কেনাবেচা সম্পন্ন হয়।

ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে চার্লসের ছেলে রাজা হন। দ্বিতীয় চার্লস ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবি পুনরায় কিনে নেন। তিনি নিজ মুকুটে এই পাথর স্থাপন করেন। তার শাসনামলে  ডাচদের সাথে যুদ্ধে ব্রিটিশ কোষাগারে টান পড়ে। লড়াইয়ের কোনো সুফল পেতেও চার্লস ব্যর্থ হন।

চার্লসের পর ভাই দ্বিতীয় জেমস সিংহাসনে বসলেও মাত্র তিন বছরের মাথায় বাধ্য হন নির্বাসনে চলে যেতে। এরপর অনেক বছর ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবির তেমন কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।

বর্তমান

ব্রিটিশ রাজপরিবারের গহনাসমূহ দর্শনার্থীদের দেখার জন্য রাখা থাকে টাওয়ার অফ লন্ডনে। ১৮৪১ সালে টাওয়ারে আগুন লাগলে পুলিশ ইন্সপেক্টর পিয়ার্সের সাহসিকতায় রক্ষা পায় সমস্ত গহনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বোমাবর্ষণ থেকেও কোনক্রমে রক্ষা পায় টাওয়ার অফ লন্ডন। বর্তমানে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে টাওয়ার অফ লন্ডন। সেখানে গেলেই দেখা মিলবে ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবির।

টাওয়ার অফ লন্ডনে রাখা ব্রিটিশ মুকুটের রত্ন; Image Source: u.osu.edu

ভালোভাবে খতিয়ে দেখলে ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবির সাথে জড়িত অনেক দুর্ভাগ্যের কাহিনীর যুক্তিপূর্ণ কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। মূলত মানুষের অনিয়ন্ত্রিত লোভ-লালসা থেকেই এসব ঘটনার সূচনা। তবে মানুষের মনে ব্ল্যাক প্রিন্সের  রুবি অভিশপ্ত হিসেবেই থেকে গেছে। 

Related Articles