Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ড্যান্সিং প্লেগ: নাচতে নাচতেই মারা গেলেন অগণিত মানুষ!

মধ্যযুগীয় ফ্রান্সের একটি শহর স্ট্রাসবার্গ। ১৫১৪ সালের জুলাই মাসের কথা, রেনেসাঁ তখন কেবল শুরুর দিকে। আর দশদিনের মতো দিব্যি নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ফ্রাঁউ ট্রফিয়া নামক এক গৃহবধূ। হঠাৎ আশাপাশের সবাইকে চমকে দিয়ে সকালবেলা নাচতে শুরু করলেন তিনি। নাচতে নাচতে বেরিয়ে এলেন প্রধান সড়কে। বলা নেই, কওয়া নেই রাস্তায় এমন করে কাউকে নাচতে দেখলে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হবেন। আর রাস্তার লোকজন যে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। একই ঘটনা ঘটে ট্রফিয়ার সাথে। দর্শকরা মজা পেয়ে হাসতে লাগল, অত্যুৎসাহী কয়েকজন হাততালি দিয়ে উঠল এবং তারস্বরে চেঁচিয়ে ট্রফিয়াকে বাহ্বা দিতে লাগল। লোকজন ভাবতে বাধ্য হলো, ট্রফিয়াকে কি তবে ভূতে ধরেছে?

কিছুদিনের মধ্যে বোঝা গেল এটা কোনো ভূতের কারসাজি নয়। ট্রফিয়া নাচছে তো নাচছেই। তার চোখে-মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে সে নাচ। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা, রাত হয়ে গেল; তারপর এলো পরদিন সকাল। কিন্তু নাচ থামল না ট্রফিয়ার। পাক্কা ছ’দিন ধরে বিরামহীনভাবে নেচেই চলল সে। এক সপ্তাহের মধ্যে আরও প্রায় ৩৪ জন যোগ দিল তার সাথে। মাস শেষে সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়াল চারশতে! এই ড্যান্সিং ম্যানিয়ার ফলে প্রতিদিন প্রায় ১৫ জন করে নাগরিক মৃত্যুবরণ করতে লাগল। শরীরের উপর দিয়ে অমানুষিক ধকল যাওয়ার কারণে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক আর ক্লান্তিতে নিঃশেষিত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল তারা। আগুন নিয়ে খেলতে মাঠে নামতে বাধ্য হলো সরকারি কর্মকর্তারা। অনেক ভেবেচিন্তে নাচানাচি বন্ধ করার উপায় হিসেবে সঙ্গীতজ্ঞদের ভাড়া করে আনলেন তারা। ব্যাপারটা অনেকটা বিষে বিষে বিষক্ষয়ের মতো। শহরের মাঝখানে বিশাল এক মঞ্চ তৈরি করে দাঁড় করিয়ে দিলেন তাদের, কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন ঘটা করে নাচের শখ এবার অচিরেই পালাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হলো তার ঠিক উল্টো। ড্যান্সিং ম্যানিয়া নামক এই পাগলামিতে দলে দলে যোগ দেয়া শুরু করল শহরের বাসিন্দারা। গান-বাজনার তালে তালে মৃত্যু হয় আরও বেশি সংখ্যক মানুষের।

ড্যান্সিং প্লেগ এক বিভীষিকার নাম; Source: historicmysteries.com

১৫১৮ সালের ড্যান্সিং প্লেগ এমন মহামারী আকার ধারণ করল যে লোকজন ট্রফিয়া সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হলো। মধ্যযুগে ডাইনি প্রথার খুব প্রচলন ছিল। ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে অনেক নিরপরাধ নারীকে, এমন নজিরও রয়েছে। কিন্তু ট্রফিয়াকে খুন করার মতো মানুষই বা কোথায়? প্রতিবেশীরাও তখন তার সাথে নাচতে ব্যস্ত। কাজেই ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে হয় গবেষকদের। কী করলে থামবে এই তাণ্ডব নৃত্য? ঐতিহাসিক জন ওয়ালার তার ‘এ টাইম টু ড্যান্স, এ টাইম টু ডাই: দ্য এক্সট্রাঅর্ডিনারি স্টোরি অফ দ্য ড্যান্সিং প্লেগ অফ ১৫১৮’ বইটিতে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করেন। “ঘটনাটিকে এককথায় অবিসংবাদিত বলা যায়,” বলেন মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন। “প্রশ্ন উঠতেই পারে যে ঘটনাটিকে আমরা নাচ বলে দাবি করছি আদৌ কী তা নাচ ছিল, নাকি পাগলের মতো হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি ছিল। ঐতিহাসিক রেকর্ড বলে ভিক্টিমরা কেবল কাঁপছিল বা হাত-পা ছুঁড়ছিল না, তাদের হাত-পায়ের নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছিল কেউ জোরপূর্বক তাদের দিয়ে নাচাচ্ছে”

ড্যান্সিং ম্যানিয়ার শারীরিক বা রাসায়নিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে এগিয়ে আসেন ইউজেন ব্যাকম্যান। ১৯৫২ সালে তার ‘রিলিজিয়াস ড্যান্সেস ইন দ্য ক্রিশ্চিয়ান চার্চ অ্যান্ড ইন পপুলার মেডিসিন’ বইটিতে তিনি ও তার সমসাময়িক কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, স্যাঁতস্যাঁতে রাই থেকে জন্ম নেয়া এরগোট নামক এক ধরনের রোগাক্রান্ত উদ্ভিদই এই ড্যান্সিং ম্যানিয়ার জন্য দায়ী। অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট একটি সম্পূর্ণ নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করে। তার মতে, নাচিয়েরা কোনো এক নতুন ধর্মের দিশা পেয়ে স্বেচ্ছায় নাচতে নাচতে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু জন বলেন নাচিয়েরা স্বেচ্ছায় নাচছিল এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং সে সময়কার বিভিন্ন ছবিতে ফুটে ওঠা তাদের শারীরিক ভাষা অনুযায়ী স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নাচানো হচ্ছিল। চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি না থাকলেও চিকিৎসকদের কাছে নেয়ার পর তারা ভয় এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বলে লিখিত প্রমাণ আছে।

শিল্পীর তুলিতে ড্যান্সিং ম্যানিয়া; Source: history.com

লাগাতার কয়েকটি বড় রকমের দুর্ভিক্ষ ঘটে ঐ অঞ্চলটিতে। কনকনে শীত, কাঠফাটা রৌদ্র, কখনো অনাবৃষ্টি, কখনো বা শিলাবৃষ্টি, তার উপর নাচের এই বাতিক- সব মিলিয়ে ফ্রান্সের তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। জন বলেন, সে সময়কার দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মধ্যে খুব সাধারণ একটি শারীরিক সমস্যা ছিল অপুষ্টি। বেঁচে থাকার নিমিত্তে গোয়াল উজাড় করে নিজেদের শেষ সম্বলটুকুও খেতে দ্বিধা করেনি তারা। ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে থালা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে বাধ্য লোকের সংখ্যা একেবারে কম না। গুটি বসন্ত, সিফিলিস, কুষ্ঠ ছাড়াও নতুন নতুন বেশ কিছু রোগ দেখা দেয় এই অঞ্চলে। “উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার কারণে শারীরিক তো বটেই, মানসিক নানা রোগও বাঁধিয়ে ফেলছিল তারা,” বলেন জন। নাচের এই ব্যাপারটিকে এক ধরনের প্লেগ বলে আখ্যা দেন সিসিলিয়ান পাদ্রী সেইন্ট ভিটাস।

তবে ড্যান্সিং প্লেগের সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ইভান ক্রোজিয়ার, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক তিনি। ডিসকভারি নিউজকে দেয়া এক তথ্যমতে, জনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন তিনি। পুরো বিষয়টিকে তিনি ‘মাস হিস্টিরিয়া’ বলে অভিহিত করেন। রাইন নদীর তীরবর্তী জনগণের দুঃখ-কষ্টের স্বরূপ ছিল একই। একই দুর্ভাগ্যকে বরণ করে নেয়া জাতির মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এরগোটের প্রভাব। এর প্রভাবে তারা একপ্রকার ঘোরের মধ্যে চলে যায়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নাচতে শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দীতে এরকম একটি মাস হিস্টিরিয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। সে সময় অকস্মাৎ মানুষের শরীর কুঁচকে আসতে থাকে, যৌনাঙ্গ ভেতরে ঢুকে যেতে থাকে। আফ্রিকা আর এশিয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, মাইলের পর মাইল এলাকা থেকে লোকজন যেন বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে উগান্ডা আর তানজানিয়ায় ঘটে ‘তানজানকিয়া লাফটার এপিডেমিকের’ ঘটনা। তানজানিয়ার এক মিশনারি স্কুলে হঠাৎ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে তিন স্কুল ছাত্রী। তাদের হাসি ছড়িয়ে পড়ে সারা স্কুলে, সারা গ্রামে, সারা দেশে, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ উগান্ডায়ও! আঠারো মাসব্যাপী চলে সে হাসি। সিঙ্গাপুর মেডিকেল জার্নালের মতে, ১৯৬৭ সালে গণভীতির শিকার হয়ে সিঙ্গাপুরে প্রায় ১,০০০ মানুষ মারা যায়। কাজেই মাস হিস্টিরিয়া কোনো নতুন বিষয় নয়, নতুন কেবল তাদের ধরন।

জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়া নাচের আবেশ; Source: history.com

১৫১৪ সালের এই ড্যান্সিং প্লেগ শেষপর্যন্ত কীভাবে থেমেছিল তা জানা যায়নি। তবে মধ্যযুগীয় ইউরোপে একই রকম ঘটনা আরও প্রায় ৭ বার ঘটেছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই স্ট্রাসবার্গকে কেন্দ্র করে ঘটে। সাম্প্রতিক সময়গুলোর মধ্যে ১৮৪০ সালে মাদাগাস্কারের সংক্রমণটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী, মহামারীতে আক্রান্ত রোগীরা পাগলের মতো নাচছিল, কেন কী করছিল তারা তা নিজেরাও জানে না। বাকিরা ধরে নিয়েছিল দুষ্টু আত্মার খপ্পরে পড়েই বোধহয় তাদের এই অবস্থা। তারপর একদিন যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল, ঠিক তেমনি হঠাৎ করে থেমে যায়নি এই রোগ। চিকিৎসকরা অনেক মাথা খাটিয়ে, নতুন নতুন প্রতিষেধক তৈরি করে, রোগীদের হাত-পা বিছানার সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনেন।

ভ্যান্ডারবিল্ট মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল প্রফেসর টিমোথি জোনসের মতে, এ ধরনের মাস হিস্টিরিয়া কেন হয় আর কীভাবে হয় তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এরকম কোনো মহামারী ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে সুস্থদের যতটা সম্ভব আলাদা রাখা প্রয়োজন। তেমন অবস্থা হলে অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ভূত এসব রোগের একটিই সমাধান আছে, বায়ু পরিবর্তন। তবে সাধারণত দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে এসব রোগ বেশি দেখা যায়, যেখানে এমন বায়ু পরিবর্তনের চিন্তা বাহুল্য বৈকি।

নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা তো নিজের হাতেই। টিমোথি বলেন, ড্যান্সিং প্লেগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি ট্রফিয়াকে সামলানোর চেষ্টা করতো, নিজেরা মাথা ঠাণ্ডা রাখত, তাহলে হয়তো অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। তবে তখন কী ঘটেছিল, সেটা প্রত্যক্ষদর্শী আর আক্রান্তরাই ভালো বলতে পারবে। মাঝে মাঝে মানব মনে এমন কিছু অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয় যা ব্যাখ্যাতীত। ড্যান্সিং প্লেগকেও তেমন একটি অস্বাভাবিক রোগ বলে ব্যাখ্যা করেছেন টিমোথি।

ফিচার ইমেজ- peru.com

Related Articles