আইমান ডি ভ্যালেরা ও স্বাধীন আয়ারল্যান্ড নাম দুটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আয়ারল্যান্ডকে যুক্তরাজ্যের অধীন থেকে মুক্ত করে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করতে তার অবদান অনস্বীকার্য।
ব্রিটিশ শাসকদের ধারণা ছিলো, আয়ারল্যান্ড তাদের নিছক এক উপনিবেশ মাত্র। সুতরাং এই অঞ্চল সবসময় তাদের পদানত থাকতে বাধ্য। এছাড়া কিছু সাংস্কৃতিক পার্থক্য রাজনৈতিক সংঘর্ষ আরো তীব্র করে তুলেছিলো। আইরিশ ক্যাথলিক মতবাদ অঞ্চলটির রাজনৈতিক ভিন্নতার এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলো। সেজন্য অ্যাংলিকান মতাবলম্বী ব্রিটেন আয়ারল্যান্ডের যেকোনো বিদ্রোহ দমন করতে বদ্ধপরিকর ছিলো।
‘আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি’ ব্রিটেনের নাগপাশ থেকে আয়ারল্যান্ডকে মুক্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেয়। তাদের নেতৃত্বে ১৯১৬ সালে যে সক্রিয় অসন্তোষ শুরু হয়, তা ‘ইস্টার রাইজিং’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলো। সে বছরের এপ্রিল মাসেই আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
আয়ারল্যান্ডে ১৯১৮ সালের নির্বাচনে সিন ফেইনের দল রিপাবলিকান দল বিপুল ভোটে জয়ী হয়। দলের এই বিজয় ব্রিটেনের আধিপত্যবাদী নীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ১৯১৯ সালে এক বিদ্রোহী সরকার গঠনের পর স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ফলে ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়র উঠলো। বেশ কিছু রক্তপাতের ঘটনার পর সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশ সরকার আয়ারল্যান্ডের নবগঠিত রিপাবলিকান সরকার অবৈধ ঘোষণা করে বসে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় আকস্মিক হামলা শুরু করে। এর ফলে আয়ারল্যান্ডে শ্রমিক বিদ্রোহ হলো। আইরিশ রেলশ্রমিকরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকের দলকে পরিবহনে কোনোরকম সাহায্য করতে অস্বীকার করে।
আইরিশদের বিদ্রোহের একপর্যায়ে ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশ সরকারের নাভিশ্বাস ওঠে। বিদ্রোহের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধকল ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীনতা দিতে সম্মত হয়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের কর্তৃপক্ষের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণ অংশ সেবছর ৬ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। আইমান ডি ভ্যালেরা দেশটির সংবিধান রচনার নেতৃত্ব দিলেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
মজার ঘটনা হচ্ছে- আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই নেতা একবার কারাবন্দী থাকার সময় আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য উপায়ে জেল থেকে পালিয়েছিলেন। সেই ঘটনা তখনকার পৃথিবীকে বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। আজকের গল্প ডি ভ্যালেরার সেই জেল পালানোর উপাখ্যান নিয়ে।
১৯১৬ সালে ডাবলিনে ঘটিত ‘ইস্টার রাইজিং’ বিদ্রোহে ডি ভ্যালেরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। সেই ঘটনায় হয়ে যাওয়া হতাহতের ঘটনায় তার রাজনৈতিক সংগঠন রিপাবলিকান দলের অনেক সদস্যের মৃত্যুদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগের শাস্তি দেওয়া হয়। তিনি কার্যত দলের প্রধান নেতায় পরিণত হলেন।
১৯১৮ সালে জার্মানীর সাথে এক মিলিত চক্রান্তের অভিযোগে ডি ভ্যালেরাকে গ্রেফতার করা হয়। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি, রাজনীতিবিদ ও জাতীয়তাবাদী মিলিয়ে প্রায় ৭২ জন নেতাকর্মী হাজতবাসের শিকার হলেন। তাদের কয়েকজনকে ওয়েলসের মনুমেন্টশায়ার অঞ্চলের জেলে পাঠানো হলো। ডি ভ্যালেরাসহ কয়েকজনকে পাঠানো হলো পূর্ব-মধ্য ইংল্যান্ডের লিংকন এলাকায়।
লিংকন জেলখানা শহরটির পূর্বদিকে অবস্থিত। ১৮৭২ সালে এটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। তৈরির পর থেকে তখন অবধি এই জেলখানা থেকে আসামী পালিয়ে যাবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেসময় ব্রিটেন থেকে আমেরিকায় এক কূটনৈতিক মিশন যাবার কথা, যার দায়িত্ব ছিলো আয়ারল্যান্ড আংশিকভাবে তখনও ব্রিটেনের অধীনে থাকতে ইচ্ছুক- এমন মত প্রচার করা। ভ্যালেরা এর বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু কয়েদে থাকার কারণে পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার ঝুঁকি তৈরি হয়েছিলো।
সেজন্য ডি ভ্যালেরা একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়ানক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিলেন।
জেলে কয়েকদিন থাকার ফলে এক্সারসাইজ ইয়ার্ডের দরজা ভালো করে দেখার সুযোগ তার হয়েছিলো। তিনি পারিবারিকভাবে ক্যাথলিক মতের অনুসারী খ্রিস্টান ছিলেন। সেই সূত্রে ধর্ম পালনের অংশ হিসেবে পূর্বে জেলখাটা আসামীদের কনফেস করানোর কাজ করার অভিজ্ঞতা তার ছিলো। এই অভিজ্ঞতা এখানে ভাগ্যক্রমে কাজে লেগে গেলো। এবার ধর্মের কাজ করতে গিয়ে জেলখানার চ্যাপেলে যাওয়া আসার সময় চাবির গোছা দেখা সুযোগ তার হয়েছিলো।
তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করার এক পদক্ষেপ নিলেন। জেলখানার চাবির নকশা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। মনে গেঁথে নিলেন চাবির নির্ভুল প্রতিবিম্ব। জেলখানার চার্চ থেকে সংগ্রহ করা মোমের মধ্যে চাবির নকশা এঁকে রাখলেন ! পরের কাজটি ছিলো আরো কঠিন। এই নকশা কীভাবে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সহযোদ্ধাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে- সে প্রশ্ন নিয়ে প্রথমে মতভেদ দেখা দিয়েছিলো। পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো- জেলখানা থেকে আত্মীয়ের কাছে পাঠানো পোস্টকার্ডে কোনোভাবে মোমে তোলা চাবির নকশার একটি গোপন ছাপ এঁকে পাঠানো হবে।
ডি ভ্যালেরার সহবন্দী শন ম্যালরয়কে এই অসাধ্য সাধনের দায়িত্ব দেওয়া হলো। তিনি এক মজার কাজ করলেন। পোস্টকার্ডের উপর একটি কার্টুন ধাঁচের ছবি আঁকলেন। কার্টুনে এক বোকা ধরনের লোককে বেশ বড় একটি চাবি অনেক ছোট একটি তালায় ঢোকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়। সাধারণভাবে কার্ডটিকে দেখতে যেকোনো ক্রিস্টমাস কার্ডের মতোই দেখতে। প্রহরীরা কিছুই বুঝতে পারলো না। জেলের বাইরে থাকা সহযোদ্ধাদের কাছে ডি ভ্যালেরার করা চাবির নকশাই গেলো !
এদিকে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সহযোদ্ধাদের কাছে যথাসময়েই সেই পোস্টকার্ড পৌঁছে গিয়েছিলো। পোস্টকার্ডে ডি ভ্যালেরা’র করা নকশা অনুযায়ী চাবিও তৈরি হলো। চাবিটি একটি কেকের ভেতরে লুকিয়ে হাজতের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। ফিন্টন মার্ফি নামের একজন লোক কেকটি জেলের মধ্যে এনে দিয়েছিলো।
ভ্যালেরা ও অন্যান্য আসামীদের কাছে কেক পৌঁছানোর আগে জেল কর্তৃপক্ষ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে সন্দেহ মুক্ত হতে চেয়েছিলো। লুকানো বস্তু থাকার সন্দেহে কেক কেটে পর্যন্ত দেখা হয়েছিলো। কয়েদীদের ভাগ্য ভালো ছিলো, সেসময় চাবি ধরা পড়েনি। কিন্তু চাবি তৈরির এই ধাপটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলো। কারণ এই চাবিটি দিয়ে তালা খোলা যায়নি!
ডি ভ্যালেরা সিদ্ধান্তে আসলেন যে, মোমের উপর চাবির যে ছাপ নেওয়া হয়েছিলো, সময়ের সাথে তা সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় চাবির নকশা তোলা সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায়নি।
একই পদক্ষেপ আবারও নেওয়া হলো। এবারে চাবির নকশা একটি সুদৃশ্য কেলটিক প্যাটার্নের মধ্যে এঁকে পাঠানো হলো। আগের মতো এবারও জেলের বাইরে থেকে চাবি তৈরি করে একটি কেকের মধ্যে জেলের ভেতর পাঠানো হলো।
এবারও এই পদক্ষেপ আগের মতোই ব্যর্থ হলো। অথচ এবারে অন্তত তার অবকাশ কিছুটা কম বলে ভাবা হয়েছিলো!
সুতরাং আবারও একই উদ্যোগ নেওয়া হলো। তবে এবার চাবি বানিয়ে কেকের মধ্যে পাঠানোর প্ল্যান বাতিল করা হলো। তার বদলে কেকের মধ্যে চাবি বানানোর উপযোগী লোহার পাত ও কিছু ফাইল পাঠানো হলো। লক্ষ্য ছিলো, কয়েদে থাকা রাজবন্দীরা যেন এসবে ব্যবহার করে নকশা অনুযায়ী নিজেরাই চাবি বানিয়ে সময়মতো নিজেদের কাজ হাসিল করতে পারেন।
কয়েদীদের মধ্যে একজন ছিলেন পিটার ডেলাফ্রি। এবার তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। চাবি তৈরির আগে তিনি তালা ভালো করে পরীক্ষা করে নিলেন। চাবি তৈরির ব্যাপারে তার অন্যরকম কিছু দক্ষতা ছিলো, যা তার সহবন্দীদের মধ্যে আর কারো ছিলো না। তিনি তার বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে এমন একটি চাবি তৈরি করলেন, যা শুধু তাদের সেল নয়, জেলখানার যেকোনো সেলের তালা খোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
সেদিন ছিলো ১৯১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি।
সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে ডি ভ্যালেরা, ম্যালরয় ও শন ম্যাকগ্যারি শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। পিটার ডেলাফ্রি তাদের হাতে চাবি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই চাবি দিয়ে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ সেলের তালা খুলে বের হলেন। তারপর বাইরে থেকে সেলের তালা আবার অবিকল আগের মতো লাগিয়ে দিলেন। অন্ধকার থাকায় এক্সারসাইজ ইয়ার্ডের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে তাদের কোনো ঝামেলাই হলো না। জেলখানার মূল ফটক বিনা বাঁধায় পার হয়ে তারা মুক্তির নিঃশ্বাস নিলেন।
This Bangla article is about the escaping of De Valera from British prison in an unbelievable way.
References:
01. De Valera escaped English prison with a key in a cake 100 years ago today
02. How a fruit cake helped Eamon de Valera escape Lincoln Prison