পৃথিবীতে এমন কিছু রহস্যজনক ঘটনা ঘটে যা এতটাই অস্বাভাবিক আর রহস্যে ঘেরা যে মানুষকে রাতের পর রাত ভাবিয়ে চলে। কানাডিয়ান নাগরিক এলিসা লামের মৃত্যুটিও সেই কাতারেই পড়বে। ঘটনাটি খুব বেশি পুরাতনও নয়, এইতো ২০১৩ সালের ঘটনা। মৃত এলিসা লামকে খুঁজে পাওয়া যায় এক অস্বাভাবিক জায়গা থেকে। কিন্তু গল্পটি শুধু সেই অস্বাভাবিক জায়গারই নয়, এর আগের কাহিনীগুলো আপনাকে আরো অবাক করবে তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। তো চলুন শুরু করা যাক সেই গল্প।
কাহিনীর শুরু
এলিসা লাম, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একজন ছাত্রী। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাস চলছিল তখন। এলিসা লাম দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা ভ্রমণের জন্য বের হলেন। একা। তার লেখা ব্লগ থেকে জানা যায় তিনি স্যান ডিয়েগো, লস অ্যাঞ্জেলস, সান্টা ক্রুজ এবং সান ফ্রান্সিসকোতে ঘোরার কথা চিন্তা করছিলেন।
চিত্রঃ এলিসা লাম; Image Source: www.dailymail.co.uk
২৬ জানুয়ারি তিনি লস অ্যাঞ্জেলস পৌঁছান। ২ দিন পরেই তিনি সেখানে সিসিল নামের একটি হোটেলের ষষ্ঠ তালায় রুম ভাড়া নেন। প্রথমেই লাম আরেকজনের সাথে শেয়ার করা একটা রুম ভাড়া নেন। কিন্তু লামের রুমমেট হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে লামের অস্বাভাবিক আচরণের জন্য অভিযোগ করে বসলে ২ দিনের মাঝে লামকে আলাদা একটি রুম দেয়া হয়।
চিত্রঃ হোটেল সিসিল; Image Source: www.dailymail.co.uk/)
এলিসা লামের ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ এবং হতাশার মতো কিছু মানসিক ব্যাধিও ছিল। ৩১ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত লাম তার পিতা মাতার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিল। ৩১ জানুয়ারি এলিসা লামের হোটেল রুমটি ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল এবং সান্টা ক্রুজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এদিন থেকেই লামের সাথে তার পরিবারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরই লামের বাবা-মা লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশকে ফোন দেয় এবং নিজেরাও লস অ্যাঞ্জেলস ছুঁটে আসে পুলিশকে সাহায্য করার জন্য।
কোথায় গেল এলিসা লাম?
৩১ জানুয়ারি হোটেলের বাইরে এলিসা লামকে শেষ দেখেন হোটেলের কাছাকাছি একটি বই এর দোকানের ম্যানেজার ক্যাটি অরফান। তার ভাষ্যমতে এলিসা লামকে অনেক জীবন্ত আর বন্ধুত্বপূর্ণ লাগছিল। সে তার পরিবারের জন্য বিভিন্ন উপহারও কিনেছিল। ভ্রমণের সুবিধার্থে মোটা বই কিনতে চাচ্ছিল না লাম।
আরো এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। কিন্তু এলিসা লামের কোনো খোঁজ নেই। ১৪ ফেব্রুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ এলিসা লামের এক রহস্যজনক ভিডিও প্রকাশ করে। ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছিল সিসিল হোটেলের নজরদারি ক্যামেরা থেকে। ভিডিওর তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি। স্থান সিসিল হোটেলের একটি লিফটে।
রহস্যজনক সেই ভিডিওটি
আড়াই মিনিটের এই ভিডিওতে লিফটের ভেতরে এবং বাইরের হলওয়ে উভয় জায়গাই দেখতে পাওয়া যায়। ভিডিওর শুরুতেই লাম লিফটে প্রবেশ করে। সে বাম দিক থেকে প্রবেশ করে লিফটের সুইচগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। সে প্রায় লিফটের সব সুইচই টিপতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে লিফটের দরজা বন্ধ হতে ব্যর্থ হলে লাম সন্দেহজনকভাবে লিফটের সামনে এগিয়ে এসে তার মাথা লিফট থেকে বের করে বাম ডান দুদিকেই তাকাতে থাকে। আর তার পরপরই আবার লিফটে ঢুকে যায়। এবং মনে হতে থাকে সে লিফটের ভেতরে লুকানোর চেষ্টা করছে। লিফটের দরজা তখনও খোলাই থাকে। বন্ধ হয় না।
Image Source: wereblog.com
এরপর সে বেশ কয়েকবার লিফটের বাইরে একবার আর ভেতরে একবার যাওয়া আসা করে আর এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। কিন্তু সে কোনোরকম চিৎকার করছিল না। লিফটের দরজা তখনও খোলা।
সে আবার লিফটে প্রবেশ করে এবং এবার আরো কয়েকটি সুইচ টিপে দেয়। কোন কোন সুইচ একাধিকবার টিপে দেয়। দু হাত দিয়ে একসময় কান চেপে ধরে। তখনও লিফটের দরজা খোলা।
সে ডানদিকে ঘুরে যায় এবং তার দু’হাতের তালু একে অপরের সাথে ঘষতে থাকে। এরপর সে লিফট থেকে হেঁটে দূরে চলে যায়। লিফটটি অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল। বেশ কয়েকবার। চাইলে যে কেউই ইন্টারনেট থেকে এই ভিডিওটি দেখে নিতে পারে।
ভিডিও শেষ! এই ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ঝড় তোলে। চীনের ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইয়ুকুতে ১ম ১০ দিনেই এই ভিডিও ৩০ লক্ষবার দেখা হয়ে যায় এবং ৪০ হাজার কমেন্ট পরে।
তারপর………
পুলিশ তখনও তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছে এলিসা লামকে। এরই মাঝে সিসিল হোটেলের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন তাদের ট্যাপে অনেক ধীরে পানি আসছে। কেউ কেউ পানিতে খারাপ রঙ আর একটা অস্বাভাবিক গন্ধের কথাও বলেন। ১৯ ফেব্রুয়ারির সকালে কর্মচারিরা হোটেলের ছাদে যান যেখানে ৪ টি ১০০০ গ্যালনের পানির ট্যাঙ্ক ছিল। তারা মূলত গিয়েছিলেন পানির কী সমস্যা তা ঠিক করতে। সেই পানির ট্যাঙ্কেই এলিসা লামকে খুঁজে পাওয়া গেল। সামনের দিকে মুখ দিয়ে লামের মৃতদেহটি ভাসছিল। তার এক পা ছিল পানির ভেতরে নিমজ্জিত। তার শরীর ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন। আর কাপড় চোপড় তার পাশেই ভাসছিল। সেই কাপড় চোপড়গুলো যা সে লিফটের ভিডিওতে পড়ে ছিল।
Image Source: www.dailymail.co.uk
অমীমাংসিত রহস্য
হোটেলের ছাদে যাওয়ার জন্য যে দরজার সিঁড়ি তা সবসময় তালাবন্ধ থাকত। শুধুমাত্র কর্মচারিদের কাছে এর চাবি আর পাসকোড থাকত। আর এ দরজাগুলো খোলার যেকোন অন্য উপায় ব্যবহার করতে গেলে তা অ্যালার্ম বাজানোর কথা ছিল। যদিও হোটেলের ফায়ার স্কেপ ব্যবহারের মাধ্যমে এসবকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব ছিল, যদি লাম বা, অন্য কেউ (যদি থেকে থাকে) যে তার সাথে ছিল এ বিষয়ে জানত।
এছাড়াও সব ট্যাঙ্ক ছিল অনেক উঁচু। সেখানে সরাসরি যাওয়ার কোন সিঁড়ি বা, মই নেই। হোটেলের কর্মচারিদের একটা বহনযোগ্য মই দিয়ে ট্যাঙ্কির পানি দেখতে হয়। ট্যাঙ্কের মাথায় অত্যন্ত ভারি ঢাকনা রয়েছে, যা সরানো খুবই কঠিন। বিশেষ করে একজন মেয়ের পক্ষে।
Image Source: www.dailymail.co.uk
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয় এলিসা হঠাৎ করেই পানিতে ডুবে মারা গেছে। তার শরীরে যৌন হামলারও কোনো চিহ্ন নেই। এমনকি ধ্বস্তাধ্বস্তি বা, কোন শারিরীক আঘাতেরও চিহ্ন নেই। ডাক্তাররা এমন কোন চিহ্ন খুঁজে পাননি যা নির্দেশ করে এলিসা লাম আত্মহত্যা করেছিল। এমনকি সে মাদকাসক্তও ছিল না সে সময়।
মৃত্যুর পর থেকেই এলিসার টাম্বলার ব্লগটিতে প্রায়ই লেখা আসে। এটা হতে পারে ব্লগটির আগে থেকেই পোস্ট সিডিউল করার সিস্টেমের জন্য। আবার মৃত্যুর পরে তার জামা কাপড়ের সাথে তার ঘড়ি আর রুমের চাবি পাওয়া গেলেও মোবাইল ফোনটি পাওয়া যায়নি। হতে পারে তাকে হয়ত যে হত্যা করেছে সে তার মোবাইলটি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল যা থেকে সে তার ব্লগ থেকে পোস্ট করে। বা কোনো হ্যাকারও এমন ঘটনার পর মজা করার জন্যও এমন করতে পারে।
আরও রহস্য
লামের এই মৃত্যু ২০১৩ সালে হলেও ২০০৫ সালে তৈরি “ডার্ক ওয়াটার” বা, কালো পানি নামের এক সিনেমার সাথে এই ঘটনার দারুণ মিল পাওয়া যায়। যে সিনেমাটি আবার ছিল একই নামের একটি জাপানিজ সিনেমার রিমেক যা ১৯৯৬ সালে লেখা এক ছোট্ট গল্পকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। সিনেমাটিতে দেখানো হয় এক মা আর তার মেয়ে এক নতুন বাড়িতে ওঠার পর বুঝতে পারে বাড়িটি ভূতুড়ে। সেই সিনেমাতেও একটি এমন নষ্ট লিফট দেখানো হয়। সাথে ছিল পানির খারাপ রঙ। এ পানির খারাপ রঙ তাদের টেনে নিয়ে যায় ছাদের উপড়ে থাকা পানির ট্যাঙ্কে যার ভেতরে তারা এক তরুণী মেয়ের মৃতদেহ আবিষ্কার করে যাকে এক বছর আগে থেকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
Image Source: amazon.com
এছাড়াও এ ঘটনার পর, ২০১৩ সালেই ক্যাসল নামের এক বিখ্যাত সিরিজে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি পর্ব তৈরি করা হয়। ২০১৫ সালে আমেরিকান হরর স্টোরির পঞ্চম সিজনও লামের এই মৃত্যুর ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো হয়েছিল।
এলিসা লামের মৃত্যুর কারণ এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। কী ছিল তার মৃত্যুর কারণ? আত্নহত্যা, নাকি খুন? নাকি ভূতুড়ে কোনো ব্যাপার স্যাপার? সে বিষয়ে অনেক তত্ত্বই রয়েছে তা না হয় বিস্তারিতভাবে আরেকদিন জানব আমরা। আজ জানলেন সবচেয়ে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে রহস্যে ঘেরা এক মৃত্যুর কথা। কেমন লাগল তা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।
This article is in Bangla language. It's about the mysterious death of Elisa Lam.
References: dailymail.co.uk
Featured Image: crimescenedb.com