৬ জুলাই, ১৯৭৭। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান করেন তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক। বারবার সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের জন্য এটি নতুন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, নতুন ছিল না পাকিস্তানের তখনকার রাজনীতিবিদদের জন্যও।
১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ আর্মিতে যোগ দেওয়া জেনারেল জিয়াউল হক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, বার্মাতে লড়েন জাপানিজ আর্মির বিরুদ্ধে। স্বাধীন পাকিস্তানের অভ্যুদয় হলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হন তিনি, দ্রুতই প্রমোশন পেয়ে চলে আসেন সামরিক বাহিনীর শীর্ষপদে। জুলফিকার আলী ভুট্টো সাতজন সিনিয়র লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে ডিঙিয়ে সেনাপ্রধান করেন তখনকার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউল হককে। সেনাপ্রধানের পদে নিয়োগের পাশাপাশি চার তারকা জেনারেল পদেও প্রমোশন পান জিয়াউল হক।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বারবার সামরিক বাহিনীকে অভ্যুত্থান ঘটানোর সুযোগ দিয়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে সামরিক বাহিনীর, ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরিতে ভূমিকা রয়েছে তাদের সাংগঠনিক দক্ষতারও। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা, জেনারেল আইয়ুব খান, জেনারেল ইয়াহিয়া খানদের মতো এই প্রভাবকগুলোকে কাজে লাগিয়েই ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউল হক।
ক্ষমতা দখল করেই সামরিক আইন জারি করেন জিয়াউল হক। তার এগারো বছরের শাসনের মধ্যে পাকিস্তানকে আট বছরই কাটাতে হয়েছে সামরিক আইনের মধ্যেই। পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা এই শাসকের শাসনের সমাপ্তি ঘটে বিমান দুর্ঘটনার মাধ্যমে, ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট।
১৭ আগস্ট, ১৯৮৮
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি আর পাকিস্তানের নিরাপত্তার ধারণাকে কেন্দ্র করে জেনারেল জিয়াউল হক শুরু থেকেই মনোযোগ দেন সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে। এই লক্ষ্যে তিনি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে যুক্ত করেন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান, সামরিক বাহিনীতে বাড়ে ফিল্ড ইকুইপমেন্টের সরবারহ, সমৃদ্ধ হয় আর্টিলারি। দুর্ঘটনার দিন তিনি বাওয়ালপুর গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের তৈরি এম-৩১ ট্যাংকের মহড়া দেখতে, রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ৩৩০ মাইল দক্ষিণে বাহওয়ালপুর টেস্ট ফিল্ডে।
ট্যাংকের মহড়া দেখে ফেরার পথে বিধ্বস্ত হয় লকহিড মার্টিনের তৈরি সি-১৩০বি বিমানটি, উড্ডয়নের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মাটিতে আছড়ে পড়ে ৬০-৭০ ডিগ্রি কোণে। জেনারেল জিয়াউল হকের পাশাপাশি নিহত হন পাকিস্তানে তখনকার আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল ও মিলিটারি অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম ওয়াসম।
নিহতদের মধ্যে আরও ছিলেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল আখতার আবদুর রহমান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) জেনারেল মোহাম্মদ আফজাল, ছিলেন জিয়াউল হকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সিদ্দিক সালেক। জেনারেল সিদ্দিক সালেক 'উইটনেস টু সারেন্ডার' বইয়ের লেখক।
যান্ত্রিক ত্রুটি নাকি মানুষের ষড়যন্ত্র?
সাতজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জিয়াউল হককে সেনাপ্রধান করেছিলেন জুলফিকার আলী ভূট্টো। জনশ্রুতি আছে, জুলফিকার আলীর ভুট্টোর জুতাও পালিশ করে দিয়েছিলেন জিয়াউল হক! সেই ভুট্টোর বিরুদ্ধেই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান তিনি, আড়াই বছরের মাথায় ফাঁসিয়ে ঝুলিয়ে কার্যকর করেন মৃত্যুদণ্ড। ফলে জিয়াউল হকের মৃত্যুর পরপরই বেনজির ভুট্টো একে আখ্যায়িত করেন ‘আল্লাহর গজব’ হিসেবে।
দ্রুতই অবশ্য এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। লকহিড মার্টিনের তৈরি করা চার ইঞ্জিনবিশিষ্ট বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে, সময়ের সাথে সাথে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিতে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি কয়েকজন টেকনিক্যাল এক্সপার্টও সরবরাহ করে তারা।
কিন্তু এই যৌথ তদন্ত কমিটি কখনোই ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বিমান দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যান্ত্রিক ত্রুটিকে দায়ী করে। পাকিস্তান তাদের রিপোর্টে কাউকে দায়ী না করলেও বিমান দুর্ঘটনাকে নাশকতার ফলাফল হিসেবে তুলে ধরে। সময়ের সাথে সাথে অনেকগুলো নতুন ভাষ্য আসে এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে, শক্তিশালী হয় পাকিস্তানের দাবি।
আমের মধ্যে ভিএক্স গ্যাস?
দুর্ঘটনার শিকার হওয়া পাক ওয়ানের বিমানটি উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিমানবন্দরের সাথে। তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, উড্ডয়নের পরপরই খাবি খেতে শুরু করে বিমানটি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আছড়ে পড়ে মাটিতে।
পাকিস্তানের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, তদন্তকারীরা দুর্ঘটনাস্থলে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পান। রাসায়নিক হামলার উপযুক্ত গ্যাসগুলোর মধ্যে দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিতি ছিল ফসফরাস, ক্লোরিন, পটাসিয়াম ও এন্টিমোনির। রাসায়নিক হামলার দাবিকে শক্তিশালী করে বিমানের মধ্যে থাকা আমের বীজে ফসফরাসের উপস্থিতি, যার উপস্থিতি পাওয়া যায় মৃতদেহের চামড়াতেও।
স্বাধীন সংবাদপত্র হিসেবে পরিচিত ফ্রাইডে টাইমসে ২০০৪ সালে পাকিস্তানি রাজনৈতিক বিশ্লেষক খালিদ হাসান দাবি করেন, বিমানকে দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দিতে ভিএক্স গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এই গ্যাস মানুষের স্নায়ুকে দুর্বল ও পেশিকে অক্ষম করে দেয়। সম্ভবত, এই গ্যাসের মাধ্যমে যাত্রীদের পাশাপাশি আক্রান্ত হন বিমানের পাইলটরাও। ফলে ঘটে এই দুর্ঘটনা। কূটনৈতিক তথ্যের বরাতে একইরকম দাবি করেছেন সেই সময়ে ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জন গুন্থার ডিনও।
এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর ভূরাজনীতিকে কেন্দ্র করে এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে আরো অনেকগুলো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব তৈরি হয়েছে। দুর্ঘটনার পর বিমানের ব্ল্যাকবক্স পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যাপারে কোনো উপসংহারে পৌঁছার আগ্রহ দেখায়নি। ফলে শক্তিশালী হয়েছে ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো। বিমান দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে দায়ী করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলোকে, হত্যাকান্ড ঘটানোর অভিযোগে আঙুল উঠেছে বিভিন্ন দেশের দিকেও।
কে হত্যা করেছে জেনারেল জিয়াউল হককে?
ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জন করলেও একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে কখনোই আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি পাকিস্তান। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকেছে সংঘাতময়, বারবার ঘটেছে সামরিক অভ্যুত্থান। সংঘাত আর অবিশ্বাসের দোলচলের রাজনীতির মধ্যেই এগারো বছর ক্ষমতায় ছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। এর পাশাপাশি স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতায় ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল পাকিস্তানের। এই প্রেক্ষাপটে দেশ আর দেশের বাইরে প্রচুর শত্রু তৈরি হয় তার।
বিমান দুর্ঘটনায় জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর প্রথম প্রশ্নই ছিল- এটা কি সামরিক অভ্যুত্থান? সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রথম সন্দেহের তির যায় চিফ অব স্টাফ জেনারেল আসলাম বেগের দিকে। জিয়াউল হকের সফরসঙ্গী হলেও তিনি ফেরেন আলাদা বিমানে। জিয়াউল হকের সাথে পাঁচজন শীর্ষ সামরিক অফিসার নিহত হলে তিনিই হন নতুন সেনাপ্রধান। স্বভাবতই সন্দেহ ঘনীভূত হয় তাকে কেন্দ্র করে।
কিন্তু জেনারেল আসলাম বেগ সেনাপ্রধান হলেও তিনি ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেননি। বরং অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টকে তিনি পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন, আনুগত্য ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিও। একইরকম আনুগত্য তিনি দেখান যখন বেনজীর ভুট্টো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তখনও। ফলে এই দুর্ঘটনায় জেনারেল আসলাম বেগের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহগুলো দেয় না। তাছাড়া আসলাম বেগ আলাদা বিমানে ফিরে আসবেন, এটি পূর্ব-নির্ধারিতই ছিল।
এরপরের সন্দেহের তির যায় মেজর জেনারেল মাহমুদ আলী দুরানীর দিকে। বাহওয়ালপুরের দায়িত্বে থাকা এই জেনারেল মৌসুমি আম দেন প্রেসিডেন্টকে, যেগুলোতে পরবর্তীতে অতিরিক্ত পরিমাণে ফসফরাসের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু জিয়াউল হকের নিহত হবার ঘটনাতে সরাসরি উপকারভোগী জেনারেল দুরানী ছিলেন না, শীর্ষ মিলিটারি অফিসার হিসেবে ক্ষমতা দখলের সুযোগ থাকলেও হাঁটেননি সেই পথে। প্রটোকল অনুযায়ী আমগুলোকে কয়েক দফা পরীক্ষা করার দাবি জেনারেল দুরানী করেন, সত্যতা মিলেছে সেই দাবিরও। ফলে এই হত্যাকাণ্ডের দায়ে তাকে অভিযুক্ত করেননি তদন্তকারীরা।
এরপরে আলোচনায় ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুল। পাকিস্তানে অত্যন্ত প্রভাবশালী সংস্থার প্রধানের কাছে দুর্ঘটনার কোনো পূর্বাভাস ছিল না, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের জন্যই সেই দাবি মানা কঠিন। তবে এই অফিসার জিয়াউল হকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও কোনো প্রমাণ হাজির করা যায়নি।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হত্যাকাণ্ডে আলোচিত ছিল মর্তুজা ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন আল-জুলফিকারের ভূমিকাও। সংঘাত তৈরিতে অত্যন্ত পারদর্শী এই দলের সাথে সাপে-নেউলের সম্পর্ক ছিল জিয়াউল হকের। জুলফিকার আলী ভুট্টোর হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা বিমান দুর্ঘটনায় ভূমিকা রাখতে পারে, এমন সন্দেহ ছিল অনেকেরই। জিয়াউল হকের ছেলে ইজাজুল হকের দাবিও ছিল সেরকম। কিন্তু ভিএক্স গ্যাসের যোগান পাওয়া এই গোষ্ঠীর পক্ষে কার্যত অসম্ভব।
দেশের বাইরের শক্তিগুলোর মধ্যে এই বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারে সন্দেহের তীর সবার আগে গিয়েছে রাশিয়ার দিকে। আশির দশকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমর্থন দেয় কমিউনিস্ট সরকারকে। এই কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্র সংগঠিত করছিল মুজাহিদিনদের, দিচ্ছিল অর্থ আর সামরিক সহায়তাও। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এই কাজটি করছিল পাকিস্তান। ফলে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পাকিস্তানের এই ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে সহায়তা করলেও সম্পর্ক খারাপ হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হকের মৃত্যুর সময় আফগানিস্তান থেকে রুশ সৈন্যদের প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ দেওয়া জিয়াউল হকের মৃত্যুতে ভূমিকা রাখতে পারে, এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
তবে স্নায়ুযুদ্ধে নিজেদের প্রবল শত্রুতা থাকলেও, একে অপরের বিরুদ্ধে হাজারবার প্রোপাগান্ডা চালালেও, জেনারেল জিয়াউল হকের দুর্ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে সরাসরি দায়ী করেনি যুক্তরাষ্ট্র। সম্ভবত, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে নতুন কোনো জটিলতা তৈরি করতে চাচ্ছিল না তারা।
এরপরের সন্দেহের তীরটা খোদ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। স্নায়ুযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রের অকৃত্রিম বন্ধু জিয়াউল হকের পাশাপাশি এই দুর্ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের এক শীর্ষ কূটনীতিবিদ নিহত হন, নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি অ্যাটাশে হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক জেনারেল। তাদের মৃত্যুর পরও যুক্তরাষ্ট্রের যে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল তদন্তে, বাহ্যিকভাবে সেটা কখনোই দেখা যায়নি। কংগ্রেসে অল্প কয়েকটি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়, এক বছর পর্যন্ত এফবিআইকে রাখা হয় তদন্ত প্রক্রিয়ার বাইরে। এই দুর্ঘটনার সাথে সংযুক্ত প্রায় আড়াইশো পৃষ্ঠার কূটনৈতিক ডকুমেন্ট ক্লাসিফাইড সিক্রেট হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল আর্কাইভে।
আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে সবার আগে আলোচনায় এসেছে ভারতের ভূমিকা। দেশভাগের ঘটনার পর থেকেই সম্পর্ক তলানিতে থেকেছে দুই দেশের মধ্যে, সীমান্ত উত্তেজনার পাশাপাশি বেশ কয়েকবারই যুদ্ধে জড়িয়েছে প্রতিবেশী দুই দেশ। এর পাশাপাশি, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ভারতের। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনায় আলোচনায় এসেছে ভারতের নাম। তবে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের কাছাকাছি থাকা পাকিস্তানে যেকোনো অস্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলত ভারতের নিরাপত্তা, হুমকিতে থাকত নাগরিকদের নিরাপত্তাও। ফলে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়ানোর কোনো কারণ ভারতের ছিল না।
ভূরাজনৈতিক হিসাবে আলোচনায় ছিল ইরানের নামও। শিয়াপ্রধান এই দেশটি ভালোভাবে নিচ্ছিল না সুন্নিপ্রধান পাকিস্তানের উত্থান, শঙ্কিত ছিল আফগানিস্তানে তাদের উপস্থিতি নিয়েও। জিয়াউল হকের মৃত্যু তাদের জন্য এ দিক থেকে স্বস্তির কারণ হতে পারত। তবে এত ঝুঁকিপূর্ণ আর হাইপ্রোফাইল অপারেশন করার দক্ষতা তখন ইরানের ছিল না বলেই মত দেন অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিমান দুর্ঘটনায় ভূমিকার জন্য আলোচিত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম আলোচিত হয়েছে ইসরায়েলের নাম, আলোচনায় এসেছেও সবার শেষে। এই দেশকে আলোচনায় এনেছেন তখন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা জন গুন্থার ডিন। কূটনৈতিক তথ্যের ভিত্তিতে শুরুর দিক থেকেই তিনি এই বিমান দুর্ঘটনাকে পরিকল্পিত হিসেবে দাবি করছিলেন তার সিনিয়রদের কাছে, দূর্ঘটনা ঘটাতে গ্যাস ব্যবহারের কিছু প্রমাণও সংগ্রহ করেন এই কূটনীতিবিদ। দেশ হিসেবে তার সন্দেহের তির ছিল ইসরায়েলের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রদূত ডিনের এই অবস্থান অস্বস্তিতে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রকে, মানসিক ভারসাম্যহীনতার অভিযোগ তুলে ছাঁটাই করা হয় চাকরি থেকে।
ভারতের পরমাণু বোমা পরীক্ষার পরে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সময় থেকেই পারমাণবিক বোমা তৈরিতে মরিয়া হয়ে ওঠে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের সুনজরে থাকা জিয়াউল হকও এই কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে দেন, ওয়াদা করেন মুসলিম দেশগুলোকে পারমাণবিক বোমা দেওয়ার। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান এমন একটি অবস্থানে ছিল যে, সেই বছরই বা তার পরের বছরের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতো তারা।
মুসলিম দেশগুলোকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবারহ করলে স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তার সংকটে পড়ত ইসরায়েল। ফলে জিয়াউল হককে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সরিয়ে দিলে একদিকে যেমন পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তি অর্জনের প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়া যেত, পাশাপাশি আটকানো যেতো মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে পারমাণবিক বোমার সরবরাহও।
এই রহস্যের জাল খুলবে কি?
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভে থাকা আড়াইশো পৃষ্ঠার ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টগুলোকে উন্মুক্ত করলে হয়তো এই বিমান দুর্ঘটনার রহস্যের কিনারা করা যেত। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা কম।
এই বিমান দুর্ঘটনা আরো বহুদিন রহস্যের চাদরে ঢেকে থাকবে। একদিন হয়তো এই রহস্যের জট খুলবে, যখন এর বাহ্যিক আর ব্যবহারিক মূল্য দুটোই কমে যাবে।
This article is written on a mystrrious plane crash in Pakistan, which led General Zia ul Haque with several other to death.
All the necessary links are hyperlinked inside.
Feature Image: The Guardian.