মানুষের তৈরি বিশ্বের গভীরতম কিছু গর্ত

কত গভীর পর্যন্ত গর্ত খোঁড়া সম্ভব হয়েছে মানুষের পক্ষে? মনুষ্য নির্মিত গভীরতম গর্তগুলো আসলে ঠিক কতটুকু গভীর? বিষয়গুলো নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা চাই। 

আকাশে ওড়ার চেয়ে মাটিতে গর্ত করা অনেক সহজ। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মাটিতে গর্ত খুঁড়ছে, গভীর থেকে পানি উত্তোলন করছে, এমনকি ভূগর্ভস্থ শহরও নির্মাণ করছে। সে তুলনায় মানুষের মহাশূন্যে গমনের প্রচেষ্টা একেবারেই সাম্প্রতিক। কিন্তু তারপরেও আকাশে মানুষ যতদূর পর্যন্ত যেতে পেরেছে,  ভূ-অভ্যন্তরে ততটুকু পর্যন্ত যাওয়া তো দূরের কথা, ততটুকু কোনো গর্তও তৈরি করতে পারেনি। ‌তবে মানুষের প্রচেষ্টা থেমে নেই। নিত্য নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভূ-অভ্যন্তরের রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে।

উডিংডিন ওয়াটার ওয়েল; Image Source: Thomas Ball

কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া মানুষের দ্বারা খালি হাতে তৈরি সবচেয়ে গভীর গর্ত হচ্ছে ইংল্যান্ডের ব্রাইটনের উডিংডিন ওয়াটার ওয়েল।  ১৮৫৮ সাল থেকে ১৮৬২ সালের মধ্যে নির্মিত এই পানির কূপটির ব্যাস ১ মিটারের চেয়ে সামান্য একটু বেশি। এটি নির্মিত হয়েছিল স্থানীয় একটি কর্মশালার জন্য পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে। এর গভীরতা ৩৯২ মিটার, যা সত্তরের দশক পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে রেকর্ড ধরে রাখা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের উচ্চতার প্রায় সমান।

আধুনিক যুগে বৈদ্যুতিক ড্রিল মেশিন ব্যবহারের ফলে মাটির গভীরে যাওয়া মানুষের পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে চিলির স্যান হোসে স্বর্ণ খনির দুর্ঘটনায় যে ৩৩ জন কর্মী ৬৯ দিন পর্যন্ত আটকা পড়ে ছিল, এবং পরবর্তীতে যেখান থেকে তাদেরকে সফলভাবে উদ্ধার করা হয়েছিল, সেটি ছিল খনিটির অভ্যন্তরে ৭০০ মিটার গভীরে। অবশ্য এটিই মানুষের খোঁড়া গভীরতম খনি না। এমনকি এটি মানুষের খোঁড়া সবচেয়ে গভীর গর্তগুলোর ধারেকাছেও না।

বিংহ্যাম ক্যানিয়ন মাইন; Image Source: mining.com

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিংহ্যাম ক্যানিয়ন মাইন হচ্ছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় আয়তনের গর্ত। ১৯০৬ সাল থেকে কাজ শুরু হওয়া এই খনিটি একটি উন্মুক্ত খনি, যার ব্যাস প্রায় ৪ কিলোমিটার এবং তলদেশের গভীরতা ৯৭০ মিটার। এতই গভীর যে, বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফাকে এর তলদেশে স্থাপন করলেও তার চূড়া পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০ মিটার গভীরে অবস্থান করবে।

এখন পর্যন্ত মানুষের খোঁড়া গভীরতম গর্ত হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্পোনেং স্বর্ণ খনি। এর গভীরতা ভূমি থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার। এর প্রবেশপথ থেকে গভীরতম স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে প্রায় ১ ঘন্টা সময় লাগে। খনির অভ্যন্তরে সর্বনিন্ম স্থানের তাপমাত্রা প্রায় ৬৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস, যা ভূপৃষ্ঠের যেকোনো উত্তপ্ত স্থানের চেয়েও বেশি।

সুড়ঙ্গের মতো প্যাঁচানো পথ বিবেচনা না করে যদি খাড়া গর্তের কথা বিবেচনা করা হয়, তাহলে অবশ্য মানুষের তৈরি গভীরতম খনি হবে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য একটি স্বর্ণ ও ইউরেনিয়াম খনি। মোব খোটসং মাইন নামের এই খনিটিতে রয়েছে বিশ্বের গভীরতম খাড়া সুড়ঙ্গ। এর গভীরতা প্রায় ৩ কিলোমিটার। এলিভেটরে চড়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পৌঁছতেই এখানে সময় লাগে সাড়ে চার মিনিট।

মানুষের দ্বারা তৈরি এই খনি দুইটির গভীরতা বিশ্বের যেকোনো প্রাকৃতিক গুহা বা সুড়ঙ্গের গভীরতার চেয়েও বেশি। বিশ্বের গভীরতম প্রাকৃতিক গুহা হচ্ছে জর্জিয়ার ভেরিওভকিনা গুহা। সর্বশেষ অভিযাত্রীদের হিসেব অনুযায়ী এর গভীরতা ২ হাজার ২১২ মিটার। আর খনি ছাড়া অন্য যেকোনো কাজে মানুষের যাতায়াত আছে, এরকম গভীরতম স্থান হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের গটহার্ড বেজ টানেল। এটি মূলত একটি রেললাইন, যা বিস্তৃত হয়েছে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৪৫০ মিটার নিচ দিয়ে। 

তবে খনি থেকে মূল্যবান পদার্থ আহরণের উদ্দেশ্য ছাড়াও নিছকই বৈজ্ঞানিক কৌতূহল থেকেও বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্যোগে বিভিন্ন খনন কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। এরকম একটি প্রকল্প হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোলা সুপারডীপ বোরহোল প্রকল্প। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরিত্বক তথা ক্রাস্ট (Crust) ভেদ করে দ্বিতীয় স্তর ম্যান্টল (Mantle) পর্যন্ত পৌঁছানো। বর্তমানে এটিই পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে মানুষের তৈরি সবচেয়ে গভীর গর্ত।

ক্রাস্টের পুরুত্ব পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছরের প্রচেষ্টায় মাত্র এক তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছানোর পর সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে প্রকল্পটি বাতিল করতে হয়েছিল। কারণ ঐ গভীরতায়ই তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ১৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, যে তাপমাত্রায় ড্রিলবিট তার কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিল। গর্তটির ব্যাস মাত্র ২৩ সেন্টিমিটার। বর্তমানে প্রকল্পের ক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত এবং গর্তটির মুখ বন্ধ অবস্থায় আছে।

চিকু জাহাজের প্রস্তাবিত খনন কর্মসূচী; Image Source: CNN

কোলা সুপারডীপ বোরহোল যদিও ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে গভীর গর্ত, কিন্তু পৃথিবীর বহিত্বক তথা ক্রাস্টের পুরুত্বের বিবেচনায় এর অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে কম। সমুদ্রের তলদেশে ক্রাস্টের পুরুত্ব অনেক কম হওয়ায় গভীর সমুদ্রে খননকার্যে নিয়োজিত প্রকল্পগুলো কম খনন করেও বাস্তবে ম্যান্টলের বেশি কাছাকাছি পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। এরকম একটি প্রকল্প হলো বিপি অয়েল কোম্পানীর ডীপওয়াটার হরাইজন প্রজেক্ট। ২০০৯ সালে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের নিকটবর্তী গভীর সমুদ্রের তেলক্ষেত্রে ১০ হাজার ৬৮৩ মিটার খননের মাধ্যমে বিশ্বরেকর্ড তৈরি করে।

ডীপওয়াটার হরাইজনের প্রকৃত খননকৃত গভীরতা যদিও কোলা সুপারডীপ বোরহোলের চেয়ে কম, কিন্তু যেহেতু এর খননকার্য শুরু হয়েছে সমুদ্র পৃষ্ঠের তলদেশ থেকে, তাই পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে গভীরতা হিসেব করলে এটিই বর্তমানে বিশ্বের মানবসৃষ্ট গভীরতম বিন্দু। সমুদ্রের তলদেশে পৃথিবীর ক্রাস্টের পুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম হয় বলে এটি একই সাথে ভূত্বকের দ্বিতীয় স্তর ম্যান্টলের সবচেয়ে নিকটবর্তী বিন্দুও। ডীপওয়াটার হরাইজনের পক্ষে অবশ্য নতুন করে রেকর্ড তৈরি করা সম্ভব না, কারণ ২০১০ সালে এক দুর্ঘটনায় প্রকল্পটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

পৃথিবীর ব্যবচ্ছেদ; Image Source: Printable Diagram

ডীপওয়াটার হরাইজনের সৃষ্ট রেকর্ড পার করার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমানে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে Integrated Ocean Drilling Program (IODP) নামের একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক প্রকল্প। প্রকল্পটির অধীনে জাপানের মালিকানাধীন চিকিউ নামের একটি ড্রিলিং জাহাজ পৃথিবীর ক্রাস্ট ভেদ করে ম্যান্টলে পৌঁছার লক্ষ্য নিয়ে গভীর সমুদ্রের তলদেশে খননকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এটি সমুদ্রের তলদেশ থেকে ৭ হাজার ৭৪০ মিটার পর্যন্ত খনন করতে পেরেছে। শীঘ্রই হয়তো এটি ক্রাস্টের সীমারেখা ছেদ করে ম্যান্টলে পৌঁছে যেতে পারবে। যার ফলে হয়তো আবিষ্কৃত হবে পৃথিবীর গঠন, পৃথিবীর এবং সৃষ্টি সম্পর্কিত নানা তথ্য।

কিন্তু এই মাইলফলক অর্জন করতে পারলেও পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যেতে এখনও মানুষের অনেক দেরি। 

ফিচার ইমেজ- picshype.com

Related Articles